শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২০ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
জোনাথন জ্যাকব মায়ার-এর শুক্রাণু ব্যবহার করে সন্তান ধারণ করা নারীদের নিয়ে তৈরি করা তথ্যচিত্রটি গত তেসরা জুলাই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়।
মায়ার কত সন্তানের বাবা তা জানার পর ‘ধোঁকা, খারাপ এবং রাগ’ বোধ করেছেন বলে জানান তাদের মধ্যে একজন নারী।
তবে মায়ার বিবিসিকে বলেন যে তথ্যচিত্রটি প্রতারণামূলক। কারণ এর মাধ্যমে যেসব পরিবার তার প্রতি কৃতজ্ঞ তাদের চেয়ে অসুখী মানুষগুলোকেই বেশি প্রধান্য দেয়া হয়েছে।
তবে তথ্যচিত্রটির নির্বাহী প্রযোজক বলেছেন, বেশিরভাগ পরিবারের খুশি থাকার দাবিটি ‘সম্পূর্ণ অসত্য’।
সাক্ষাৎকারে, মায়ার এটাও বলেছিলেন যে শত শত সন্তানের পিতা হওয়ার বিষয়টিকে তিনি ‘একদমই কোনো ভুল হিসেবে’ দেখেন না।
৪৩ বছর বয়সী মায়ার নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া তথ্যচিত্রটির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানালে বুধবার বিবিসি রেডিও ফোর-এ ওইমেনস আওয়ার প্রোগ্রামে কথা বলেন।
“তারা ইচ্ছাকৃতভাবে [তথ্যচিত্রটির] নাম দ্য ম্যান উইথ ১০০০ কিডস রেখেছে। অথচ এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল – ‘যে শুক্রাণুদাতা পরিবারগুলোকে ৫৫০টি সন্তানের গর্ভধারণে সাহায্য করেছেন’, বলেন মি. মায়ার।
“তার মানে শুরু থেকেই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারিত এবং বিভ্রান্ত করছে”।
মি. মায়ার আরো বলেন, তিনি আড়াইশো পরিবারকে ‘শুক্রাণু দিয়ে সাহায্য’ করলেও নেটফ্লিক্স পাঁচটি অসন্তুষ্ট পরিবারকে বেছে নিয়েছে। এই পাঁচটি পরিবারের বাইরে অন্যান্য পরিবারগুলোর বক্তব্য নিশ্চয়ই ভিন্ন রকমের হবে বলে তিনি মনে করেন।
নেটফ্লিক্স ওমেন’স আওয়ারকে বলেছে যে এটি মায়ারের সাক্ষাৎকার নিয়ে কোনো মন্তব্য করবে না।
তবে তথ্যচিত্রটির নির্বাহী প্রযোজক নাটালি হিল প্রোগ্রামটির সাথে কথা বলেছেন।
“আমি গত চার বছর ধরে জোনাথনের মিথ্যার কারণে প্রভাবিত হওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ৪৫ বা ৫০টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি,” বলেন তিনি।
“তার মিথ্যার বিষয়ে ৫০টি পরিবার আদালতে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছে এবং বিচারকের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তিনি থামেন। তাই জোনাথনের গুটিকয়েকের সঙ্গে আলাপ করার বিষয়টি সম্পূর্ণ অসত্য”।
মায়ার ১৭ বছর ধরে শুক্রাণু দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিগতভাবে শুক্রাণু দিয়েছেন। অর্থাৎ কোনো ক্লিনিকের মাধ্যমে না দিয়ে সরাসরি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছেন।
মায়ারকে তাদের শুক্রাণুদাতা হিসেবে বেছে নেয়া কয়েকজন নারী বলেন যে তিনি কত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন সে বিষয়ে তাদের কাছে স্পষ্ট করেননি মায়ার।
“আমি দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ সে আমাকে তখন বলেছিল যে সে পাঁচটি পরিবারকে শুক্রাণু দিচ্ছে”, নাটালি নামের একজন মা ওইমেসন আওয়ারকে জানান।
“২০২১ সালে আমি একটি সংবাদপত্রে পড়লাম যে এমন পরিবারের সংখ্যা আসলে শত শত ছিল। আর তাই আমি দ্বিধাগ্রস্ত এবং তার পদ্ধতির সাথে একমত নই”।
শুক্রাণু নেয়া কিছু নারী তাকে “একজন নার্সিসিস্ট” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আর অন্যরা পরামর্শ দিয়েছেন যে তিনি জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
সাড়ে পাঁচশো সন্তানের জন্ম দেয়ার সংখ্যাটিকে তিনি অনেক বেশি মনে করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মায়ার বলেন, “একজন সাধারণ মানুষের জন্য [বেশি], তবে একজন শুক্রাণু দাতার জন্য না”।
“একজন শুক্রাণু দাতার জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক। তারা শত শত শিশুর মধ্যে যায়। তারা [ক্লিনিকগুলো] দাতার শুক্রাণু বিভিন্ন দেশে পাঠাবে”।
‘সেকেলে চিন্তা’
মুক্তি পাওয়ার আগে তথ্যচিত্রটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়েছে।
রিভিউ বা পর্যালোচনায় চার তারকা দেয়া ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডের ভিকি জেসুপ এটিকে “রক্ত ঠান্ডা করা কাহিনী: আধুনিক যুগের বিপদ সম্পর্কে সতর্কতামূলক একটি গল্প” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
“এটি নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক, যদিও তা অত্যন্ত ভয়াবহ উপায়ে – আর শুক্রাণু দানের (এবং মায়ারের এটি করার উপায়) বিষয়ে উদঘাটন ভয়াবহ,” বলেন তিনি।
ভবিষ্যতে নিজেরই অজান্তে আপন ভাইবোনের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন নারী।
নাটালি নামের ওই মা বলেন: “সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল যে এই শিশুদের একে অন্যের সঙ্গে দেখা হবে এবং তারা প্রেমে পড়বে। কারণ তারা যে একই বাবার সন্তান সে বিষয়ে অজ্ঞাত থেকেই পরস্পরের মধ্যে কিছু একটা খুঁজে পাবে।
“এটাকেই আমি সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখি। কারণ নিজেকে উন্মুক্ত এবং পরিচিত দাতা হিসেবে দাবি করলেও তিনি বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ক্লিনিককে শুক্রাণু দান করেছেন। আর সব ক্লিনিক শিশুদের জন্য উন্মুক্ত এবং সৎ থাকার বিষয়টি মেনে চলে না”।
মি. মায়ার এই যুক্তিতে একমত নন। তার মতে এই উদ্বেগ তখন খাটে যখন বেনামী দাতাদের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তার পরিচয় সহজেই পাওয়া যায়।
“আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারি যে এখন সস্তায় ডিএনএ পরীক্ষার সুযোগ আছে আর আমি ডিএনএ ডাটাবেসে আছি যাতে তারা জানতে পারে,” বলেন তিনি।
“এছাড়াও বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের জানাবে যে তারা একজন দাতার শুক্রাণু থেকে জন্ম নিয়েছে। সুতরাং তারা সবাই যেহেতু আমার যেহেতু পরিচয় জানে আর এমন যদি হয়েও থাকে তবে তারা একে অপরের সাথে দেখা করে জিজ্ঞেসা করতে পারে, ‘তুমি কি ডোনার চাইল্ড (শুক্রাণু থেকে জন্ম নেয়া সন্তান)?’ আর দ্বিতীয়ত, তোমার ডোনার বাবা (দাতা পিতা) কি জোনাথন?’
“এই শিশুদের উপর এসব পুরানো দৃষ্টিভঙ্গি চাপানো আমাদের বন্ধ করা উচিত। তারা খুব ভালো করে জানে যে তারা দাতা শিশু। তারা জানে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করত হবে”।
আদালতে মামলা
দেশব্যাপী ১১টি ক্লিনিকে দান করা শুক্রাণু থেকে জন্ম নেয়া ১০২টি সন্তানের বাবা মায়ার- এমন খবর আসার পর ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডে তার শুক্রাণু দান করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে।
২০২৩ সাল পর্যন্ত অন্যান্য দেশে শুক্রাণু দান অব্যাহত রাখেন তিনি।
পরে একজন নারী এবং তাকে সমর্থন দেয়া একটি ফাউন্ডেশন মায়ারের বিরুদ্ধে একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন।
তার যুক্তি ছিল মায়ার তার সন্তানদের জন্য অজাচারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন।
মায়ার তার সাক্ষ্যে, পাঁচশো থেকে ছয়শ সন্তান থাকার কথা স্বীকার করেন। তবে আদালত জানান যে তিনি বিভিন্ন মহাদেশে এক হাজার পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত বিচারক মায়ারকে নতুন কোনো বাবা-মাকে শুক্রাণু দানে নিষেধ করেন এবং তা করলে তাকে প্রতিবার দানের জন্য এক লাখ ইউরো (৮৫ হাজার পাউন্ড) করে জরিমানা করা হবে বলে জানান।
মায়ার ওমেনস আওয়ারকে বলেন: “২০১৯ সালের পর থেকেই নতুন প্রাপকদের জন্য দান করা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি কেবল ভাইবোনদের জন্য দান করেছি। আদালতের মামলাটি মূলত অকেজো ছিল কারণ আমি ইতোমধ্যেই সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। আর আদালত আমাকে আগের পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে নিষেধ করেনি”।
শুক্রাণু দাতা হওয়ার কারণ নিয়ে এক আলাপে মায়ার বলেন: “এটা ভুল ধারণা যে আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল। আসলে আমি কলেজে ছিলাম আর আমার এক বন্ধু ছিল বন্ধ্যা ছিল।
“এটা আমার ওপর বড় প্রভাব ফেলে, কারণ আমি তার জীবনে এর প্রভাব দেখেছি। তাই আমি আগ্রহী হই… আর ভাবতে শুরু করি যে আমি কি একজন দাতা হতে পারি?”
শুক্রাণু নেয়া নারীরা কেমন অনুভব করেছেন তা মায়ার বোঝেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কেন তারা অস্বস্তিতে থাকবেন? তারাতো এটাই বেছে নিয়েছে।
তথ্যচিত্রটির পক্ষে ওমেন’স আওয়ারকে হিল বলেন: “ডকুমেন্টারি সিরিজটি তৈরির জন্য আমরা দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছি এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে গবেষণা করেছি। এতে সারা বিশ্বজুড়ে একাধিক পরিবারের মন্তব্য এবং গবেষণা রয়েছে৷ আর তাই তিনি এই সমস্ত পরিবারকে জানেন এবং তারা সবাই খুশি – তা সত্য নয়।
যুক্তরাজ্যের হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি অথরিটি (এইচএফইএ) এক বিবৃতিতে বলেছে যে নেটফ্লিক্স সিরিজটি “দাতার শুক্রাণু নিয়ে গর্ভধারণ করা কিছু শিশুর পরিবারের জন্য চাপ এবং বিরক্তির কারণ হতে পারে”।
রেডিও ৪’র সাথে কথা বলার সময়, এইচএফইএ-র কমপ্ল্যায়েন্স এন্ড ইনফরমেশন পরিচালক, র্যাচেল কাটিং আরও বলেন: “যুক্তরাজ্যে ফার্টিলিটির চিকিৎসা খুব নিয়ন্ত্রিত, এবং বিশ্বব্যাপী সবসময় এমনটা হয় না… যুক্তরাজ্যের মধ্যে, আমাদের কাছে ১০- পরিবারের সীমা নির্দিষ্ট রয়েছে।
“কিন্তু যা ঘটতে পারে তা হল দাতারা যুক্তরাজ্যের বাইরে দান করতে পারে। তাই যুক্তরাজ্যে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও দেশের বাইরে কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু ঘটলে সে বিষয়ে এইচএফইএ’র কোন এখতিয়ার নেই। তাই আমরা নারীদের এইচএফইএ’র লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্লিনিকে যেতে উৎসাহিত করি”৷
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা