সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং কিছু কথা

আপডেট: জুলাই ২৬, ২০১৭, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন


ধর্মীয় বিষয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এধরনের সাম্প্রদায়িকতা রোষানল থামাতে গণসচেতনা সৃষ্টি করার লক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট এনজিও, সরকারি প্রতিষ্ঠান আয়োজন করছেন নানা ধরনের কর্মসূচি। এই কর্মসূচিগুলির মধ্যে রয়েছে সভা সেমিনার, মানববন্ধন, সমাবেশ, উঠান বৈঠকসহ নানা ধরনরে কার্যক্রম। এই কার্যক্রমগুলো পরিচালনার উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় সম্প্রীতি যাতে সমাজে অটুট থাকে এবং সকল ধর্মের মানুষসহ অবস্থান তৈরি করা। তবে বাস্তবতা হলো, এ ধরনের কর্মসূচির ফলে আদৌ কি সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণœ থাকছে বা ভবিষ্যতে থাকবে। দেশের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মপালনকারী মানুষের সংখ্যানুপাতে রয়েছে এক ধরনের বিভক্তি। তাই প্রশ্ন হচ্ছে যে, এ ধরনের বিভক্তি রেখা টেনে দিয়ে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এ ধরনের আলোচনার মাধ্যমে সহঅবস্থান করা বিষয়টা কতটা সম্ভব হবে? তাই সভা সেমিনার করার পূর্বে মূল সমস্যার উৎপাটন করা প্রয়োজন।
১৯৪৭ সালে তথাকথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। বিভক্ত হয় দুই ভাগে। অথচ এই উপমহাদেশে ধর্মানুপাতে বা ভাষা অনুপাতে জাতির সংখ্যা নির্ণয় করলে দেখা যাবে প্রায় শতাধিক ভাষা বা ধর্ম পালনকারী জাতির বসবাস রয়েছে এই উপমহাদেশে। তাই তৎকালীন সময়ে দ্বিজাতি তত্ত্ব বলতে কী বুঝানো হয়েছে, সে বিষয়টা এখনো মানুষের কাছে স্পষ্ট। তারপরও ওই সময় উপমহাদেশ দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই দুই ভাগের মধ্যে এক ভাগে ভারত অপর ভাগে পাকিস্তান পড়ে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগটাকে বলা হয়- এই বিভক্তটি হয়েছে হিন্দু মুসলমানের সংখ্যানুপাতে। ধর্মপালনানুসারে পৃথিবীর কোনো দেশেই এখনো জাতীয়তা নির্ধারণ করা হয় না। তাছাড়া বিভক্ত ভারত পাকিস্তানের জাতীয়তাও ধর্ম পালন অনুসারে নির্ধারণ করা হয়নি। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ১৯৪৭ সালে ধর্মকে ব্যবহার করে বিভক্তি রেখাটা টানা হয় রাজনৈতিক উদ্যেশ্যে। এখনো ভারতের অনেক অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলাম ধর্ম পালন করে থাকেন। বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ তাদের জাতীয়তা বিষয়টি ধর্ম পালন অনুসারে কোথাও লিখেন নাই। ভারতের মানুষ তাদের জাতীয়তা লিখে ভারতীয় হিসাবে। আর সেই সময় পাকিস্তানের মানুষ তাদের জাতীয়তা লিখতো পাািকস্তানি হিসাবে। বৃটিশ পরাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বৃটিশ তাড়ানো আন্দোলনের মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন অন্যতম নেতা। তিনি মুসলমান ধর্ম পালন করতেন । ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশ বিভক্তির পর তিনি ভারতীয় অংশে রাজনীতি করেন। সেই সময়কার সদ্য স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রী হিসাবে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতের সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাই উপমহাদেশের বিভক্তিটা কথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর হয়েছে তা বলাটা আদৌ যৌক্তিক হবে না।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে বিভক্ত হলে বাংলাও দু ভাগে বিভক্ত হয়। পূর্ব বাংলা পড়ে পাকিস্তান অংশে। পূর্ব বাংলার নতুন নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান। তবে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পারে তাদের মাঝে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি ধর্মকে ব্যবহার করে পূর্ব বাংলাকে নতুন উপনিবেশ তৈরি করেছে। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির বিরোদ্ধে শুরু হয় নানা রকম আন্দোলন সংগ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনায় বাংলাদেশের জন্ম হয়।  বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে সারা বিশে^ পরিচিত করান। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী কতিপয় সেনা সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার মূল্য আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র যন্ত্রে ধর্মের ব্যবহারের অনুপ্রবেশ ঘটে। দেশের প্রথম সেনা শাসক মে. জে. জিয়া রাজনীতিতে সুনিপুনভাবে ধর্মের ব্যবহার শুরু করেন। তিনি ছিলেন অবৈধ শাসক। জিয়ার উত্তরসুরি দ্বিতীয় সেনাশাসক লে. জে. হু মু এরশাদ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ইসলামকে ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রেরও ধর্ম হয়ে যায়, বাংলাদেশ নামক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটি ইসলাম ধর্ম পালন করতে শুরু করে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার ফলে এ দেশে বসবাসরত অন্য ধর্ম পালনকারী নাগরিকদের মানবাধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হয়। এরশাদের শানমালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি অনুদান প্রাপ্ত এনজিওর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই এনজিওর মধ্যে অনেকগুলো ছিল মানবাধিকার সংগঠন, যারা অদ্যবধি মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে। সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রের নিজস্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠার করার বিষয়ে সেই সময় কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠন এবং এনজিওগুলি কোনো প্রতিবাদ করেনি। জিয়া এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে তাদের রেখে যাওয়া সাম্প্রদায়িক বিধি বিধানগুলির মৌলিক কোনো পরির্বতন ঘটেনি।
২০১০ সালের ২৬ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্ট এরশাদের আমলের সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। সেই সাথে এরশাদের সামরিক শাসনকেও অবৈধ এবং সংবিধান পরিপন্থি বলে ঘোষণা দেন। ওই সময় আদালত মোশতাক, জিয়া, এরশাদের শাসনামল সম্পর্কে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক ক্ষমতায় বসেন, মোশতাকের ক্ষমতা দখল সংবিধান পরিপন্থি তাই তা অবৈধ। মোশতাকের পর সেই পথ ধরে সায়েম, জিয়া, এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। ফলে এদের সবার ক্ষমতাই অবৈধ। মে. জে. জিয়া রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি ধ্বংস করে দিয়ে ছিলেন। এদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলচেতনা নস্যাৎ করে ছিলেন মে. জে. জিয়া তার শাসনামলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ ছিল সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার। সেই সাথে আরেকটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। জিয়া এরশাদের শাসনের অবসানের পর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে, বর্তমান সরকারে সংবিধান সংশোধন করেন। তবে এই সংশোধনীতে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রেখে ৭২ এর সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হয়। আরো বলা হয়, রাষ্ট্রে বসবাসরত সকল নাগরিক নিজ নিজ ধর্ম সমান অধিকার নিয়ে পালন করতে পারবে। উল্লিখিত বিষয়গুলি স্পষ্টত অসামঞ্জস্যতার ইঙ্গিত বহন করে। এই অসামঞ্জস্যতা নিরসন না করে সভা সেমিনার করে ধর্মীয় সম্প্রীতি আনা কি আদৌ সম্ভব হবে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হয়। সেই সময় ভারতকে পাকিস্তান সরকারিভাবে শত্রু হিসাবে ঘোষণা দেয়।  পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে দ্য ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স জারি করে। এই অর্ডিনেন্সের ১৬৯ উপবিধিতে বলা হয়, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের আগে থেকে যারা ভারতে ছিল বা  সেই তারিখের পর ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারত চলে গিয়েছিল, তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হবে। সেই সাথে তাদের বাড়িঘর, জমিজমা শত্রু সম্পত্তি হিসাবে রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়। উল্লিখিত সম্পত্তি যার মালিকানা অস্থায়ীভাবে সরকার নিতে পারবে। তবে সেই সময়ের বাস্তবতাটা ছিল একটু অন্য রকম। ওইসময় দেখা যায়,  পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দু ধর্মপালনকারীদের সম্পত্তি জমিজমা শত্রু সম্পত্তি হিসাবে পরিণত হয়ে যায়। অথচ ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মপালনকারীরা বংশাণুক্রমিকভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে দখলসত্ত্ব নিয়ে কথিত শত্রু সম্পত্তির জমিজমা ভোগ দখল করে আসছিল। আর ১৯৬৫ সালের এক আইনের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার এই সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসাবে  চিহ্নিত করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৯ নং আদেশের মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তি আইনটির পরিবর্তন করা হয়। আইনটির নতুন নামকরণ করা হয় অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে। ১৯৭৪ সালে একটি গেজেট প্রকাশিত হয়। এই গেজেটে বলা হয়, আর কো নো ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ নাই। তাছাড়া আরো বলা হয়, যারা দেশ ত্যাগ করেছে বা করে থাকলেও তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না।  মে. জে. জিয়ার শাসনামলে শত্রু সম্পত্তির বিষয়টি ১৯৬৫ সালের আইনের ন্যায় পুনঃরূপ লাভ করে নতুন মোড়কে। ১৯৭৬ সালের জিয়ার সামরিক ফরমানের অধ্যাদেশের ৯২ এবং ৯৩ নম্বর ধারায় লুকায়িত  শত্রু সম্পত্তি অধিগ্রহণের বিষয়টি জিইয়ে রাখে। ওই সময় একই সাথে হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে নির্ধারণ করে নতুন তালিকাও তৈরি করা হয়। তারপর ১৯৯১ সালের পর থেকে শত্রু সম্পত্তি বিষয়ক আইনটি বাতিল করার লক্ষ নিয়ে নানা বিধি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তৈরি শত্রু সম্পত্তি বিষয়ক আইনটির মূল স্পিরিট থেকে খুব বেশি সরে আসতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিকদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দখলিকৃত জমির মালিকানা যদি  ধর্ম পালনের অনুসারে নির্ধারিত হয়, তাহলে সেখানে মানবাধিকার বিষয়টি কতটুকু সংরক্ষিত থাকে? তাহলে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, এখানে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। সম্পত্তির অধিকার বিষয়টি বিভাজিত করার ফলে দেশের ধর্মপালনানুসারে জনগণকে বিভাজিত করা হয়ে যায়। মানুষের অধিকার বিষয়টি তার সম্পত্তি ভোগ দখলের বিষয়ের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। জনসাধারণের এই বিষয়টিকে দ্বি খ-িত করে ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য সভা সেমিনার করে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করা কি আদৌ সম্ভব হবে?
বিষয়টির মূল সমস্যার নিরসন না করে যতই সভা সেমিনার করে সম্প্রীতির মেল বন্ধন তৈরির চেষ্টা করা হোক না কেন  ততে করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রীতির বন্ধন তৈরি করা সম্ভব হবে না।
লেখক: ফ্রিল্যান্স লেখক।