সোনার দেশ ডেস্ক :
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পরিবেশ রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ করছে প্রশাসন। নারিকেল জিঞ্জিরা খ্যাত এ দ্বীপ ভ্রমণে যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবুও দ্বীপের বাসিন্দা ছাড়া সেখানে কেউ যেতে পারছেন না।
চলতি মাসে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন, তবে থাকতে পারবেন না এমন ঘোষণা থাকলেও দ্বীপ ভ্রমণের সব ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। দ্বীপের বাইরে থাকা আত্মীয়-স্বজনরাও বেড়াতে যেতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এই পরিস্থিতি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা মূলত পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল তাদের ব্যবসা কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। দুর্ভোগের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ীরা।
সেন্টমার্টিনের পর্যটন ব্যবসায়ী তৈয়ব উল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আড়াইশ বছর ধরে এখানে মানুষের বসবাস। পরিবেশ কীভাবে রক্ষা করা দরকার তা আমরা বুঝি। দ্বীপের সাড়ে ১২ হাজার বাসিন্দার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন পর্যটন খাত। এটি বন্ধ হয়ে গেলে জীবিকা সংকটে পড়তে হবে। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের প্রতিটি সেক্টর পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। পর্যটক আসতে না পারায় প্রত্যেকটি সেক্টর বন্ধ। খাঁ খাঁ করছে দেশের সৌন্দর্যমণ্ডিত সেন্টমার্টিন। শুধু পর্যটক নয় আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও আসতেও অনুমতি দিচ্ছে না প্রশাসন। এভাবে চলতে থাকলে রক্ষার চেয়ে ধ্বংস হবে এই দ্বীপ।’
জানা গেছে, সেন্টমার্টিনে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে বেকার সময় পার করছেন।
সেন্টমার্টিন মাঝেরপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুল আমিন বলেন, ‘আমাদের আট সদস্যের সংসার। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন নাস্তার দোকান। ভাই-বোনের পড়ালেখা, সংসারের খরচসহ সবকিছু নির্ভর করে এই ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দ্বীপে পর্যটক নেই। তাই আমাদের ব্যবসাও বন্ধ। কক্সবাজারের স্থানীয় দর্শনার্থীরা এখানে বেড়াতে এলেও কোনোমতে ব্যবসা চলে। কিন্তু দ্বীপের বাসিন্দা ছাড়া এখানে কেউ ঢুকতে না পারায় ব্যবসা বন্ধ। বেকার সময় পার করছি। পরিবার অচলাবস্থা। হয়তো কয়েকদিন পর না খেয়ে মরতে হবে।’
পর্যটকের অভাবে ব্যবসায় ধস:
সেন্টমার্টিনের পর্যটন কেন্দ্রের দরজা বন্ধ থাকার কারণে দ্বীপটির ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বড় ধরনের ধস নেমেছে। পর্যটক যেতে না পারায় সেখানকার হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাটসহ অন্যান্য সেবা খাতগুলো বন্ধ রয়েছে। দ্বীপটির ব্যবসায় পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে পর্যটন খাতের স্থবিরতা ব্যবসায়ীদের আয়-উপার্জনে বড় আঘাত হেনেছে, যার ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়েছে।
সেন্টমার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ছোট-বড় ১৯৪টি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে।
বছরে ১২ মাসের মধ্যে আমরা ৪ মাস ব্যবসা করতে পারলে বাকি ৮ মাস স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারতাম। কিন্তু নানা কারণে ২০২১ সাল থেকে আমরা পুরো ৪ মাস ব্যবসা করতে পারিনি। পর্যটন মৌসুমে দুই মাস, দেড় মাস এরকম ব্যবসায় করতে পেরেছি। এ সময় পর্যটক কম থাকলেও ব্যবসায়ীরা কোনোমতে চালিয়ে নিতো।
অথচ বর্তমানে ভরা মৌসুমেও সবকিছু বন্ধ। শুধু হোটেল-রিসোর্ট নয়, পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসা বন্ধ। দুর্বিষহ দিন অতিবাহিত করছি আমরা। পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে আমাদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে।’
এদিকে, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সঙ্গে না থাকলে সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রবেশ করতে পারছেন না নিজ এলাকায়।
সেন্টমার্টিন যেতে পারছেন না স্বজনরা
সেন্টমার্টিনের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা আলমগীরের মেয়ে রোখসানার গত ৩ বছর আগে বিয়ে হয় সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায়। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এতদিন বাবার বাড়ি যেতে পারলেও এখন যেতে পারছেন না। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার জন্য কয়েকদিন ধরে সেন্টমার্টিন যাওয়ার তদবির করলেও অনুমতি মিলছে না বলে তার অভিযোগ। রোখসানা আক্তার আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘এটা কেমন কথা? আমার বাপের বাড়ি, আমার জন্মস্থানে আমি যেতে পারছি না। এটি সত্যিই দুঃখজনক।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরীর বলেন, নিরাপত্তাজনিত কিছু ঝুঁকির কারণে বেড়ানোর জন্য এখন অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। অনুমতির বিষয়টি এ বছর থেকেই চালু হয়েছে। যদি ট্যুরিজম চালু হয় এবং জাহাজ আসা-যাওয়া করে তখন আর এই অনুমতি লাগবে না।’
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতের কারণে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন রূটে পর্যটনের জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ার পর ইনানী সৈকতে স্থাপিত নৌ-জেটি ব্যবহার করে সেন্টমার্টিনে পর্যটক পরিবহন হতো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে ইনানী জেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখান থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে।
তথ্যসূত্র: রাইজিংবিডি