তীব্র তাপদহে পুড়ছে দেশ! হিট স্টোকে পাঁচজনের মৃত্যু

আপডেট: এপ্রিল ২১, ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


গেল কয়েকদিন থেকে কমছে না তাপমাত্রা। প্রতিদিনই বাড়ছে তাপমাত্রা। বৈশাখের সূর্য যেন আগুন ঝরাছে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঠা ঠা রোদে তেঁতে উঠেছে পথঘাট। আর দুপুর গড়াতেই তাপমাত্রার পারদ গিয়ে ঠেকছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও ওপরে। সারদেশে হিট স্ট্রোকে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকাল ৩টায় চুয়াডাঙ্গা জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুর ৩টায় যশোর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটির আবহাওয়া দপ্তর এ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। এছাড়াও রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা পাবনা জেলায় চলতি মৌসুমের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

এমন পরিস্থিতিতে জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট। প্রখর রোদ-গরমে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতে মাইকিং করে সতর্কও করা হচ্ছে।তীব্র এই তাপদাহে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকেলে রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় এক বৃদ্ধ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে তার না পরিচয় জানা যায়নি। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে ফকিরাপুল ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবু জাফর জানান, রোগে আক্রান্তের পাশাপাশি প্রচণ্ড গরমের কারণে মৃত্যু হতে পারে। এছাড়াও গাজীপুরের কোনাবাড়িতে হিট-স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মানসিক-ভারসম্যহীন ১ যুবক।

সুকুমার দাস (৬০) পাবনায় নিহত ব্যক্তি

অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্ত সংলগ্ন ঠাকুরপুর গ্রামের কৃষক জাকির হোসেন (৩৩) হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। একইসঙ্গে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় মর্জিনা খাতুন (৬০) নামে ১ নারীর মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা যায় । পাবনা শহরেও হিট-স্ট্রোক করে ১ জনের মৃত্যু হয়। শনিবার (২০ এপ্রিল) পাবনার ঈশ্বরদীর ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ-মাত্রা রেকর্ড করা হয়। সুকুমার দাস (৬০) পাবনায় নিহত ব্যক্তি। শনিবার দুপুরে পাবনা শহরের রুপকথা রোডে একটি চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় হিট স্ট্রোক করেন তিনি। এ সময় আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সুকুমার দাস শহরের শালগাড়িয়ার জাকিরের মোড়ের বাসিন্দা।

চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারে, হিট-স্ট্রোক হতে বাঁচতে যতদূর সম্ভব তাপ এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি-বেশি তরল খাবার খেতে হবে। গায়ে পাতলা কাপড় পরতে হবে। ডায়াবেটিস এবং প্রেসারের রোগীদের রোদে না যায়াই ভালো। এসব রোগী যদি বাহিরে বের হলে সমস্যা মনে করেন তাহলে দ্রুত-ঠান্ডা জায়গায় যেতে হবে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

তীব্র গরমে খেটে খাওয়া মানুষেরা পড়েছেন চরম ভোগান্তি ও ঝুঁকিতে। কর্মজীবীদের দুর্ভোগ বেড়েছে অন্য সবার চেয়ে বেশি। গরমে যেসব রোগ দেখা দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো- ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, জ্বর-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, পানিশূন্যতা, হিট স্ট্রোক ইত্যাদি। এ পরিস্থিতিতে একটু অসতর্কতায় ঘটতে পারে বিপদ। তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হয়ার পাশাপাশি প্রচুর-পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি এবং তরল খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

এদিকে প্রচণ্ড গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে। শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। এরই মধ্যে প্রখর রোদ উপেক্ষা করেই যাত্রী বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন রিকশাচালকরা। সূর্যের তাপ এতই বেশি যে, খোলা আকাশের নিচে হাঁটলেও গরম বাতাস লাগছে চোখে-মুখে। যাত্রাপথে ছাতা মাথায় দিয়ে তাপ থেকে চেষ্টা করছেন অনেকেই। স্বস্তি পেতে শ্রমজীবী মানুষ রাস্তার পাশে জিরিয়ে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ হাতে মুখে পানি দিয়ে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আর শিশু কিশোররা গরম থেকে রেহাই পেতে মাতছে জলকেলিতে।

রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন শওকত আলী। তিনি বলেন, তীব্র গরমের কারণে রিকশা চালাতে কষ্ট হচ্ছে। এত গরম যে মাথার মধ্যে ঘুরিয়ে উঠছে। কিন্তু ভাড়া না মারলে তো সংসার চলবে না। তাই বাধ্য হয়ে এই গরমে রিকশা চালাতে হচ্ছে।

আরেক রিকশাচালক মফিজুর রহমান বলছেন, মানুষ বাইরে কম বের হচ্ছে। যারা বাইরে আসছে গরমের সাথে তাদেরও মেজাজ গরম থাকছে। মানুষের সঙ্গে ভালো করে কথা বলা যাচ্ছে না। রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পদ্মা পাড়ে এসেছি জিরিয়ে নিতে। কিছুক্ষণ পর আবার রিকশা চালাবো।
নগরীর সাহেববাজারের শরবত বিক্রেতা কালাম হোসেন জানান, গরম বাড়ায় তাদের শরবত বিক্রি বেড়েছে। মানুষ পিপাসা মেটাতে ও একটু স্বস্তি নিতে ঠাণ্ডা লেবুর শরবত পান করছেন।

তীব্র খরার কবলে পড়ে নেমে যাচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। নিদারুণ কষ্টে একেকটি দিন-রাত পার করছেন এ অঞ্চলে খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষ। মানুষের পাশাপাশি পশুপাখিও গরমে হাঁসফাঁস করছে। অচল হয়ে পড়েছে এই অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বৃষ্টির জন্য চারিদিকে হাহাকার পড়ে গেছে। দুর্বিষহ গরমে খা খা করছে মহানগরীর বিভিন্ন প্রধান সড়ক। বাড়ছে হিটস্ট্রোক ও ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে অধিকাংশ মসজিদেই চলমান তাপপ্রবাহ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গেল দুই দিন থেকে রাজশাহীতে তাপপ্রবাহ নিয়ে সতর্ক থাকতে মাইকিং করেছে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। তারা এই গরমে হিটস্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচতে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিচ্ছে।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, সামান্য বিরতি দিয়ে থার্মোমিটারে তাপমাত্রার পারদ এবার ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকেছে।

রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের এটিই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল দীর্ঘ ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এর আগে ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল রাজশাহী অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা-রেকর্ড হয়েছিলো ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে ‘বজ্রমেঘ’ তৈরি হলে কেবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা দেবে। আর যদি এটা স্থানীয়ভাবে তৈরি না হয় তাহলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় না। এখন বৃষ্টি না হলে তাপমাত্রা আপাতত তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই ওঠানামা করবে।

দেশে মাঝারি হতে তীব্র-তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ১৮ এপ্রিল হতে ৩ দিনের হিট-অ্যালার্ট জারি করে আবহাওয়া অফিস। এই সময়ে রোদে বের হলে শরীর’র তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। মানব-দেহের তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পেরিয়ে গেলে হিট-স্ট্রোক হতে পারে। এ অবস্থায় অল্প কয়েকমিনিটের মধ্যে মানুষ জ্ঞান হারাতে পারেন। এসব বিষয় বিবেচনা করে আবহাওয়া অফিস হিট অ্যালার্ট জারি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানব-দেহের ৭০ শতাংশই পানি। অতিরিক্ত তাপে শরীরের-জলীয় অংশের পরিমাণ কমে যায়। এসময় সুস্থ থাকতে হলে প্রচুর পানি-পান করতে হবে। লেবুর শরবত, স্যালাইন ও পানীয় সমৃদ্ধ ফল এবং সবজি খেতে হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত তেল এবং মশলা জাতীয় খাবার বাদ দিয়ে চলতে হবে।

প্রয়োজনে বাইরে বের হলে, হালকা রঙের ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে। রোদে বের হওয়ার আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। ধুলোবালির প্রকোপ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হবে। চোখে সানগ্লাস দিতে হবে। এবং ছাতা ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে কালো রঙের ছাতা এড়িয়ে গেলেই ভালো।

হিট স্ট্রোক হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেবে
মাথা ঝিমঝিম করা, বমি, ক্লান্তি ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা এবং মাংস-পেশির খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। এসময় রোগী চোখে ঝাপসা দেখতে পারে ইত্যাদি। দীর্ঘ-সময় রোদে থাকলে হিট-স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ার আশঙ্কা বেশি। এর কোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে থার্মোমিটার দিয়ে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখতে হবে। রোগীর শরীরের তাপমাত্রা ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নামার আগ পর্যন্ত যা যা করতে হবে তা হল শীতল যা ছায়া-যুক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। রোগীর শরীর হতে ভারী জামা-কাপড় খুলে দিতে হবে। গায়ে ঠাণ্ডা পানি ঢালতে হবে। অথবা স্পঞ্জ করে দিতে হবে। রোগীর বগল ও ঊরুর ভাঁজে বরফ বা ঠান্ডা পানিতে ভেজানো কাপড় দিতে পারেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ