সোনা বাবা

আপডেট: ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ

নবভী হুসাইফিন আল সায়াদ


দরজায় শব্দ, ‘ঠক! ‘ঠক!’ বানু বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে? কে?’
দরজার ওপার থেকে জবাব দেয় রহমান, ‘আমি ‘মুক্তিযোদ্ধা’।
মুক্তিযোদ্ধা জানতে পেরে বানু বেগম তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলেন। রহমানের পায়ে গাঢ় আঘাত, শরীর দুর্বল, মুখে ক্লান্তির ছাপ। ওকে দেখে বানু বেগম খুবই খুশি হলেন। তিনি তার একমাত্র সন্তানকে যুদ্ধে হারিয়েছেন। তবে তার কোনো দুঃখ নেই বরং আছে বুকভরা গর্ব। তার মতে, মরলে তো মানুষ কলেরাতেও মরে! কিন্তু আমার সোনা যেভাবে মরেছে তাতে আমিও শান্তিতে মরতে পারব।
বানু বেগম রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আয় বাবা, আয়। এত দেরি করলি কেন? আল্লাহ গো! আমার সোনা বাবাটার কী পড়ছে।’
রহমান হতবাক! সে বুঝতেও পারছে না কী হচ্ছে এটা! অচেনা অজানা এক মানুষকে দেখে এই মহিলা এমন করছেন কেন? রহমানের অবাক মুখ দেখে বানু বেগম বলেন, ‘দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দে বাবা। নয়তো শত্রুরা ঢুকে পড়বে। তুই বস্, তোর জন্য খাবার কিছু নিয়ে আসি।’ রহমান কিছু বলতে যাবে তার আগেই বানু বেগম বললেন, ‘বাবা, আমার ছেলের নাম সোনা। এইতো যুদ্ধে শহিদ হয়েছে। খবর পেয়েছি। তুমিও তো ওর মত মুক্তিযোদ্ধা। তাই তুমিও আমার সন্তানের মত। এজন্যই তোমাকে সোনা বাবা বলে ডাকছি। কিছু মনে করা না।’
রহমান বলল, ‘না, না, চাচি। আপনি আমার জন্য এত কিছু করছেন তার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
‘থাক থাক কৃতজ্ঞতা। মায়ের কেউ কৃতজ্ঞ বলে না কি? যা হাত মুখ ধুয়ে নে।’
রহমানের মাথায় কী জানি চলছে। খাওয়া দাওয়া শেষে রহমানকে শুতে বললেন বানু বেগম। ওর হাঁটুর কাছে গাঢ় জখম। বানু বেগম আবার ভালো করে জায়গাটা বেঁধে দিলেন। এবং বললেন, ‘ত্ইু ঘুমা। আমি তোকে বাতাস করি। বাবা একটা গল্প শুনবি?’
রহমান অজান্তেই বানু বেগমকে ‘মা’ বলে ডাকল, ‘বল না মা।’
বানু বেগমের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি শুরু করলেন, ‘অনেক দিন আগের কথা। একটা গ্রামে অনেক মানুষ বাস করত। গ্রামের প্রধান খুব ভালো মানুষ ছিলেন। সবাইকে ভালোবাসতেন, সাহায্য করতেন। খুবই সুখী ছিল গ্রামটা। কিন্তু একদিন গ্রামে এক নতুন ধরনের লোকজন এল। তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। দুষ্টুবুদ্ধি করে তারা গ্রামের প্রধানকে ধরে নিয়ে চলে গেল। তারপর বিভিন্নভাবে গ্রামের মানুষদের অত্যাচার করল, হত্যা করল। সব ধ্বংস করে দিল।’
রহমান জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কী হল মা?’
বানু বেগম বললেন, ‘তারপর একদিন এক নতুন সূর্য উদয় হল। সেই সূর্যোদয়ের আভায় গ্রামের একদল যুবক কপালে মাতৃভূমির ধুলি লাগিয়ে প্রতিজ্ঞা করলÑ এবার তারা গ্রামের শত্রুদের বিতাড়িত করবে।’
রহমান হা করে গল্প শুনছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘শেষে কী হল মা?’
বানু বেগম বললেন, ‘শেষে ওরা হেরে গেল।’
রহমান আনন্দে বলল, ‘খারাপ লোকেরাই হারল, তাই না?’
বানু বেগম বললেন, ‘না রে সোনা, ঐ ভালো বাবারাই হেরে গেছিল। ওরা নিজেদের সব দিয়ে চেষ্টা করেছিল গ্রামকে রক্ষা করতে, মা বোনের ইজ্জত বাঁচাতে, গ্রামবাসীর প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু তারা শেষ মেষ পারেনি।’
রহমান কেঁদে দিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন মা এমন হল?’
তখন বানু বেগম বললেন, ‘কারণ, ওদের মন খুব উদার ছিল। তাদের মায়েরা খুব ভালো ছিল। একদিন ওদের সাথী পরিচয় দিয়ে শত্রুদের একজন ঢুকে পড়ল যুবকদের বাড়ি। মিথ্যা বলে কথায় কথায় ওদের সব তথ্য জেনে নেয় সে। তারপর বিশ্বাস ঘাতকতা দেখিয়ে হত্যা করে সবাইকে। এবং গ্রামকে পরিণত করে গোরস্থানে।’
রহমান কথাগুলো শুনে একদম চুপ। নিঃস্তব্ধতা, নীরবতা এবং ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে এক বিষাদময় পরিবেশ চারিদিকে। রহমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বানু বেগম পাশের ঘরে ঘুমাতে চলে গেলেন। রহমান সারারাত ঘুমায়নি। এক দেখাতেই যে মানুষটা মা হয়ে গেল তার সাথে এ কী করতে যাচ্ছে সে? এই ভেবেই হয়তো ওর মনের অবস্থা এমন।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বানু বেগম রহমানকে দেখতে গেলেন। তিনি দেখলেন, রহমান ঘরে নেই। পাগলের মত খুঁজতে লাগলেন রহমানকে। তিনি বার বার ‘সোনা বাবা তুই কোথায়?’ বলে ডাকছিলেন রহমানকে। হঠাৎ করেই খেয়ার করে দেখেন, ঘরের কলসির তলে একটা চিঠি। চিঠিটা লিখেছে রহমান। সে বলছেÑ
প্রিয় মা,
‘মা’ কাকে বলে তা তোমার সাথে দেখা না হলে বোধ হয় বুঝতে পারতাম না। সত্যি মাদের হৃদয় এত পরিষ্কার হয় তা আমার জানা ছিল না। বোধ হয় আমি জন্ম অনাথ, তাই। তোমাকে শেষ বিদায় জানানোর মত সাহস আমার নেই। তোমার ভালোবাসার বদলে তোমাকে আমি প্রথম থেকেই প্রতারণা দিয়েছি মা। হ্যাঁ আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা না। আমিই ঐ ব্যক্তি যার গুলিতে মরে তোমার সোনা বাবা। ওর পকেটে একটা কাগজ পাই। সেখানে তোমাদের বাড়ির ঠিকানা পেয়ে ভেবেছিলাম এইখানে বোধ হয় শত্রু ঘাঁটি। তাই মিথ্যা পরিচয়ে ঢুকে সব তথ্য নিতেই এসেছিলাম আমি। কিন্তু জানো কী, আমার সব পরিকল্পনাই মাটি। মাটি না বলে আগুন বলাটাই বোধ হয় সঠিক হবে। তোমার ভালোবাসা পেয়ে বুঝতে পেরেছি, আমরা কত বড় পাপী। মা তোমার কাছে কোন মুখে ক্ষমা চাইব, বল? তোমাকে ‘মা’ বলে ডাকার কোনো অধিকার নেই আমার। যদি পার, দয়া করে ক্ষমা করে দিও। কিন্তু এবার আর হারবে না মুক্তিযোদ্ধারা। এবার জয় হবে তোমার ভালো বাবাদেরই। যে সময়ে তুমি আমার চিঠি পড়ে শেষ করবে ততক্ষণে আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছি।’
চিঠি পড়তে পড়তে বানু বেগম কাঁদছেন। হঠাৎ এক গগণ বিদারী শব্দ। বানু বেগমের এই শব্দ পরিচিত। মাইন দিয়ে কিছু উড়িয়ে দিলে এই শব্দ হয়! বানু বেগম আবার পড়তে শুরু করলেন, ‘এবার আমি শহীদ হতে চাই মা, তোমার জন্যে। আমার মা যেন আমাকে নিয়েও গর্ব করতে পারে, নিজেকে শহীদজননী বলতে পারে তা আমি চাই। একটা শব্দ শুনতে পাবে। শুনলে ভাববে, শত্রুদের ঘাঁটি উড়ে গেল। আমিও তার সাথে চলে যাব চির নিদ্রায়। মা, শুধু তোমার এই সোনা বাবাটার জন্য দোয়া কর, দয়া করে ক্ষমা কর। তুমি কি আমাকে নিয়েও গর্ব করবে না, মা?
ইতি,
রহমান
চিঠি বানু বেগমের কান্নায় ভিজে গেল। আজ আরেকবার তার কোল শূন্য হল। সোনা বাবা বলে তিনি আজও কাঁদলেন সেভাবেই যেভাবে তার নিজের সন্তান সোনার জন্য কেঁদেছিলেন। একেই হয়তো বলে মায়ের মন। একেই হয়তো বলে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ…

:শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, শাখা খ, রোল ৩৬, গভ. ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, রাজশাহী।