সোহরাওয়ার্দী-মুজিব সম্পর্ক (১৯৩৮-১৯৪৯)

আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০১৭, ১:০২ পূর্বাহ্ণ

প্রফেসর ড. আবদুল খালেক


বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি আর যে ক’জন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে তাঁরা হলেন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম এবং মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব রাজনীতির মাঠে পদচারণা করেন, উক্ত চার রাজনৈতিক ব্যক্তিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন পথ তাঁর ছিল না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ভারত বিভক্তির ক্ষেত্রে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়, সে সময় শেখ মুজিব একজন তরুণ ছাত্র নেতা। সে সময় এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম এবং মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বেই তাঁকে চলতে হয়েছে। তবে শেখ মুজিবের আদর্শ নেতা ছিলেন জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তুলনামূলকভাবে তাঁকে বঙ্গবন্ধু বেশি শ্রদ্ধা করতেন। বলা যেতে পারে এক সময় সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে শেখ মুজিব তাঁর ‘রাজনৈতিক গুরু’ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখবার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেনÑ “ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হল, কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর ¯েœহ আমি পেয়েছিলাম।”
সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে শেখ মুজিবের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৩৮ সালে। তখন শেখ মুজিবের বয়স ১৮ বছরের মত হবে। সে সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে এগজিবিশন উপলক্ষে দুই মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাংলার দুই বড় মাপের নেতা গোপালগঞ্জে আসবেন, তা নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন দেখা দেয়। শেখ মুজিব তখন স্কুলের ছাত্র। অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ছাত্রদের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব। সে সময়  দেশব্যাপি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে নানা রকম দ্বন্দ্ব চলছিল। এর ফলে এগজিবিশন ভ-ুল করবার ষড়যন্ত্র হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র সফল হয় নি। হক সাহেব এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেব সভাস্থলে আসেন। তাঁরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এগজিবিশন উদ্বোধন করেন।
এগজিবিশন উদ্বোধন শেষে ফজলুল হক সাহেব পাবলিক হল পরিদর্শনে যান, অপরদিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব পরিদর্শন করতে যান মিশন স্কুল। শেখ মুজিব তখন মিশন স্কুলের ছাত্র। ছাত্রদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সংবর্ধনা জানানোর সুযোগ পান। স্কুল পরিদর্শন শেষে সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন, শেখ মুজিবও তাঁর সাথে সাথে হাঁটতে থাকেন। শেখ মুজিবের ভাষায়Ñ “তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন।” আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে। আদর করলেন এবং বললেনÑ “তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই? বললামÑ “কোন প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।” তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পর আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে  তাঁর সঙ্গে যেন দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।’ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে তরুণ শেখ মুজিবের যে ভাবে পরিচয়পর্বটি হয়, তার মধ্যে খানিকটা নাটকীয়তা আছে এবং ঘটনাটি  অসাধারণ ঘটনা বলে বিবেচনা করা যায়।
১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব একবার কলকাতায় বেড়াতে যান। বেড়াতে গিয়ে তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। দ্বিতীয় সাক্ষাতের সময় দেশের রাজনীতি নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে কিছু কথাবার্তা হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করেছিলেন।
১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়ে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে, থাকতেন বেকার হোস্টেলে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে মাঝে মাঝে তিনি দেখা করতেন, উপদেশ নিতেন। অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের কাছে শেখ মুজিব বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর জনপ্রিয়তার খবরে আনন্দ অনুভব করতেন।
১৯৪৩ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে মারা যায়। এই সময় শেখ মুজিবকে প্রাদেশিক মুসলিম কাউন্সিলের সদস্য করা হয়। জনাব আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সম্পাদক হন। তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মনোনীত ছিলেন। এর পূর্বে সোহরাওয়ার্দী সাহেবই মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দীন যখন প্রধানমন্ত্রী হন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী করা হয়। দেশে তখন দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শেখ মুজিব কয়েকজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে গিয়ে বলেছিলেনÑ “কিছুতেই জনসাধারণকে বাঁচাতে পারবেন না, মিছামিছি বদনাম নেবেন।” তিনি বললেন দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কি না, কিছু লোক তো বাঁচাতে চেষ্টা করব।”
সোহরাওয়ার্দী সাহেব মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নেয়ার পর গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা করার হুকুম দিলেন। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন। চাল, আটা, গম বজরায় করে আনতে শুরু করলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশ ছিল কোন মানুষ যেন না খেয়ে মারা না যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশ শেখ মুজিব কতখানি সততার সাথে পালন করেছেন, শেখ মুজিবের লেখা থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেনÑ “আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোন দিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।”
দুর্ভিক্ষে সমগ্র দক্ষিণ বাংলার মানুষ অতি কষ্টে দিনযাপন করছিল। তাঁদের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে গোপালগঞ্জে আনবার কথা ভাবা হয়। দক্ষিণ বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে কোনো কনফারেন্স হয় নি। একটি কনফারেন্স ডেকে সেখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং অন্যান্য বড় মাপের নেতাদেরকে আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কনফারেন্সের নামকরণ হয় “দক্ষিণ বাংলা পাকিস্তান কনফারেন্স।” উক্ত কনফারেন্স কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব শেখ মুজিবকেই পালন করতে হয়েছিল। নানারকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সেই সময় দিল্লিতে একটি জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় কনফারেন্সে উপস্থিত থাকতে পারেন নি বটে, তবে অন্যান্য নেতারা যেন কনফারেন্সে উপস্থিত থাকেন, সে ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী সাহেব সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন, ফলে কনফারেন্সটি সফলতা লাভ করে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে শেখ মুজিবের সম্পর্ক গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ হলেও মাঝে মাঝে ব্যক্তিত্বের সংঘাত দু’জনার মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।
কলকাতায় যে সকল ছাত্রকর্মী ছিল তাঁরা সবাই মূলত সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশেম সাহেবের ভক্ত ছিলেন। তবে ছাত্রদের মধ্যে কিছুটা বিভেদ ছিল। শেখ মুজিব ছাত্রনেতা আনোয়ার সাহেবকে পছন্দ করতেন না। কোন এক কমিটি গঠন নিয়ে আনোয়ার সাহেবের সাথে শেখ মুজিবের মতপার্থক্য দেখা দেয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব নেতৃবৃন্দকে ডাকেন তাঁদের গোলমাল মিটমাট করবার জন্য। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছাত্রনেতা আনোয়ার সাহেবকে কমিটিতে রাখতে চান। শেখ মুজিব তাতে ঘোরতর আপত্তি জানান। একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে শেখ মুজিবের কথা কাটাকাটি হয়ে যায়। কথা কাটাকাটির সময় হঠাৎ করে সোহরাওয়ার্দী সাহেব শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেলেনÑ ুডযড় ধৎব ুড়ঁ? ণড়ঁ ধৎব হড়নড়ফু.” উত্তরে শেখ মুজিব বলেনÑ ‘‘ওভ ও ধস হড়নড়ফু ঃযবস যিু ুড়ঁ যধাব রহারঃবফ সব, ুড়ঁ যধাব হড় ৎরমযঃ ঃড় রহংঁষঃ সব. ও রিষষ ঢ়ৎড়াব ঃযধঃ ও ধস ংড়সবনড়ফু. ঞযধহশ ুড়ঁ ঝরৎ. ও রিষষ হবাবৎ পড়সব ঃড় ুড়ঁ ধমধরহ.” ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৯)। কথাগুলো বলে চীৎকার করতে করতে শেখ মুজিব বৈঠক ত্যাগ করে বাইরে চলে আসেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বুঝতে পারেন এত শক্ত কথা বলা তাঁর ঠিক হয় নি। অতি দ্রুত জনৈক ছাত্রনেতা নুরুল হুদাকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব নির্দেশ দেন ‘শেখ মুজিবকে ধরে ফিরিয়ে আনো’। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশমত হুদা সাহেব দৌড়ে এসে শেখ মুজিবকে ধরে ফেলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও দো’তলা থেকে শেখ মুজিবকে ফিরে আসতে বলেন। হুদা সাহেব অনেক চেষ্টা চালিয়ে উত্তেজিত শেখ মুজিবকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে নিয়ে আসেন। কাছে এলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেনÑ “যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল কর না।’ এরপর সোহরাওয়ার্দী সাহেব আদর করে শেখ মুজিবকে তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেনÑ “তুমি বোকা, আমি তো আর কাউকেই একথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও ¯েœহ করি বলে তোমাকেই বলেছি।” শেখ মুজিবের ভাষায়Ñ “তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যে সত্যিই আমাকে ভালবাসতেন ও ¯েœহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। … সেই দিন থেকে আমার জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তাঁর ¯েœহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর ¯েœহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।”
বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ফলে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মন্ত্রিত্ব চলে যায়। মন্ত্রিত্ব চলে যাবার পর তিনি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানটিকে অধিক শক্তিশালী করার দিকে মন দেন। এই সময় কংগ্রেস ‘ভারত ত্যাগ কর’ আন্দোলন তীব্রতর করে তোলে। পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং আবুল হাশিম সাহেব পাকিস্তান আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন।
এই পর্যায়ে একদিন এ. কে. ফজলুল হক সাহেব ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে তার বাসায় দাওয়াত করেন। হক সাহেবের সাথে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের তখন রাজনৈতিক মতবিরোধ চলছিল। হক সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন, এ বিষয়ে দাওয়াতপ্রাপ্ত ছাত্রদের মধ্যে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। শেখ মুজিবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল হক সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব কিছু মনে করবেন না, কারণ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মন অনেক বড়। সেই বিশ্বাস থেকে শেখ মুজিব দাওয়াত নেয়ার ব্যাপারে ছাত্র নেতাদেরকে বলেছিলেন “কেন যাব না, নিশ্চয়ই যাব, হক সাহেবকে অনুরোধ করবো মুসলিম লীগে ফিরে আসতে।” হক সাহেবের বাসায় দাওয়াত খাওয়ার খবরটি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কানে পৌঁছে যায়। শেখ মুজিবের ভাষায়Ñ “কয়েকদিন পরে যখন আমি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “কি হে, আজকাল খুব হক সাহেবের বাড়িতে যাও, খানা-পিনা কর?” বললাম- “একবার গিয়েছি জীবনে।” তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, “ভালই করেছ, তিনি যখন ডেকেছেন, কেন যাবে না?” আরও বললাম, “আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি মুসলিম লীগে আসতে।” সোহরাওয়ার্দী সাহেব মন্তব্য করেছিলেনÑ “ভালোই তো হত যদি তিনি আসতেন। কিন্তু আসবেন না, আর আসতে দিবেও না। তাঁর সাথে কয়েকজন লোক আছে, তিনি আসলে সেই লোকগুলির জায়গা হবে না কোথাও। তাই তাঁকে তারা মুসলিম লীগের বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে।”
সোহরাওয়ার্দী সাহেব কতটা উদার ছিলেন তার উদাহরণ, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কলকাতার দুইটা সিট থেকে সোহরাওয়ার্দী এম.এল.এ. নির্বাচিত হন। অপরদিকে নাজিমুদ্দিন সাহেব পটুয়াখালী থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। নাজিমুদ্দিন সাহেবের রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যাবার উপক্রম দেখা দেয়। নাজিমুদ্দিন সাহেবের এই বিপদের মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। শেষ মুজিবের বক্তব্য থেকে জানা যায়Ñ “শহীদ সাহেব হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে কলকাতা থেকে বাই ইলেকশনে পাস করিয়ে নেব। যদি হক সাহেব পারেন, তাঁর প্রতিনিধি দিয়ে মোকাবিলা করতে পারেন। হক সাহেবও লোক দাঁড় করিয়েছিলেন নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে। নাজিমুদ্দিন সাহেবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন শহীদ সাহেবের দয়ায়।” পরবর্তীকালে নাজিমুদ্দিন সাহেব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের উদারতার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
(চলবে)