সেই দিনগুলি

আপডেট: জুন ২৮, ২০২৪, ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ

মনিরুল ইসলাম মনি


মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবশেষে নৌকা নিয়ে গন্তব্যে যাত্রা শুরু। নৌকাটা ছিলো এমন জায়গায়
যেনো কেউ দেখতে না পায়। কারণ, কেউ দেখলে আর তা মা-বাবার কানে দিলে আমাদেও সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। খাড়িতে স্রোত প্রচণ্ড। উজানে যাওয়া খুবই কষ্ট। অদক্ষ মাঝি, স্রোতের বিপরীতে চুবুক চুবুক দাঁড়ের শব্দ গুনছে আর এগিয়ে যাচ্ছে। কানায় কানায় পূর্ণ খাড়ি। তাই খাড়ির পাশের বাড়িগুলো, ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে আর নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটা কচুরিপানার স্তুপ স্রোতে ভেসে এসে নৌকাকে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে। পানার স্তুপ সরাতে যেয়ে নৌকাটা স্রোতে ভেসে পিছিয়ে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে জেলেদের মাছ ধরা বেশেল এবং বন্যার পানিতে ভেঙে যাওয়া সাঁকোর বাঁশগুলো পার করে এগিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের। হচ্ছে তবুও মাছ পাবার আশায় কেউ থেমে নেই, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাগরিবের আজান কেবল শেষ হলো, ক্রমশ অন্ধকার নামছে। খাড়ির ধারের বাড়িগুলোতে জ¦লছে সন্ধ্যা প্রদীপ। ধীরে হলেও নৌকা চলছে। একজন ক্লান্ত হলে অন্যজন দাঁড় টানচ্ছে।

প্রায় তিন কিলোমিটার পথ উজানে যেতে হবে। অবশেষে তিন কিলোমিটার নদীপথ তিন ঘণ্টায় পার হয়ে মাছ ধরার জায়গায় তারা এলো। শরীর জুড়ে ক্লান্তি। একটা জায়গা পছন্দ করে সেখানে নৌকাটাকে বাঁধা হলো। সাহেব আলী ছিল বয়সে সবার চাইতে বড় এবং বুদ্ধিমান। সব ক্লান্তি ঝেড়ে সে খাড়ির দু’পারে দশটা দশটা করে মাছধরা জিয়ানা পুতে দিলো আর প্রতিটি জিয়ানার মাথায় বড়শিতে গেঁথে কোলা ব্যাঙ। বন্ধু মুনি কাজটা খুব যত্নের সাথেই করলো।

রাতে এবার খাবার রান্নার পালা। মুনি ভালো রাঁধতে পারে। সে রান্না শুরু করলো। প্রকৃতিতে তার সবাই স্বাধীন। কারও ইচ্ছে জাগলো ধূমপানের, দুএক টানও হলো। হলো, বিষম কাশির কণ্ঠযুদ্ধ। এ বয়স হয়তো এমনই। আমার চৌডালা গ্রামের বন্ধু ধূমশলাকার আগুনে মারা যায়, সত্যি এ গভীর শোকের। এই ভাবতে ভাবতে সেমাই রান্না শেষ। খাবো এমন সময় একটা দমকা বাতাস এলে এবং আমাদের নৌকাটা দুলে উঠে। ওদিকে আকশে মেঘের দাপাদাপি। ঘুটঘুটে আঁধার চারদিক। বাতিতেও তেল শেষ, নিবু নিবু করছে। অজানা এক আতংক যেনো সবার মনে। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলছিনা। শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া। ভয়ের পরিধি আরোও বেড়ে গেল।

আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নাই শুধু ধুধু মাঠ আর মাঠ এই মাঠেই পুষ্কুরনি নামক এক জায়গায় প্রতিনিয়ত ডাকাতি হয় সুতরাং কোনো বিপদে পড়লে চিৎকার করে ডেকেও কারো সাহায্য পাবার সম্ভাবনা নেই। এক সময় প্রদীপটা দপ করে নিভে গেল। আর ভয়ে গা কাঁটা দিলো। খাড়ির পানিতে মাঝে মাঝে দুএকটা মাছ ফালদিয়ে উঠছে আর ঢেউগুলো একটু একটু করে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে একটা থমথমে পরিস্থিতি। কখনো কখনো দূর-আকাশের বাজঝলকানিও আসছে। বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড় ও বৃষ্টি আরম্ভ হবে। সত্যি তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবলভাবে বৃষ্টি এলো । এভাবে প্রায় আধঘণ্টা চলার পর

ধীরে ধীরে বৃষ্টির দাপাদাপি কমলো। আর চাঁদনী আলোতে খাড়ির পানি যেন দুধের মত। সবাই তন্দ্রাঘোরে, চারদিকে একবার করে তাকাচ্ছি আর জিয়ানায় টোপ দেয়া মাছ-সাতারের শব্দ শোনার চেষ্টা করছি। টোপের মাছগুলোর পিঠে বড়শি গেঁথে পানিতে এমন ভাবে ভাসিয়ে রাখা হয় যেন মাছটা এদিক ওদিক সাঁতার কাটতে পারে। খাড়ির ধারের পিঠালির গাছ থেকে দুএকটা করে পিঠালি চুবুক চুবুক শব্দে পানিতে পড়ছে। হুতুম পেচার ডাক মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কখনোবা বাজপাখি ও চামাচিকা পাশ ঘেষে উড়ছে। রাতে বাজপাখি সঁ করে পাশ ঘেষে উড়ে যায় এবং তাকে দেখা যায়না কিন্তু অনুভব করা যায়। আর চামাচিকা বেশ কয়েকবার মানুষের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যায়।

রাত একটু একটু করে ক্রমশ বেড়ে চলেছে আমরা শুধু অপেক্ষা করছি কখন একটা মাছ বাঁধবে। জিয়ানাই একমাত্র বোয়াল মাছ বাধে কারণ অন্য কোনো মাছ এভাবে জিয়ানাই টোপ গেলেনা এজন্য বোয়াল মাছকে ল্যালাহ বোয়াল বলে। ল্যালাহ অর্থ পাগল। বোয়াল মাছ টোপ গুলার আগে কোন কিছুই ভেবে দেখেনা মুখটা বড় হা করে মাছটা গিলে ফেলে এবং শিকারির ফাঁদে ধরা দেয়।

রাত প্রায় দুইটা। হটাৎ প্রচণ্ড জোরে পানির শব্দ পেলাম ততক্ষণে সবার তন্দ্রা কেটেগেছে।সবার পঞ্চ ইন্দ্রীয় সজাগ। আবারো খাড়ির অন্যপারে পানির তোলপাড় শব্দ। বন্ধু সাহেব বলছে, মাছ বেধেছে তাড়াতাড়ি ওপারে চলো। দ্রুত নৌকা খুলে দিয়ে সজোরে ধাক্কা মেরে ওপারে যাবার জোর চেষ্টা করা হলো কিন্তু প্রচণ্ড স্রোতের কারণে নৌকা কিছুটা ভাটিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে উজানে উঠে এসে যেখানে মাছ বিধেছে সেখানে থামলাম কিন্তু মাছের আর কোনো শব্দ নাই। আমরা ধরে নিলাম মাছটা ছুটে গেছে। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই মাছের দাপাদাপি। এবার সেই মাছবাধা জিয়ানার কাছে যেয়ে দেখি এটা আমাদের জিয়ানা না কিন্তু বিরাট একটা মাছ বিধেছে। আগপিছ না ভেবে মুহূর্তেও মধ্যে সবাই সিধান্ত নিলাম মাছটা খুলে নিবো, যেহেতু মাছটার আশপাশে জিয়ানার কোন মালিকেরা নাই। মাছটা আমাদের। খুব সাবধানে জিয়ানাসহই আমাদের নৌকায় তুলে নিলাম।

বড় বোয়াল। ওকে তুলে নেওয়া ঠিক না তবুও ভুল-সঠিক ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মাছটাকে নিজের করি। কবিগুরু তো বলেই গেছেন, এই বয়সের শিশুরা প্রভুহীন পথের কুকুর। কাঁচা কথা ন্যাকামি পাকা কথা জ্যাঠামি, কথা মাত্রই প্রগলভতা। সুতরাং যেটাই করিনা কেন সবটাই ভুল। তাছাড়া বাড়ি থেকে না বলে বেরিয়েছি তাই মাছ নিয়ে বাড়ি গেলে কিছুটা হলেও বকুনি কম খেতে হবে। বড় বোয়াল এখন আমাদের নৌকায়, আমরা ভীষণ খুশি। তবুও মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে। মাছটার প্রকৃত মালিক যদি চলে আসে, মাছটা হাত ছাড়া হবে। আমরা দ্রুত আমাদের জিয়ানা গুছিয়ে নেয়া শুরু করলাম এবং আমাদের একটা জিয়ানা রেখে দিয়ে বাকিগুলো নৌকায় উঠালাম এবং দ্রুত ঘরমুখো হলাম। এরমাঝে মাছের প্রকৃত মালিক এসে হাজির। আমরা ততক্ষণে অনেকটা পথ স্রোতের অনুকূলে ভেসে গেছি। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো এবং আঁধার সরাতে এদিক ওদিক টর্চ মারতে লাগলো আর এদিকে লোকটার দৃষ্টি থেকে ধীরে ধীরে আমরা দূর হয়ে গেলাম।