মাহাবুল ইসলাম:
কোটি টাকার লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে রাজশাহী থেকে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’, ‘ক্যাটল স্পেশাল ট্রেনে’র পর এবার চালু হলো ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’। কিন্তু এবারও খরচ তোলা তো দূরের কথা প্রথম দিনেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭২ টাকা! পশ্চিম রেলে স্পেশাল ট্রেন মানেই কি লোকসান? এমন মন্তব্যের সঙ্গেই উষ্মা প্রকাশ করছেন কৃষক, ব্যবসায়ীসহ রাজশাহীর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
কৃষক ও বিপণন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ট্রেন চালুর বিষয়ে অনেক ব্যবসায়ী কিংবা চাষিই অবগত নয়। এমন কী জানেন না কৃষি সম্প্রসারণের কোন কর্তাও। এছাড়া ব্যবসায়ী কিংবা চাষিদের জনমত যাচাই না করে ‘হ য ব র ল’ সিস্টেমে চালু করা ট্রেন আদৌ টেকসই হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ও ক্যাটল স্পেশাল ট্রেনে লাখ লাখ টাকার লোকসানের পর শনিবার (২৫ অক্টোবর) থেকে চালু হয়েছে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’। পূর্বের মতো এবারও চাষী ও ব্যবসায়ীদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া কীভাবে ক্ষতির মাত্রাকে কমিয়ে আনা যায় বা এড়ানো যায়; তার কোন কিছুই নির্ধারণ করা হয় নি।
জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের সবজি, ফলসহ কৃষিপণ্য ঢাকায় নেওয়ার জন্য এই স্পেশাল ট্রেন চালু হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিনেই কৃষিপণ্য ছাড়া রহনপুর ছেড়ে গেছে ট্রেনটি। শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ৯:১৫ মিনিটে রহনপুর রেলস্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে। রহনপুর-ঢাকা রুটে ট্রেনটি মাত্র ১৫০ কেজি সবজি পরিবহন করছে। পশ্চিম রেলওয়ের তথ্য মতে, এই ট্রেনটিতে মোট সাতটি বগি (লাগেজ ভ্যান) রয়েছে। এরমধ্যে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং অপর ছয়টি সাধারণ বগি। অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যানে কৃষিপণ্যের মধ্যে ফল, সবজি ছাড়াও রেফ্রিজারেটেড লাগেজ ভ্যানে মাছ, মাংস ও দুধ পরিবহন করা যাবে। এছাড়া চাষী, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ঢাকায় যাওয়ার জন্য অন্তত ২০টি চেয়ার রয়েছে। সবজির সঙ্গে তাদের বিনা ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে। সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ প্রতি শনিবার সকালে রহনপুর থেকে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। ট্রেনটির ধারণক্ষমতা ১০ মেট্রিক টন।
ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুর রেলস্টেশন থেকে সকাল ৯:১৫ মিনিটে ছেড়ে ঢাকার তেজগাঁও রেলস্টেশনে পৌঁছাবে বিকেল ৫:২০ মিনিটে। এতে প্রতি কেজি কৃষিপণ্যে পরিবহন খরচ পড়বে ১ টাকা ৩০ পয়সা। রাজশাহী থেকে তেজগাঁওয়ে এক কেজি কৃষিপণ্য পৌঁছাতে খরচ পড়বে ১ টাকা ১৮ পয়সা। রহনপুর রেলস্টেশন থেকে কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন ছেড়ে ১৩টি স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে তেজগাঁও স্টেশনে থাকবে। নাঁচোল, আমনুরা জং, কাঁকনহাট, রাজশাহী, সরদহ রোড, আড়ানি, আব্দুলপুর, আজিমনগর, ঈশ্বরদী বাইপাস, চাটমোহর, বড়ালব্রিজ ও জয়দেবপুওে ট্রেন যাত্রা বিরতি দিবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রহনপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩৪৬ কিলোমিটার। ট্রেনটি পরিবহন করতে খরচ হয় ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩২। কিন্তু প্রথম দিনে ট্রেনটিতে গেছে মাত্র ১৫০ কেজি ক্যারেট। ফলে ট্রেনটি আয় করেছে মাত্র ৩৬০ টাকা। প্রথম দিনে ট্রেনটিতে লোকসান হয়েছে ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭২ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রহনপুর, রাজশাহী, সরদহ রোড, আড়ানি, আব্দুলপুর, আজিমনগর, ঈশ্বরদী বাইপাস, চাটমোহর কোনোটিতে সবজি বুকিং দেন নি কোন চাষী বা ব্যবসায়ী।
রহনপুর রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার মামুন আলি জানান, রাতে পণ্যবাহী স্পেশাল ট্রেনটি রহনপুর স্টেশনে এসেছিল। সকাল ৯:১৫ মিনিটে কোনো কৃষিপণ্য ছাড়াই ট্রেনটি ছেড়ে গেছে। এই ট্রেনে কেউ কোনো সবজি পরিবহন করেন নি। রাজশাহী স্টেশন ম্যানেজার শহিদুল আলম জানান, উদ্বোধনী ট্রেনটিতে রাজশাহী থেকে কোনো সবজি বুকিং হয় নি। তবে ১৫০ কেজি ডিমের ট্রে (খাঁচা) পাঠানো হয়েছে। ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন মাস্টার পাভেল হোসেন জানান, এ স্টেশন থেকে কৃষিপণ্য বুকিং হয় নি। একই কাথা জানান, সরদহ রোড, আড়ানি, আব্দুলপুর, আজিমনগর, চাটমোহর স্টেশন মাস্টার।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, কৃষকের সঙ্গে ঢাকার ব্যবসায়ীদের সমন্বয় ও আবহাওয়া খরাপের কারণে প্রথমদিন সবজি আসে নি।
তবে রাজশাহী মহানগর পাইকারি কাঁচাবাজার সমিতির সভাপতি ফাইজুল ইসলাম বলেন, ট্রেনটি আমাদের জন্য ভালো হতে পারতো, আমরা এটি ব্যবহার করতে পারলে। তবে ট্রেনটি যে চালু হবে সেটি আমরা জানি না। আমাদের কেউ জানায় নি।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনটি চালুর সময় সাংবাদিকদের পশ্চিম রেলওয়ের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা একেএম রুহুল আলম বলেন, বাংলাদেশে কৃষিপণ্য স্পেশাল টেনটি গত ২২ তারিখ খুলনা ও এরপর পঞ্চগড় থেকে, সর্বশেষ আজ রাজশাহী থেকে চালু হয়েছে। এগুলো কৃষিপণ্য পরিবহন করবে। এখন প্রথম কেবল চালু হয়েছে। এটিতে সময় লাগবে। সামনে অবশ্যই আমরা পরিবহন করবো।
সবজি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, সব জায়গাতেই প্রচার প্রচারণা করেছি। গত পরশুদিনও মুলাডলিতে বাজারে কথা বলেছি। তারা আশ্বস্ত করেছিলেন। প্রতিদিনই ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক ঢাকায় যায়। তবে প্রথম দিনে রাজশাহী পর্যন্ত কোনো সবজি পায় নি। ১৫০ কেজি ডিমের ট্রে (খাঁচা) রাজশাহী থেকে ঢাকা যাচ্ছে। যাতে ৩৬০ টাকায় আদায় হয়েছে। আমরা আশা করছি সামনে এটি ভালো সাড়া ফেলবে।
এদিকে, আম পরিবহনের জন্য ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর চালানো হয় ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন। রাজশাহী থেকে ঢাকা কেজিপ্রতি আম পরিবহনে খরচ পড়ছে দেড় (১.৫০) টাকা। কিন্তু এরপরও ট্রেন লোকসানে চলে। সাড়া মেলে না ব্যবসায়ীদের। গত মৌসুমে শুধু যমুনা সেতু বাদ দিয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন ঢাকায় নিয়ে বাড়তি ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪০৮ টাকা বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে।
রেলওয়ে তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ৪৭ দিন চলাচল করে আয় হয়েছে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩৬ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ৫৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে ৪৯ দিন চলাচল করে আয় হয়েছে ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৯২৮ টাকা। ব্যয় হয়েছে ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০২২ সালে আয় হয়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ১৭৪ টাকা। আর ব্যয় ১২ লাখ ৪০ টাকা। ২০২৩ সালে আয় হয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫০২ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা। ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৮২ হাজার ৮৬০ টাকা লোকসান হয়েছে। এছাড়া ক্যাটল স্পেশাল ট্রেনেও বছরে লক্ষাধিক টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এতো লোকসানের পরও রেলওয়ের বিশেষায়িত কৃষি ভিত্তিক নব উদ্যোগ সম্পর্কে জানেন না খোদ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কেউ! রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা ও আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মাহমুদুল ফারুক বলেন, এ বিষয়ে আমাদেরকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোন উপায়েই জানানো হয় নি।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, রেলওয়েতে এমন কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে যারা ব্যক্তি স্বার্থে কোন পরিকল্পনা ছাড়া লোকসানি ট্রেন চালু করে। এতে তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়। কিন্তু সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে চাষী, ব্যবসায়ী, মার্কেটের একটা সুন্দর চেনই ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে। তারপর ট্রেন চালু করতে হবে। এছাড়া যে লক্ষ্যে ওই স্পেশাল ট্রেন চালানো হচ্ছে, তা সফলতা পাবে না।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিশাত আনজুম অনন্যা জানান, রেল কতৃপক্ষ তার সাথে যোগাযোগ করেননি। এমন কি তিনি এ বিষয়ে সামান্যতম অবগত নন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ জানান, বিষয়টা তিনি অবগত। তিনি জানান, রেল কর্তৃপক্ষ হয়তো তেমন প্রচারণা না করার কারণে শাকসবজি পায়নি। ভবিষ্যতে তিনি বিষয়টা দেখবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে পশ্চিম রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস ও মহাব্যবস্থাপক আব্দুল অওয়াল ভুঁইয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও কল রিসিভ করেন নি।