হত্যা

আপডেট: ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম



পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়তই কোন না কোন হত্যার খবর ছাপা হয়। টেলিভিশনেও প্রায় প্রতিদিনই হত্যার খবর ফলাও করে প্রচার করে। হত্যা শব্দটির মধ্যে ভয়ভীতি, আতংক, হতাশা, নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতা, উন্মাদনা, পৈশাচিকতা, বর্বরতা, ক্ষোভ, প্রতিশোধের স্পৃহা, ঘৃণা, দুঃখ, বেদনা, আফসোস, অন্যায় লাভ ইত্যাদি সবই জড়িয়ে আছে। হত্যা ঘৃণিত, নিন্দনীয় এবং মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশ দ-বিধি ৩০০ ধারানুসারে যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে, অন্য কোন ব্যক্তির দেহে আঘাত বা জখম করে মৃত্যু ঘটায় তখন তাকে হত্যা বা খুন বলা হয়। অর্থাৎ হত্যা বলতে বোঝায়, যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে, ব্যক্তিগত আক্রোশ বশতঃ কিংবা কোন হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আঘাত বা জখম করে মৃত্যু ঘটায়। বাংলাদেশ দ-বিধির ৩০২ ধারানুযায়ী হত্যাকারী বিচার সাপেক্ষে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- এবং অর্থদ-েও দ-িত হবেন। হত্যায় অভিযুক্ত যে কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। এবং এটি অজামিনযোগ্য অপরাধ।
ইসলাম ধর্ম অনুসারে হযরত আদম (আ.) এর পুত্র কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম হত্যা। ইবনে মাসউন (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “অন্যায়ভাবে যে ব্যক্তিই নিহত হয় তার খুনের একটি দায় আদম (আ.) এর প্রথম পুত্র কাবিলের ঘাড়ে চাপে। কারণ সে-ই সর্বপ্রথম হত্যার রেওয়াজ প্রবর্তন করে।” কিয়ামতের দিন এমনটি ঘটবে যে, নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর নিকট ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। কিন্তু হত্যাকারী নেক আমলসমূহ তা পূরণ করতে পারবে না। ফলে নিহত ব্যক্তির পাপকর্ম হত্যাকারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। “আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি আমার প্রতি হাত বাড়ালেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি তোমার প্রতি হাত বাড়াবো না।’ আমি তোমার সাথে লড়াই করা পরিহার করতে চাই। যদিও আমি তোমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কারণ আমি এ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছি যে, তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করবে। অর্থাৎ তোমার পূর্ববর্তী পাপসমূহের সাথে আমাকে হত্যা করার পাপের বোঝাও তুমি বহন করবে।” – কাবিলের হত্যার হুমকির জবাবে হাবিলের এ বক্তব্য তাঁর উত্তম চরিত্র, খোদাভীতি এবং ভাই কাবিল তাঁর ক্ষতি সাধন করার যে সংকল্প করেছিলো তার প্রতিশোধ নেওয়া থেকে তার বিরত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মুজাহিদ (র.) উল্লেখ করেন যে, কাবিল যেদিন তার ভাইকে হত্যা করেছিলো সেদিনই তাকে এর জন্য নগদ শাস্তি প্রদান করা হয়। মাতা-পিতার অবাধ্যতা, ভাইয়ের প্রতি হিংসা এবং পাপের শাস্তি স্বরূপ তার পায়ের গোছাকে উরুর সাথে ঝুলিয়ে এবং মুখম-লকে সূর্যমুখী করে রাখা হয়েছিলো। হাদীসে আছে যে, রাসলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: পরকালের জন্য শাস্তি সঞ্চিত রাখার সাথে সাথে আল্লাহ ত’ায়ালা দুনিয়াতেও তার নগদ শাস্তি প্রদান করেন।
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন মজিদে বলেন, “তোমরা একে অন্যকে হত্যা করো না।”- (সূরা নিসা: আয়াত-২৯), “যে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে গোটা মানবজাতিকে হত্যা করে।”- (সূরা আল মায়্যিদা, আয়াত-৩২), “যদি কেউ ইচ্ছাপূর্বক মু’মিনকে হত্যা করে, তবে তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ থাকবেন ও লানত করবেন; প্রস্তুত করবেন মহা শাস্তি।” (সূরা নিসা: আয়াত-৯৩)।
হাদীস অনুসারে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ওই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, কোন মুসলমানকে (মানুষকে) অন্যায়ভাবে হত্যা করা আল্লাহর কাছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অপেক্ষা কঠোর পাপ।” (নাসাঈ, হাদীস নং- ৩৯৮৮১)। নিহতের সকল পাপের বোঝা হত্যাকারীর ওপর চাপানো হবে, হত্যাকারীর কোন তওবা কবুল হবে না। হযরত সাঈদ ইবনে থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইব্নে আক্কাস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে তার তাওবা কবুল হবে কি? তিনি বললেন, না।
হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সবার আগে খুনের বিচার করা হবে।” (নাসাঈ) আবু মুসা আশ’আরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন দু’জন মুসলমান স্বীয় তরবারি নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা করে তখন হত্যাকারী ও নিহত উভয়ই জাহান্নামী। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারী জাহান্নামী হবে এটা তো স্পষ্ট, কিন্তু নিহত ব্যক্তি কিভাবে জাহান্নামী হবে, তিনি বললেন, “নিহত ব্যক্তির স্বীয় সাথীকে হত্যা করার জন্য আগ্রহী ছিলো।” (ইবনে মাজাহ)।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আল্লাহর দরবারে তিন প্রকার লোক সর্বাপেক্ষা অবাধ্য।
১.  যে হত্যাকা- ঘটায় হারাম শরীফের (বায়তুল্লাহর) মধ্যে,
২. এমন লোককে হত্যা করে যে তার হত্যাকারী নয় (যে তাকে হত্যা করার জন্য উদ্যত ছিল না)।
৩. যে জাহিলী যুগের সঞ্চিত আক্রোশ ও বিদ্বেষবশতঃ মানুষকে হত্যা করে। (আহমদ, বুখারী)। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: মনে রাখবে, ভুলবশত নরহত্যা ‘ইচ্ছাকৃত হত্যার মতো হত্যা।’ যেমন ছড়ি বা লাঠির আঘাতে হঠাৎ হত্যাকা- ঘটে যায়। (আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান)।
শরিয়ত নর হত্যাকে তিনভাগে বিভক্ত করেছে। ১. ইচ্ছাকৃত হত্যা, ২. ইচ্ছাকৃত হত্যার অনুরূপ হত্যা সাধারণতঃ যে সব বস্তু দিয়ে নরহত্যা করা হয় না। যেমন- লাঠি বা ঢিল ইত্যাদি দ্বারা হত্যা), ৩. অনিচ্ছা সত্ত্বেও হত্যাকা- ঘটে যাওয়া। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের উপর  (কোন মুসলিমের উপরে) অস্ত্র উত্তোলন করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (বুখারী, মুসলিম)। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহপাকের শপথ! যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্্ নেই, ওই মুসলমানকে হত্যা করা বৈধ নয়, যে সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, আর আমি রাসুল।”
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল বৃটিশ শাসনের ইতিহাসে এক কলংকময় দিন। ওই দিন পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র জনতার ওপর বৃটিশ সেনাবাহিনী গুলি চালায়। ফলে প্রায় ৪০০ লোক নিহত হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে সুদুর প্রসারী হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে তা ইতিহাসে তাদের বর্বরতা, নির্মম এবং নিষ্ঠুরতার পরিচয় বহন করে।
দ-বিধি আইনের ৯৯ ধারায় আরোপিত নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে নিজের জানমাল, অপরের জানমাল, কিংবা সরকারি সম্পত্তির যে কোন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য আক্রমণকারীর ওপর যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় দ-বিধি আইনের ৯৬ ও ৯৭ ধারা অনুসারে তাকে আত্মরক্ষায় ব্যক্তিগত অধিকার বলে। দ-বিধি আইনের ৯৯ ধারায় উল্লিখিত ব্যতিক্রমসমূহ ছাড়া দ-বিধি ১০০ ধারা অনুসারে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে নি¤œলিখিত ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো যায়।
১. এমন আঘাত বা আক্রমণ যা প্রতিহত না করলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হবে;
২. এমন আঘাত বা আক্রমণ যা প্রতিহত না করলে গুরুত্বর জখমের আংশকা অনিবার্য;
৩. ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ;
৪. অস্বাভাবিক বা অপ্রকৃত কাম লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশে আক্রমণ;
৫. অপহরণ বা অপহরণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি সরকারি কর্তৃপক্ষের সাহায্য নিতে না পারে।
দ-বিধি আইনের ১০০, ১০৩  ১০৬ ধারার কার্যপ্রণালি ৯৯ ধারার ব্যতিক্রম সাপেক্ষে নি¤œলিখিত অবস্থায় পরিপ্রেক্ষিতে কোন ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে খুন করলে অপরাধ বলে গণ্য হবে না
১.  ফৌজদারি আইনের ৪৬ (৩) ধারার বর্ণনা অনুযায়ী যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদ-ে দ-নীয় কোন অপরাধীকে গ্রেফতার করার সময় যদি কোন আসামী  গ্রেফতারকারী অফিসারকে বাধা দেয় বা আক্রমণ করে তাহলে গ্রেফতারকারী কর্মকর্তা গুলি করলে এবং গুলিতে উক্ত আসামীর মৃত্যু হলে কোন অপরাধ হবে না।
২. ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১২৭ ও ১২৮ ধারা এবং পুলিশ আইনের ৩০(ক) ধারানুযায়ী বেআইনি সমাবেশ যখন ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয় তখন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনবোধে গুলি করলে উক্ত গুলিতে কেউ খুন হলে কোন অপরাধ হবে না। (পি.আর.বি নিয়ম-১৫৩)।
৩. দ-বিধি আইনের ৮২ ধারার বর্ণনা অনুযায়ী ৭ বছরের কম বয়স্ক কোন শিশু কর্তৃক কেউ খুন হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
৪. দ-বিধি আইনের ৮৩ ধারার বর্ণনানুযায়ী ১২ বছরের কম বয়স্ক অপরিণত বোধশক্তি সম্পন্ন কোন শিশু কর্তৃক কেউ খুন হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
৫. দ-বিধি আইনের ৮৪ ধারার বর্ণনা অনুযায়ী অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি কর্তৃক কেউ খুন হলে তা অপরাধ হবে না। যদি অপ্রকৃতিস্থতার কারণে কার্যটির প্রকৃতি ও পরিধি অনুধাবন করতে অক্ষম হয়।
৬. দ-বিধি আইনের ৮৫ ধারার বর্ণনানুযায়ী অনিচ্ছাকৃত প্রমত্ততার কারণে বা অপরের দ্বারা নেশাগ্রস্ত হয়ে বিচারশক্তি রহিত ব্যক্তি কর্তৃক কেউ খুন হলে তা অপরাধ হবে না।
৭. দ-বিধি আইনের ১০০ ধারার বর্ণনানুযায়ী কোন ব্যক্তি শরীর রক্ষার জন্য আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে খুন করলে তা অপরাধ হবে না।
৮. দ-বিধি আইনের ১০৩ ধারার বর্ণনানুযায়ী সম্পত্তি রক্ষার জন্য আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে খুন করলে তা অপরাধ হবে না।
৯. দ-বিধি আইনের ১০৬ ধারার বর্ণনানুযায়ী নিরপরাধ ব্যক্তি বা শিশুর প্রতি ক্ষতি বা মৃত্যুর সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে কেউ খুন হলে তা অপরাধ হবে না।
তবে দ-বিধি আইনের ৮৪ ও ৮৫ ধারার ব্যতিক্রম সাপেক্ষে আত্মসংযম হারিয়ে ফেলে খুন করলে তা খুন বলে গণ্য না হয়ে অপরাধজনক নরহত্যা বলে গণ্য হবে। আত্মসংযম হারিয়ে ফেলে খুন করলে দ-বিধি আইনের ৩০৪ ধারানুযায়ী শাস্তিভোগ করতে হয়। দ-বিধি ২৯৯ ধারায় অপরাধজনক নরহত্যার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার বর্ণনানুযায়ী অপরাধজনক নরহত্যা বলতে বুঝায়-
১. কৃত কাজটির সম্ভাব্য পরিণতি মৃত্যু,
২. এরূপ দৈহিক জখম করা হয় যার ফলে মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
৩. কৃত কাজটির ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে বলে অপরাধী জানে না অথচ সে কাজের ফলে মৃত্যু ঘটে।
দ-বিধির ৩০৪ ধারানুসারে অপরাধজনক প্রাণহানির শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ- কিংবা ১০ বছরের কারাদ- বা যে কোন মেয়াদের কারাদ- তৎসহ অর্থদ- হতে পারে। এই ধারার আসামীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায় এবং এটি অজামিনযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশে হত্যার প্রধান কারণ সমূহ নি¤œরূপ:
১. জমিজমা সংক্রান্ত, ২. গ্রাম্য দলাদলি, ৩. মেয়ে ঘটিত বিরোধ, ৪. পূর্বের শত্রুতাবশত, ৫.পারিবারিক গন্ডগোল, ৬. ডাকাতির সময় বাধা পেলে, ৭. অন্যায় লাভের জন্য, ৮. উস্কানীমূলকভাবে বা হঠাৎ উত্তেজনাবশত;  ৯. নানাবিধ কারণ
(ক) রাজনৈতিক অস্থিরতা, (খ) নির্বাচন সংক্রান্ত, (গ) সাম্প্রদায়িকতা, (ঘ) প্রভাব, অধিপত্য বিস্তার বা ক্ষমতার জন্য
কথায় আছে হত্যা হত্যাকে ডেকে আনে। সিনেকার মতে, “একটি ছুরি কখনো কাউকে হত্যা করে না, সে কেবল ঘাতকের ইচ্ছেমতো ব্যবহার হয়।” শেক্সপীয়ার এর মতে, “রক্তবাহিত পথের কোন সত্য ভিত্তি নেই। অন্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কেউ জীবন পেতে পারে না।” মার্টিন কিং লুথার বলেছেন, “মানুষকে কিভাবে মানুষ হত্যা করে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।”
পুলিশ ও র‌্যাব এবং জাতিসংঘ শাস্তিরক্ষা মিশনে চাকরি করাকালীন শত শত হত্যা মামলার ঘটনা সম্পর্কে জানা, মামলার তদন্ত, তদন্ত তদারকি এবং হত্যার কারণ অবগত হওয়ার সুযোগ হয়েছে যা মনকে ব্যথাতুর, বেদনাদায়ক করে তোলে এবং পীড়া দেয়। কখনো বা দু’চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। হত্যাকা-ের ঘটনা শুনে সবসময় শিহরিত হয়েছি। ভেবেছি মানুষ কিভাবে মানুষকে হত্যা করতে পারে। এমন অনেক হত্যার তদন্ত করেছি যেখানে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হত্যার কারণে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। কিংবা গরীব কৃষকের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে হত্যাকা-ের শিকার হয়ে পরিবারের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বাবা-মা খেয়ে না খেয়ে ছেলেকে পড়িয়াছে। পাশ করে ছেলে একটি ভাল চাকরি পেলে তাদের অভাব-অনটন দূর হবে। কিন্তু  ছেলের নির্মম হত্যা তাদের স্বপ্নকে বিলীন করে দিয়েছে। আবার ছেলে কর্তৃক পিতা-মাতাকে কিংবা পিতা-মাতা কর্তৃক ছেলেকে হত্যার অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই বাংলাদেশে ঘটে যাচ্ছে যা শুধু বিবেককেই নাড়া দেয় না। মানবতাকেও কাঁদায়। প্রতিটি হত্যাই দুঃখ বয়ে আনে যা পূরণ হবার নয়।
২০১৩ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে সুদানের দারফুর প্রদেশের রাজধানী নিয়ালার এল সালাম নামে একটি ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকালে সকাল ১০ টার সময় আমাদের ক্যাম্পের সামনে অবস্থিত সুদান পুলিশের চেক পোস্টে দায়িত্বরত এক এসআই ও তিন কনস্টেবলকে বিদ্রোহীরা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকা-টি আমার চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। সুদান পুলিশের নিহত এসআই এবং ফোর্সরা সবসময় আমাদের ক্যাম্পে এসে খাবার পানি নিতেন। আমাদের সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন। হাসি ঠাট্টাও করতেন।
আমাদের দেশ সম্পর্কে জানতে চাইতেন। তাদের ছেলেমেয়েসহ পরিবার-পরিজনদের গল্প শোনাতেন। আমাদের সম্পর্কেও জানতেন। কথা প্রসঙ্গে এসআই একদিন বলেছিলেন, এবার ছুটিতে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেবেন। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন। সময় মতো ছুটি না পাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত তাদেরকে নিয়ে বেড়ানো হয়নি। আর এটাই তার একমাত্র দুঃখ। কথা দিয়েছেন এবার তাদেরকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু তিনি হত্যাকা-ের শিকার হওয়ায় সব স্বপ্ন ভেঙ্গে নিমিশেই মিশে যায়।
ঘটনার ১৫ মিনিট আগেও সুদানী এস.আই আমাদের ক্যাম্প থেকে পানি নিয়ে যান। কে জানতো আর কিছুক্ষণ পর বিদ্রোহীরা অন্যদের সাথে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করবে। এতো বড় একটি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটবে আমরাও তা বুঝাতে পারিনি। সুদানি পুলিশ অফিসার ও ফোর্সদের জন্য আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। কারণ এই ক’দিনে, তাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। সারাজীবন এই হত্যাকা-টি আমার হৃদয়ে  ব্যথা হয়ে গেঁথে রবে। চোখের সামনে তাদেরকে মরে যেতে দেখেছি কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। কারণ জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী আক্রান্ত না হলে কারো প্রতি গুলি করার আদেশ ছিল না। ফলে আমরা বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণ করে সুদানি পুলিশদের রক্ষা করতে পারিনি। তদুপরি তারা ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংখ্যায় ছিলো ৭০/৮০ জন। আর আমরা চাইনিজ রাইফেল ও একটি এলএমজি নিয়ে সংখ্যায় ছিলাম ৩০ জন।
মাঝে মাঝে পত্র পত্রিকায় পাকিস্তানের ‘অনারকিলিং’ এর খবর প্রকাশ করা হয়। সেখানে বাবা-মায়ের অমতে কোন ছেলে-মেয়ে বিবাহবন্ধনে কিংবা একে অপরের সাথে ভালবাসায় আবদ্ধ হলে, তাদেরকে অনার কিলিং এর নামে হত্যা করা হয়, যেটা নির্মম এবং বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ। আইন এটা কোনমতেই সমর্থন করে না। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবনের রুমা থানায় চাকরি করাকালীন এ ধরনের দু’টি ঘটনা ঘটতে দেখেছি। যেখানে পরিবারের অমতে বিয়ে করায় দু’টো পৃথক ঘটনায় দুজোড়া ছেলে-মেয়েকে পরিবারের লোকেরা গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। দু’টি মামলাই আমি তদন্ত করেছিলাম। পরিবারের মর্যাদা বজায় রাখার জন্য তারা এ ধরনের হত্যাকা- ঘটিয়েছিলো।
হত্যা হত্যাই। হত্যা কোন সমাধান নয় বরং শত্রুতা বাড়ায়। অনেক সময় হত্যা হত্যাকে ডেকে আনে। হত্যা আইনত দ-নীয়। কোন ধর্মেই হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। ইসলাম ধর্মে হত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে। হত্যা দুঃখ এবং ঘৃণা বয়ে আনে। দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতা হত্যাকে উৎসাহিত করে। আইনের মাধ্যমে হত্যাকারীর হত্যা সবারই কাম্য। দ্রুততম সময়ের হত্যার বিচার ক্ষতিগ্রস্তদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ন্যায় বিচারের পথকে অবশ্যই প্রশস্ত করে। হত্যাকারী শাস্তি পেলে হত্যা অবশ্যই কমবে, নচেৎ নয়।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা (অব.), (আই.জি ব্যাজ, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত)