শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
আনিসুর রহমান, গুরুদাসপুর
‘ও বউ ধান ভানে রে, ঢেঁকিতে পার দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে, হেলিয়া দুলিয়া।’ ঢেঁকি পাড়ে পল্লি বধূদের এমন গানে মুখরিত থাকতো বাংলার গ্রামীণ জনপদ। ধান থেকে চাল, চাল থেকে তৈরি হতো আটা। এ দু-ই প্রস্তুতের একটিমাত্র মাধ্যম ছিলো ঢেঁকি। নবান্ন এলেই ঢেঁকি পাড়ে ধুম পড়তো নতুন ধানে আটা তৈরির।
নতুন প্রজন্মের কাছে ‘ঢেঁকি শব্দটি’ প্রবীণদের কাছে শোনা শুধুই অতিতের গল্প মাত্র। বাস্তবে আর এখন ঢেঁকি নেই। নেই এর ব্যবহারও। আশির দশক থেকে ক্রমান্নয়ে এ ঢেঁকি বিলুপ্তির পথে। এর আগে এসব ঢেঁকিতে তৈরি করা আটা দিয়ে ঘরে ঘরে প্রস্তুত করা হতো পুলি, ভাপা, পাটি শাপটা, তেলে ভাজা, চিতইসহ নানান ধরনের বাহারি সব পিঠা-পুলি। পিঠার গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। উৎসবমুখর পরিবেশে উৎযাপন করা হতো নবান্ন উৎসব। গ্রামীণ জনপদগুলোতে এখন বিরাজ করছে শহুরে আবেশ। তাই গ্রামে গ্রামে আর ঢেঁকি নেই, নেই পল্লি বধূদের মনমাতানো গান। কিছু জায়গায় নবান্ন উৎসব হলেও পিঠা-পুলির তেমন সমাহার আর চোখে পড়ে না। গ্রাম বাংলার এমন চিরায়ত সব ঐতিহ্য এখন শুধুই স্মৃতি। ঢেঁকিছাটা চাল শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী হওয়ায় তা দিয়ে গ্রামের শিশুদের জাউ তৈরি করে খায়ানো হতো। কিন্তু কাল চক্রের বিবর্তন ও যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে ধান থেকে চাল-আটা তৈরীর একমাত্র মাধ্যম গ্রামীণ ঢেঁকি।
ঐতিহ্যবাহী এ ঢেঁকি বড় কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরী করা হতো। অন্তত ৬ ফিট লম্বা। যার অগ্রভাগের মাথার কাছাকাছি দেড় ফিট লম্বা মনাই। মনাইয়ের মাথায় পরানো লোহার রিং (আঞ্চলিক ভাষায় চুরণ বলা হয়)। চুরণ বার বার যেখানে আঘাত করে নিচের সেই অংশটুকুর নাম গর। সেটিও কাঠের তৈরী। ঢেঁকিতে ধান বা চাল মাড়াই করতে কমপক্ষে তিনজন মানুষের প্রয়োজন হয়। পেছনের লেজ বিশিষ্ট চেপ্টা অংশে এক বা দুইজন পা দিয়ে তালে তালে চাপ দিলে মনাই সজোরে গরের ভেতর ধান বা চালের ওপর আঘাত করে। তবে মনাই ওঠা নামার ছান্দিক তালে তালে আরো একজন নারী আঁকারা ধান চাল মাড়াই করতে সাহায্যে করে। তবে ঢেঁকিতে পাড় দেয়া আর আল্যি দেয়ার মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে ছন্দপতন ঘটতে পারে।
বর্তমান সময়ে কিছু কিছু বাড়িতে ঢেঁকি থাকলেও তা ব্যবসায়িক উদ্দেশ ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেজি চাল থেকে আটা প্রস্তুত করতে নেয়া হয় ৫-৬ টাকা। ঢেঁকির মালিক নিজের লোকবল দিয়েই ওই আটা প্রস্তুত করেন। আধুনিক মেশিনে প্রস্তুত করা আটার তৈরি পিঠাতে স্বাদ না থাকায় কিছু মানুষ টাকা দিয়েই ঢেঁকিতে আটা তৈরি করতে আসে।
স্থানীয় বাসিন্দা আমেনা বেগম (৭০) বলেন, তাদের বাড়িতে ঢেঁকিতে আটা প্রস্তুত করা হতো। সেই আটায় তৈরি হতো বাহারি সব পিঠা। পিঠার স্বাদ মুখে লেগে থাকতো। এখন আর ঢেঁকি নেই। নেই সেই স্বাদের পিঠাও।