স্মরণীয়, বরণীয়, অনুকরণীয় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল

আপডেট: মে ১২, ২০২৩, ১:১৬ পূর্বাহ্ণ

আখতার বানু বীণা:


পৃথিবীর সবদেশে নার্স অর্থাৎ সেবিকাদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অসুস্থকে সুস্থ করে তোলেন একজন নার্স। আর বিশ্বের ইতিহাসে নার্সিং পেশায় যাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় তিঁনি হলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। জন্মগ্রহণ করেন ১৮২০ সালের ১২ মে, ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ধনী পরিবারে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট। বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল, মা ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেল লী স্মিথ।
ইটালিতে জন্মগ্রহণ করলেও ফ্লোরেন্স এর মেয়েবেলা কেটেছে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ার অঞ্চলে। ফেøারেন্স ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। খুব অল্প সময়ে বিভিন্ন ভাষা এবং পড়া আয়ত্ত করে ফেলতেন। ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই লেখাপড়া শেষ করেন।
ফ্লোরেন্স এর বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পৃথিবীখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হবেন কিন্তু ফ্লোরেন্স এর ইচ্ছা নার্স হবেন। ছেলেবেলা থেকেই কেউ অসুস্থ হলে সেখানে তিঁনি ছুটে যেতেন সেবা করার জন্য। এমনকি পশুপাখি অসুস্থ হলেও। তাঁর চোখের ঘুম, মুখের খাবার অসুস্থ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
কিন্তু সে যুগে সেবাকে কোনো পেশা হিসাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো না অর্থাৎ সম্মানজনক পেশা মনে করা হতো না। ফ্লোরেন্স এর মত এত ধনী পরিবারের সন্তান এই ধরনের পেশা গ্রহণ করবেন বাবা-মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। মেয়ের ইচ্ছার পরিবর্তন হবে মনে করে বাবা- মা তাঁকে দেশ ভ্রমণে পাঠালেন।
প্রথমে রোমে গেলেন সেখানে রোমান ক্যাথলিক কনভেন্টে সন্ন্যাসিদের সেবামূলক কাজ দেখলেন। জার্মানিতে একটি স্কুলে সেবার উপরে তিন মাস প্রশিক্ষণ নিলেন। প্যারিস গিয়ে দেখলেন হাসপাতাল পরিচালনার কাজ। এভাবে যেখানেই ভ্রমণ করেছেন সেখানেই হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন এবং সেবামূলক কাজ দেখেছেন। ইউরোপ পরিদর্শনকালে ফ্লোরেন্স এর পরিচয় হয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সিডনি হার্বাটের সাথে। হার্বাট ফ্লোরেন্স এর আশা- আকাক্সক্ষা ও প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনিই প্রথম তাঁর আশা-আকাক্সক্ষাকে সম্মান জানিয়ে ছিলেন। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছিল যা সারাজীবন টিকে ছিল। দু’জনেই মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
ভ্রমণ শেষে দীর্ঘদিন পরে ফ্লোরেন্স বাড়ি ফিরলেন। বাবা- মায়ের ইচ্ছায়, মেয়ে ধনী অভিজাত পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করলেন। কিন্তু ফ্লোরেন্স বললেনÑ “আমি সেবিকা হতে চাই।” তাই পেশার ক্ষেত্রে বাবা- মায়ের ইচ্ছা হার মানলো মেয়ের ইচ্ছার কাছে। ফ্লোরেন্স ১৮৪৯ সালে লন্ডনের হার্ল স্ট্রিটে নারী হাসপাতালে সুপারিনটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন। পাশাপাশি সেবার কাজ আরম্ভ করেন। ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত লন্ডেেনর ‘কেয়ার অব সিক জেন্টেলওমেন ইন্সিটিটিউট’ এর তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করেন।
জানা যায়, ১৮৫৪ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহতদের সেবা করার জন্য ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে সে সময় প্রতিরক্ষা দপ্তরের সিডনি হার্বাট আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে যুগে নারী কোনেসা নার্স সামরিক হাসপাতালে কাজ করতেন না। আত্মীয় স্বজন এমনকি হাসপাতালের ডাক্তার কর্মচারীদের বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সেবা করতেন। ফ্লোরেন্স এর কাজে খুশি হয়ে পরে সবাই তাকে সহযোগিতা করেন। তিঁনি দিনে কাজ করতেন, রাতে মোমবাতি হাতে আহত রোগীদের খবর নিতেন। তাই তাঁর নাম হয়েছিল -Lady with the Lamp. ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তঁাঁকে ৪৫,০০০ পাউন্ড পরিশ্রমিক প্রদান করা হয়েছিল কিন্তু তিঁনি নিজে খরচ না করে নাইটিঙ্গেল নামক ফান্ডে জমা করেন এবং লন্ডনে সেন্ট থমাস হাসপাতালে সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
১৮৫৬ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার পরামর্শে স্কটল্যান্ডে ‘রয়েল কমিশনাল হাসপাতাল’ তৈরি করেন এবং নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। যার নাম ‘কিংস কলেজ ট্রেনিং স্কুল ফর মিড ওয়াইফ।’ সেবার পাশাপাশি নার্সিং এর উপরে লেখালেখি করেছেন অনেক। ১৮৫৮ সালে ৮০০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করেন। যার নাম- Note on matters affecting the helth, efficiency and Hospital Administration of the British Army. ১৮৬৯ সালে Notes on Nursing  নামে একটি বই লিখেন। যা নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল এবং অন্যান্য নার্সিং স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
তিঁনি ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গবেষণা করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখেন। তাঁর কল্যাণে আজ সারাবিশ্বে নাসিং শিক্ষার বিপ্লব ঘটেছে।
নার্সিংকে পেশারূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লন্ডনে ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং।
ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেনস্ মেডিকেল কলেজ।’
ফ্লোরেন্স ১৮৫৯ সালে রয়াল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। তিঁনি অসংখ্য পদকে ও খেতাবে ভূষিত হন। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাঁকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ১৯০৭ সালে ‘অর্ডার অব মেরিট ’ খেতাব লাভ করেন। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি।
ফ্লোরেন্স বিশ্বাস করতেন রোগ নিরাময়ে ওষুধের পাশাপাশি দরকার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তাই তিনি যেখানে সেবার দরজা খুলেছেন সেখানে সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করেছেন। তিনি আধুনিক নার্সিং পেশার জননী, অগ্রদূত, লেখিকা, পরিসংখ্যানবিদ। পৃথিবীর ইতিহাসে মহিয়সী নারীদের অন্যতম একজন। গুণ ও কর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন শত শত বছর। যিঁনি প্রমাণ করেছেন Ñ সেবার পাশাপাশি নার্সিং একটি পেশা।
তাই আধুনিক নার্সিং পেশার রূপকার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে অকুন্ঠ সম্মান জানাতে এবং সমগ্র বিশ্বের নার্সদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭৪ সাল থেকে, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ International Nurse Day.’  ‘বিশ্ব নার্স দিবস’।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ রাজশাহী
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট