রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
ড. রুমি শাইলা শারমিন
শিশুটি অবাধে ভেসে বেড়াত সোনালী স্বপ্নের বন্যায়। কল্পনার রঙে আঁকা প্রজাপতি মন ডানা মেলে উড়ত অবলীলায়। বাবা’র চাকুরীর সুবাদে স্থান বদল। নিত্য নতুন পরিবেশ হয়ে উঠতো সহসা আপন আলয়। খেলার সাথীদের সাথে গড়ে উঠত অন্তরঙ্গতা আর প্রকৃতির সাথে একাত্মতা। স্বচ্ছ মানসিকতায় ভরপুর প্রগতিশীল পরিবারের কন্যা শিশুটির ছিল না কোন বাধা। তাইতো শিশুমনের পিপাসা মিটতো জেলেদের সাথে মাছ ধরা দেখে, টুনটুনির বাসা থেকে ডিম পেড়ে এনে অথবা শামুকের ডিম ভেঙ্গে, পুকুর থেকে শাপলা টেনে তুলে।
চঞ্চলা মন মেতে উঠত পেয়ারা গাছের মগডালে চড়ে। শিহরণ জাগতো নৌকায় চড়ে নদীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়িয়ে। কখনো অবারিত ফসলের মাঠে শীষের ডগায় নরম শিশির মেখে। বাবা’র আদুরে কন্যা’র কৌতুহল মিটতো বাবা’র কাছে হাজার প্রশ্ন রেখে। বলছিলাম প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের বর্ণিল শৈশবের কথা। একাধারে যিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, গল্পকার, সম্পাদক। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমির তিনি-ই প্রথম মহিলা পরিচালক। তাঁর রচনা থেকে নির্মিত হয়েছে নাটক, চলচ্চিত্র। তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশ, পেলে ও কানাড়ি ভাষায়। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি প্রাপ্ত। একুশে পদক,স্বাধীনতা পুরস্কার
বাংলা একাডেমি পুরস্কার, চলচ্চিত্র পুরস্কার
ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার, শিশুসাহিত্য পুরস্কার, সার্ক সাহিত্য পুরস্কার সহ অগণিত পুরস্কারপ্রাপ্ত। বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি মিষ্টভাষী, সহজ সাধারণ বেশে অসাধারণ চিন্তাশক্তির অধিকারী তাঁকে কে না ভালোবাসে!
পদ্মাপাড়ের মেয়ে আমি আজ তাঁকে ঘিরে অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ পেয়ে ধন্য । এই প্রমত্ত পদ্মাপাড়ে রাজশাহী শহরে ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন ও মা মরিয়ম-উন-নিসা বকুলের কোল আলো করে জন্মেছিলেন। রাজশাহীর প্রমথনাথ (পি.এন) গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি এখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে বি.এ. অনার্স এবং ১৯৬৮ সালে এম.এ. পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে উত্তাল তারুণ্যে সকলে যখন আড্ডায় ব্যস্ত, তখন মেয়েটির সখ্য ছিল পাঠ্যবই ও অন্যান্য বইয়ের সাথে। তাইতো তিনি লাইব্রেরীতে বসতেন একাগ্রচিত্তে। ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন বলেই হয়তো পাঠকের জন্য কঠিন বিষয়বস্তুকে সহজ করে লেখনীতে তুলে ধরতে তিনি পারদর্শী।
সেলিনা হোসেন শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। উল্লেখযোগ্য বইগুলো ‘সাগর’, ‘জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি’, ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘বর্ণমালার গল্প’, ‘যখন বৃষ্টি নামে’, ‘মেয়রের গাড়ি’, ‘এক রুপোলী নদী’, ‘আকাশপরী’, ‘চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ’, ‘নীলটুনির বন্ধু’, ‘নদীটির ঘুম ভেঙেছে’, ‘ফুলকলি প্রধানমন্ত্রী হবে’, ‘আমার স্কুল’, ‘বায়ান্নো থেকে একাত্তর’, ‘সোনারতরীর ছোটমণিরা’, ‘গল্পটা শেষ হয় না’, ‘মুক্তিযোদ্ধারা’, ‘কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ’, ‘অন্যরকম যাওয়া’ ইত্যাদি। তাঁর শিশুতোষ রচনায় ডুবলে অনুধাবন করা যায় – তিনি ভালবাসেন দেশ, মাটি, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে। নিজের শেকড়, ধর্ম, দর্শনকে সম্মান করেন। শিশুমনে ইতিহাস জানানোর প্রয়াসে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে তিনি তুলে ধরেন।
ইট পাথরের যান্ত্রিক জীবনে শিশুরা যখন শাশ্বত বাংলাকে ভুলতে বসেছে তখন শিশুদেরকে রুপ, রস,গন্ধে ভরা অপূর্ব প্রাণ প্রকৃতিতে নিমগ্ন করার প্রচেষ্টা। তিনি মূল্যবোধ গঠনের একজন সফল কারিগর। শিশুমনের সূক্ষ্মকোণে প্রবেশ করে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানো, বিপন্ন প্রকৃতিকে বাঁচানো, দেশপ্রেম গড়ে তোলা, পারস্পরিক সম্পর্ক পরম যত্নে লালন করতে শেখানো তাঁর অত্যন্ত সচেতন ও দক্ষ প্রয়াস। একজন মনস্তত্ববিদ হিসেবে জানি, শিশুমন বর্ণিল ও বিচিত্র। শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দায়বদ্ধতা আছে বলেই তিনি ভাবনাকে একান্ত নিজ শৈশবের চরিত্রের সাথে মিশিয়ে আবেগ অনুভূতি ভরা শিশুমনে প্রবেশ করেছেন। তাঁরই সোনালী শৈশব অভিজ্ঞতার রং, রেখা, শব্দেরা ধরা দেয় তাঁর লেখনীতে। হয়ে উঠেছেন অজান্তেই এক শিশু মনস্তাত্ত্বিক। এদেশের শিশুদের জন্য যা অসীম প্রত্যাশার বিষয়। নতুন শক্তিশালী প্রজন্ম গঠনে লেখকের শিশুসাহিত্য পেয়ে অভিভাবক হিসেবে আমরাও গর্বিত, আশাবাদী।
তিনি চেয়েছেন বাংলার সকল শিশু মর্যাদা নিয়ে বাঁচুক। সেলিনা নামের অর্থ প্রজ্জ্বলিত। সত্যিই তাঁর প্রজ্বলিত দীপশিখায় আলোকিত বাংলার শিশুদের সুন্দর, সুশৃংখল চলার পথ। তাঁর দুর্লভ এই গুণটি অটুট থাকুক। নদী তাঁর বড্ড প্রিয়। আজো তিনি করোতোয়া নদীতীরের পঞ্চাশ দশকের ফেলে আসা স্মৃতিতে কাতর। নদীর মতো স্বচ্ছ টলটলে তাঁর হৃদয় উৎসারিত সৃষ্টিতে আমরাও ডুব সাঁতার দিতে চাই ভাসতে চাই আরো…
ব্যক্তি জীবনে মো: আনোয়ার হোসেনের প্রেমময়ী স্ত্রী ও সুযোগ্য তিনটি সন্তানের জন্মদাত্রী। বিদগ্ধ পাঠকের একান্ত আপনজন। হে প্রিয়- দীর্ঘায়ু হোন, জন্মদিনে শুভকামনা নিরন্তর।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, বেতার ব্যক্তিত্ব