মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
শুভ্রারানী চন্দ
দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার চিরকালের। দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে চলমান এ অত্যাচার ভিন্ন ভিন্ন রূপে, নানা আঙ্গিকে মানবজাতিকে আক্রান্ত করছে প্রতিনিয়ত। মানুষ আক্রান্ত হতো হিং¯্র প্রাণী দ্বারা, বিদেশি শত্রু দ্বারা, রোগ দ্বারা কিংবা বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ দ্বারা। কিন্তু সেগুলো ছাপিয়ে মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে নিজ দেশে, নিজ সমাজে। চিরচেনা, অতি পরিচিত, নিত্যদিন যাদের সাথে ওঠা-বসা তাদের দ্বারাই আক্রান্ত মানুষ- বড় পরিতাপের বিষয় এটি।
দেশ যখন বিদেশিদের দ্বারা শাসিত হয়েছে তখনকার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বিদেশিদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদে জড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা। প্রকৃতপক্ষে তখনকার জাতিগত বিদ্বেষ (সাম্প্রদায়িক) ছিল মানুষের সৃষ্টি। প্রকৃত অর্থে হাতে গোনা গুটিকতক মানুষ ছাড়া সবাই ছিল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। ব্যক্তিস্বার্থ কখনোই প্রধান বিষয় ছিল না।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিদেশি কুচক্রীমহল এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার বা বিদ্বেষের বীজটি তারা সযতেœ প্রোথিত করে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু বীজটি মহীরুহের আকার ধারণ করতে না পারলেও কিছু কিছু দুষ্টচক্রের কুমন্ত্রণায় মাঝে মাঝে এটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে নিমিষেই ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করছে এখনও।
গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ঘটে গেলো এক বর্বরোচিত ঘটনা। হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৫টি মন্দির এবং শতাধিক বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এখানেই শান্ত থাকেনি দুষ্টচক্র, প্রশাসনের নাকের ডগায় আবারো হামলা চালানো হয়েছে। আগুন জ্বালিয়ে ঘরদোর ও খড়ের গাদা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক একই সময়ে নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও নেত্রকোণায় মন্দির ও ধর্মগ্রন্থে আগুন লাগিয়ে সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে গভীর আতঙ্কের মধ্যে রাখা হয়েছে। দেশের অন্যত্রও যে কোন সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। চরম নিরাপত্তাহীনতা রয়েছেন যেমন আক্রান্তরা তেমনি যারা এখনও আক্রান্ত হয়নি তারাও। কারণ এ ধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনা ভাইরাশের মতো। যে কোন সময় যে কোন জায়গার মানুষ (হিন্দু) আক্রান্ত হতে পারে।
দেশে একটা অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের নিয়ন্ত্রণ ধারক ও বাহক সরকার ক্ষমতায় আসিন রয়েছে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখে সম্মানের ও গৌরবের জায়গা দখল করে নিয়েছে। দেশ-বিদেশের নানা অপকৌশল ও ষড়যন্ত্রকে কঠিন হাতে মোকাবেলা করছে, একটা শক্ত অবস্থান থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে মোকাবেলা করেছে এবং করছে। এহেন অবস্থায় দেশে এতবড় একটা ঘৃণ্য জঘন্য ঘটনা ঘটানো প্রশাসনের নাকের ডগায় মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে এ নিয়ে। সরকারদলীয়রা আঙ্গুল তুলছে বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াত বিএনপির দিকে এবং বিরোধীরা দায়ী করছে খোদ সরকার ও সরকারদলীয় কর্মকর্তাদের। সরকারদলীয় তিনজন কর্মীকে বহিষ্কার করার ভেতর দিয়ে বিরোধী দলের অভিযোগ অনেকটা প্রমাণিত হয়ে যায় প্রকারান্তরে। প্রকৃতপক্ষে দায়ী যেই হোক না কেন সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব খোদ সরকারের। কারণ অভিযোগের আঙ্গুল তাদের দিকে উঠেছে। আর তারা বিরোধী দলকে যে দায়ী করছেন সেটা অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে জনগণের কাছে।
একথা এখন অনেকটা প্রচারিত এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করছে ক্রমান্বয়ে যে, খোদ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী কিংবা রাজনৈতিক কর্মকর্তাবৃন্দ হিন্দু সম্পত্তি দখল এবং তাদের দেশ ছাড়া করার কাছে প্রকারান্তরে দায়ী। কারণ একথাও শোনা যায় ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্তাব্যক্তিই এখন বলেন, তাদের এখন আর ভোটের দরকার নেই। সুতরাং, কোথায় কী ঘটল সে বিষয়ে তাদের মাথাব্যথাও নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এটি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুর সংখ্যা বা শতকরা হার এসে দাঁড়িয়েছে ১৯% থেকে মাত্র ৯% এ। যদি সহিংসতা না বন্ধ হয় তাহলে এটা ০%-এ এসে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
হিন্দুদের এই প্রতিবাদহীন দেশ ছেড়ে যাবার ঘটনার পেছনে মূল কারণ কি সাম্প্রদায়িক অনৈক্য? অত সহজ সমীকরণের বিষয় নয় এটি। এ সাম্প্রদায়িকতাকে পূঁজি করে একটা স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের পকেটভারী করছে। তারা যে ধরা ছোঁয়ার বাইরের কেউ তা মোটেই নয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভেতরে যেমন দ্বন্দ্ব আছে, তেমনি অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিজেদের ভেতর। অনেকে এর সুযোগ নিতে পারে-বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ। তৃতীয়পক্ষ তখনই সুযোগ নেয় যখন নিজেদের পরস্পরের ভেতর ভুল বোঝাবুঝি কিংবা অন্তর্কলহ থাকে। একটা বিষয় পরিষ্কারপ নেপথ্যে যেই থাকুক না কেন তাদের মূল উদ্দেশ্য অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি করা এবং সেখান থেকে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর যতই তাকে পূরণ কিংবা প্রশাসনের চেষ্টা করা হোক না কেন একটা ক্ষত কিন্তু থেকেই যায়। বাহ্মণবাড়িয়া ঘটনায় আইন-শৃংখলা বাহিনী কিংবা ক্ষমতাসীনদের যথেষ্ট উদাসীনতা ছিল। পরবর্তীতে যতই তাদের বরখাস্ত কিংবা বদলি করা হোক না কেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হোক কোন কিছুই ওই আক্রান্ত মানুষগুলোকে আশ্বস্ত করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে যে কারণেই হোক না কেন যখন কোন ক্ষত তৈরি হয় সময়ের সাথে সাথে তা কিছুটা পূরণ হলেও তার কিছু থেকেই যায়।
সাম্প্রদায়িকতার নামে যে সম্পদ সম্পত্তি দখলের খেলা হচ্ছে সেটা না থামালে এক সময় হিন্দুশূন্য দেশে মুসলমানরা আক্রান্ত হবেন। কারণ ওই বিশেষ মহলের কাজই হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়া। সুতরাং, এধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে যুক্ত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা রাষ্ট্র ও সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। তা না হলে বাংলাদেশের যে অর্জন তা ভূলুণ্ঠিত হবে এবং বিশ্ব দরবারে এ দেশের সুনাম ক্ষুণœ হবে। গর্বিত এ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির বিধান করে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। বারংবার একটি এলাকায় হামলা চালিয়ে দুষ্কৃতিকারীরা সরকারের আন্তরিকতা ও সামর্থকে কটাক্ষ করছে এবং সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমরা সাধারণ মানুষেরা ভেবে কোন কিনারা করতে পারছি না প্রকৃতপক্ষে অপরাধী কারা? একটা গণতান্ত্রিক দেশে বসবাসকারী সব নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের। সেখানে সরকার প্রধানের সব ধরনের সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের স্পষ্ট নির্দেশে থাকা সত্ত্বেও কী করে তারা বারবার আক্রান্ত হয়? একথা এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। তাহলে সমস্যা তৈরি করছে কারা, তারা কি রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়েও বেশি ক্ষমতার অধিকারী? যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি মন্ত্রী কিংবা অন্যদের কাজ কী? যদি কিছুই না হয় তাহলে সসম্মানে ওই পদগুলো ছেড়ে দেওয়া উচিৎ কর্তাব্যক্তিদের। আর যদি তাদের কোন দায়িত্ব থেকেই থাকে তাহলে তারা অর্পিত দায়িত্ব পালনে অক্ষম কিংবা আন্তরিক নন। যেটাই হোক না কেন সব বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে তাঁকে টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে- এসহজ বিষয়টিও জনগণ বোঝে। বিবেকবান, সৎ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যর্থতার দায় অন্যের উপর না চাপিয়ে নীরবে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। আর আমাদের দেশের জাতীয় চরিত্র হচ্ছে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার হীন প্রচেষ্টা। কোন ঘটনারই প্রকৃত কারণ উদঘাটন হয় না। বিচারও হয় না। ফলে অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলে। সুতরাং, পরস্পর বিদ্বেষ ও দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করে প্রকৃত অপরাধীকে সনাক্ত করতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এ মুহূর্তে জাতির উত্তরণের জন্য একান্ত প্রয়োজন, পারস্পরিক বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যের পথে আসুন সবাই। তাহলে মুক্ত হবে দেশ, যুক্ত হবে নতুন সংস্কৃতি। গায়ের জোরে ছলে-বলে কৌশলে অন্যের সম্পত্তি দখল করা হয় বরং নিজের জ্ঞান, মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার মাধ্যমে সম্পদ অর্জনে মনোযোগী হলে ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, দেশ ও বিশ্বের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। সুতরাং, অসৎ পথ পরিত্যাগ করে, বিদ্বেষ নির্লোভী হয়ে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে চালিত হই। অমানিশার অন্ধকার দূর করে নতুন আলোয় পথ চলে দেশকে গৌরবের আসনে স্থাপিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করি বিশ্বসভায়।