মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
গোলাম কবির
বাংলার মানুষের চেতনায় কিছু কিছু তারিখ অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কখনো কখনো অবচেতনে হারিয়ে যায় না, তা নয়। তবে স্মরণীয় ধর্মনিরপেক্ষ দিনগুলো কি ভোলা যায়! যেমন: ১লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর ইত্যাদি। বাংলার মানুষের সাহিত্য-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য তারিখ এগুলো। মাঝে মাঝে কোনো কোনো তারিখ নিয়ে ব্যাপক হৈ-চৈ, আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। কোনটি প্রায় অনুচ্চারিত থেকে যায়। তার অর্থ ভুলে যাওয়া নয়। ‘বিস্মৃতির মর্মে বসি-রক্তে দোলা’ দেয়ার মতো।
সে হলো ১১ই জ্যৈষ্ঠ। জ্যৈষ্ঠকে বাংলার মানুষ মধুমাস হিসাবে সম্মান দেয়। যদিও এর পরিবেশ রুদ্র। এই রুদ্র রূপের মাঝেই অনাড়ম্বরভাবে ক্ষয়িষ্ণু কাজী পরিবারে নজরুলের জন্ম। অনেকটা স্বয়ম্ভূরূপে তিনি বাংলার মানুষের কাছে পরিচিত। জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, সেই আ-কৈশোর, তা বন্ধ হয়নি। মৃত্যু পর্যন্ত। অন্নপ্রাসন, ‘হাতে খড়ি’ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সাথে নজরুলের পরিচয় ছিলো কিনা তা আমাদের জানা নেই। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তাঁর তেমন শ্লাঘনীয় অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়।
পিতার অকাল মৃত্যু, জননীর পিতৃব্যের সাথে সংসার ইত্যাদির জন্য জীবনে সুন্দর বিলাসী কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর ছিলো কিনা, তা বলা কঠিন। আশ্চর্য বোহেমিয়ান নজরুল স্কুল জীবনে গদ্য লেখা দিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সহপাঠী শৈলজার আত্মকথনে তা জানা যায়। আমরা নজরুলকে যেভাবে পেয়েছি তার সবই ব্যতিক্রমী। জীবনের প্রখর রৌদ্রবেলায় ১৯৪১ সালে মুসলিম সাহিত্য সমিতির রজত জুবিলী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি ব্যক্তি জীবনের ব্যর্থতার কথা যেন স্বগতোক্তির মত বলেছিলেন, “পূর্ণত্বের তৃষা নিয়ে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে তোমার মাঝে কেঁদে গেল।” আমরা অকিঞ্চন মানুষ তাকে স্মরণ করি আমাদের জাতীয় মানস গঠনের অকৃত্রিম পুরুষ হিসেবে।
মানুষের মাঝে ভেদাভেদ কেবল কবিতা লিখেই তিনি শেষ করেননি। জীবন দিয়েই সাজিয়েছেন। সংসার পাততে গিয়ে ধর্মের বিধি নিষেধ মানেননি। স্বাভাবিক মাবনধর্মের আস্বাদনে ভালোবাসার জন্ম, সেখানে জাতিধর্ম ইত্যাদির বেড়াজাল তাঁর মানস পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি।
নির্ধারিত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর স্থিতি বেশিদিন ছিলো না। দশম শ্রেণি-পর্যন্ত তাঁর বিদ্যার বহর। তাতে তাঁর জ্ঞানের সীমা টানতে পারেনি।
পরিচয় ও ভালোবাসার সম্পর্ক তাঁর সর্বজনীন রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর কোনো দিক দিয়েই মিল থাকার কথা নয়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশ্বাসযোগ্য বান্ধব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কবিগুরুর গানের সুর তিনি বিকৃত করেননি। কিছু ছিদ্রান্বেষী ব্যক্তি অভিযোগ উত্থাপন করলে রবীন্দ্রনাথ তা মানেননি। ‘গোরা’ উপন্যাস খানা চিত্ররূপ দেবার সময় কোনো কোনো গানের সংযোজনে নজরুলের দূরদর্শিতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এটা কম প্রাপ্তি নয়। আমাদের কাছে অনশন ভান্ডার অনুরোধের চেয়ে কিছুটা বেশি। যদিও টেলিগ্রাম যথা সময়ে নজরুলের হস্তগত হয়নি। আমরা কি ভেবে দেখেছি, কি অপরিমাণ ভালোবাসা নজরুল কবি গুরুর কাছে পেয়েছিলেন।
নজরুল তিরোধন স্বাভাবিক ছন্দে, এনিয়ে বলার কিইবা থাকতে পারে! উষর বাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ার নজরুলকে পূর্ব-বাংলার মাঝখানে স্থাপন; অর্থ হলো নাড়ির টানকে মূল্য না দেয়া। সেকালের প্রশাসনে যাঁরা ছিলেন। তাঁরা হয়তো ভাবেননি, দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন, তার মূল্য তাঁকে কতখানি দেয়া হয়েছে। স্নেহের আধিক্যে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঘরে এনেছিলেন, ভালোবাসা দিয়ে আর শুশ্রƒষা দিয়ে স্বাভাবিক করে তুলতে। তা হয়নি, কেন! এটা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে। তবে আমরা সাধারণ পাঠক ভুলিনি।
এখানেই শেষ নয়, সারাজীবনের ধর্মনিরপেক্ষতা, যাঁর প্রধান ব্রত ছিলো, তাঁকে ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করা কতখানি সমীচীন, চিরকাল ধরে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তার জবাব খুঁজবে!
সাহিত্য সাধনার কাল তাঁর উল্লেখযোগ্য নয়। প্রায় ১৯২০ থেকে ৪১ পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার ক্ষুৎ-পিপাসার জন্য না হলেও চেয়ারের টানে তাঁকে নদীয়ায় অবস্থান করতে হয়েছে। তবে তাঁর সারাজীবনের সাধনা নির্যাতিত মানবতার মুক্তি। এই সাধারণ বেদনা ‘বঞ্চিত-বুকে পুঞ্জিত ব্যথা ফেলাইয়া’ ওঠার অনুভূতি। সেই অনুভূতিকে খাট করা হয়েছে, ধর্মের মোড়কে আবৃত্ত করে। সুতরাং নজরুলের পরিচয় কেবল ইসলামী গান আর গজলেই যেন সীমাবদ্ধ হতে চলেছে। মানুষের পরিচয়ে কতটুকু! বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন এই মানবপ্রেমীকে তাই ঘরে এনেছিলেন, অথচ তার পরিণতি ঘাতকদের মোড়ক পরানো। এটা কি স্বাভাবিক মানুষের কাম্য! আমরা নজরুলকে মানবপ্রেমিক হিসাবে বিচার করলে তাঁকে যথার্থ মূল্য দেয়া হতো।
একথা আমরা স্বীকার করি স্রষ্টার আনুগত্য মানবধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নজরুল তা প্রদর্শন করেছেন নানাভাবে। দুখে-বেদনায় তিনি কোনো কোনো সময় স্রষ্টা সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমরা তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে পারিনা। এছিলো তাঁর নিবিড় ভালোবাসার ব্যক্তিগত প্রকাশ। তাইবলে আমরা তাঁকে ছোটো করবো কেন?
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ