শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
আহমদ সফি উদ্দিন
প্রায় তিন দশক জুড়ে রাজশাহীর সাংবাদিক জগতে যে মানুষটি ছিলেন প্রচ- সরব তিনি মুহম্মদ মনজুরুল হক। রাজশাহী শহর ছাড়িয়ে তাঁর পরিচিতি ছিল বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলেও। নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনয়াবগঞ্জ সহ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার এমন কোন গ্রাম ছিল না যেখানে কেউ না কেউ তাঁকে চিনতেন না। আর এই পরিচিতি ছিল ওপরতলার মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক শ্রমিক রিকসাওয়ালা টমটমওয়ালা পর্যন্ত। এই সর্বব্যাপি যোগাযোগ বা সোর্স এর বিশাল ভা-ার সৃজন করা এদেশের সাংবাদিকতা জগতে বিরল। নাম আর টেলিফোন নম্বর মনে রাখার অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল তাঁর। অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও সাধারণ মানুষকে আপন করে নেবার জাদু জানতেন তিনি।
অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন তিনি। তখনকার দিনে এমন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু শত বাধা পেরিয়ে দুর্গম অঞ্চলে হাজির মনজুর মামু। তানোরে সশস্ত্র নকশালপন্থীদের সঙ্গে সরকারের গোপন সমঝোতার পর আর্মস সারেন্ডার অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু এসপির সাথে জিপে গেলে আসল খবর জানা যাবে না। অনুষ্ঠান হবে সেই সময়ের দুর্গম অঞ্চল মুন্ডুমালায়। অতএব আগের দিন সকালেই চাঁপাই রোডে বাস থেকে নেমে সেখান থেকে মামু-ভাগ্নের দীর্ঘ পদযাত্রা। আমার হাতে ক্যামেরা। পিঠে ব্যাগ জামাকাপড় পানির বোতল। প্রচ- খরা আর রোদে বরিন্দের ধূলিমাখা আঁকা বাঁকা পথ। মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ মাঠের উঁচুনিচু আলপথ পেরিয়ে অবশেষে মুন্ডুমালা। সারারাত ধরে অন্যরকম বাংলাদেশের স্বপ্নদেখা তরুণদের সুখ দুঃখের কাহিনী শোনা। দুপুরে সারেন্ডার অনুষ্ঠানের পর জিপে ফিরে এসে এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট।
বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ছিল মফঃস্বল সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার আদায়ের বিশাল ও একমাত্র ফোরাম। সভাপতি ছিলেন আমার সিনিয়র মিতা ভাষাসৈনিক মুনসীগঞ্জের সফিভাই। আমি প্রচার সম্পাদক। ১৯৮০ সালে ‘গ্রাম বাংলার কল্যাণে নিবেদিত হোক সাংবাদিকতা’ থিম নিয়ে আমরা রাজশাহীতে যে জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করি তাতে সারা দেশের প্রায় একহাজার সাংবাদিক যোগ দেন। এরই ফলে ঢাকার সংবাদপত্র জগতে গ্রাম বাংলার খবর ও সাংবাদিকদের গুরুত্ব দেয়া শুরু হয়। আমি ছিলাম সম্মেলনের আহ্বায়ক। সেই সময় সুভেন্যুরের প্রচ্ছদ করার জন্য ছুটে গেলাম শিল্পী রফিকুন নবীর বাড়িতে। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন কিভাবে কার্টুন দিয়ে আমাদের থিমটিকে আনবেন। আমি বললাম, আপনি মামুর পুরো লিকলিকে লম্বা ফিগারটিই আঁকতে পারেন গ্রামীণ সাংবাদিকের প্রতীকরূপে। আর ঢাকার উঁচু অট্ট্রালিকা হতে পারে ঢাকার তথাকথিত জাতীয় পত্রিকার প্রতীক। তখনকার দিনে আঞ্চলিক খবর ছিল খুবই উপেক্ষিত। এই ভাবটি চমৎকারভাবে নিয়ে আসলেন রনবী। স্মরণিকার নাম দেয়া হলো ‘সংবাদপত্র : স্বদেশে প্রবাসী’। সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মনজুর মামু সেইসময় সারাদেশ চষে বেড়াতেন। আজও তাই সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে সিনিয়র সাংবাদিক মহলে তাঁর রয়েছে বিশাল পরিচিতি। এই ফোরামে তাঁর পরিচিতি মনজুর ভাই।
কিন্তু তিনি কীভাবে সবার কমন মামুতে পরিণত হলেন তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। ১৯৭০ এর নির্বাচন এর আগে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনালগ্নে শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান প্রতিষ্ঠিত ‘সাপ্তাহিক সোনার দেশ’ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার হিসেবে আমার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। এডিটর সরদার আমজাদ এমপি ইলেকশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে শহিদ কামারুজ্জামান এডিটর হিসেবে দায়িত্ব দিলেন সাইদ মামাকে। সেই সময় আমাকে দৈনিক বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে লেখালেখিতে উৎসাহিত করলেন মনজুরুল হক। তিনি তখন ওই কাগজের রাজশাহী প্রতিনিধি। আমি হলাম শহরের সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক। আমার ছোটমামা ভাষা সৈনিক সাইদ উদ্দিন আহমদ বারের অ্যাডভোকেট হয়েও শেষ অবধি সাংবাদিকতাকেই আপন করে নেন। সেই সুবাদে তাঁর সতীর্থ সাংবাদিকরাও আমার কমন মামু। আবার আমাদের বন্ধু ও সতীর্থ সাংবাদিক সৈয়দ-উল আলম কাজলেরও মামা হতেন মনজুর মামু। সেটাও কারণ তার আমাদের মামু হয়ে ওঠার।
তখনকার দিনে সাংবাদিক ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। প্রেসক্লাব তখন চন্ডীপুরের মূল ভবনে। শহর থেকে দূরে। তাই সাংবাদিকদের আডডা ছিল রানীবাজারে বড়মামা কুতুব উদ্দিন আহমদের শাহী ওয়াচ এন্ড অপটিক্যালসএ। শহরের বুদ্ধিজীবী বরেণ্য রাজনীতিবিদরা সেখানে আসতেন নিয়মিত। আমিও থাকি সেই বাড়িতে। কাছেই সিটি কলেজের পাশে বিখ্যাত সেই দোতলা ছোট্ট বাড়িটি মনজুরুল হকের। বাবা অ্যাডভোকেট জহির উদ্দীন বিশ্বাস এর নামফলক আজও বর্তমান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুরশিদাবাদ জঙ্গীপুরের ডাকসাইটে এই মুসলিম লীগ নেতা। মনজুরুল হকের বড়ভাই বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী হাইকোর্টের জাঁদরেল বিচারপতি। (পরে তত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান বিচারপতি ও প্রধান উপদেষ্টা)। কিন্তু ভাইয়ের পরিচয়ে কখনো পরিচিত হতে চাননি মুহম্মদ মনজুরুল হক। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়েই এগিয়ে গেছেন। পারিবারিক মতি নামটিও একসময় হারিয়ে গেছে। তাঁর বড়বোন রাজশাহী বেতারের ‘আবেদা বুবু’ খ্যাত সুলতানা রাজিয়া। ছোটভাই ওয়ালিউর রহমান বাবু আজও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ করে চলেছেন। লিখছেন, বলছেন- সংবাদপত্র বেতারে টিভিতে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম রাজশাহী এসেছেন। সারদায় পাসিং আউট প্যারেডে সালাম নিয়ে সোজা সার্কিট হাউসে ছুটলেন। পেছন পেছন গাড়িতে ছুটে গেলাম আমরা। তিনি দোতলার ভিআইপি বেডরুমে সবে বিশ্রাম নিতে ঢুকেছেন। সেখানে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু মনজুরকে ফেরাতে পারলেন না স্থানীয় নেতারা। সরাসরি ভেতরে ঢুকেই হাত এগিয়ে দিলেন মামু। আমরাও একে একে করমর্দন করলাম। পরিচয় দিলাম। অবাক হলাম। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বিনা দ্বিধায় সম্বোধন করলেন ‘বড়ভাই’ বলে। মামু বললেন, বড়ভাই আমরা ঘরোয়া পরিবেশে আপনার ছবি তুলবো। শুনেই বঙ্গবন্ধু গায়ের সাদা পাঞ্জাবিটি খুলে ফেললেন। বঙ্গবন্ধুর গায়ে সাদা ধবধবে গেঞ্জি। বঙ্গবন্ধু বললেন তোল্ তোরা ছবি। স্টার স্টুডিওর মোতাহার ভাই রেডি। গেঞ্জি পরা অবস্থায়ই কয়েকটা ছবি তুললেন তাঁর। এবার আমরা গ্রুপ ছবি তুলবো বঙ্গবন্ধুর সাথে। হাসিবুল ভাই আমতা আমতা করে বললেন, এবার পাঞ্জাবি পড়লেই বোধহয় ছবিটা ভাল হয়। বঙ্গবন্ধু আবার গায়ে চাপালেন পাঞ্জাবি। বসলেন খাটে। বঙ্গবন্ধুর দুপাশের জায়গা দখল করলেন মনজুর মামু, সিকান্দার আবু জাফর (সংবাদ), আনিসুর রহমান ভাই (ইত্তেফাক, পরে বাংলা একাডেমি, সরদার আমজাদের শ্যালক), শহীদুল ইসলাম ভাই (স্বদেশ), হাসিবুল ইসলাম ভাই (রাজশাহী বার্তা, পরে সরকারি কর্মকর্তা) প্রমুখ। আমি খাটের পেছনের দিকে চলে গেলাম। সোজা উঠে পড়লাম খাটে। হাঁটু গেড়ে বসলাম একেবারে প্রধানমন্ত্রীর পাশ বরাবর। সামনে মুখটা এগিয়ে দিলাম যাতে ছবিতে একেবারে পাশে মনে হয়। পরে মনে হয়েছে ইতিহাসের রাখাল রাজার সঙ্গে এই ছবিটি ঘরোয়া পোশাকেই বোধহয় যথার্থ হতো। (ছবিগুলি সংরক্ষণ করছেন রাবি জনসংযোগ দপ্তরের ফটোগ্রাফার নজরুল ইসলাম)। একজন প্রধানমন্ত্রীর বেডরুমে এভাবে ঢুকে যাওয়া আজ কল্পনা করাও অসম্ভব! যদিও বঙ্গবন্ধু বলেই তা সম্ভব হয়েছিল, তবু স্বীকার করতেই হবে মনজুর মামুর সাহস ছিল বটে! আর তাই অপরিসীম সাহসের সাথে সত্য প্রকাশের জন্য অনেকবার প্রিয়জনদের বিরাগভাজনও হয়েছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সোনার দেশের সবার ওপর জারি হলো রেড ওয়ারেন্ট। সবাই পালিয়ে আশ্রয় নিলো গ্রামে কিংবা দেশ ছেড়ে ভারতে। আমি ও সাইদ মামা পালিয়ে বেড়ালাম এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। বহু চেষ্টা করেও ওপারে যেতে পারলাম না। বর্ডার তখন খুবই বিপজ্জনক। রাণীবাজারে নাজ বোর্ডিং এর সামনে মোসলেম শাহ এর বিশাল সোনার দেশ ভবনটি দখল করলো আলবদর বাহিনী। পরে হলো ইপিকাফ অফিস। ইপিকাফ হলো ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা আনসার বাহিনীর মত স্বল্প প্রশিক্ষিত সাধারণ যুবকদের নিয়ে। সংগ্রামের সাংবাদিক আল আমীন দখল করলেন সামনের বিশাল মোহিনী নিকেতন। প্রেসক্লাব সরিয়ে আনলেন এখানে। কিন্তু কিছুদিন পরই রাতরাতি আলবদররা দখলে নিল এই ভবনটিও। দেশ স্বাধীন হলে প্রেসক্লাবের বিশাল পাঠাগারের বইগুলি উদ্ধার করা হলো আলবদর অফিস থেকে। নতুন করে শুরু হলো প্রেসক্লাবের যাত্রা, ভুবন মোহন পার্ক মোড়ে দোতলায়, ভাষাসৈনিক সাইদ উদ্দিন আহমদকে সভাপতি করে। সিকান্দার আবু জাফর (ছাত্র ইউনিয়ন নেতা), সাইদুর রহমান (সংবাদ, প্রয়াত) ঢাকায় চলে গেলেন। প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান খান (ন্যাপ নেতা), প্রশান্ত কুমার সাহা (নাট্যব্যক্তিত্ব), রুহুল আমিন প্রামাণিক (অধ্যাপক) প্রমুখ। এলেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন ছবি (ঢাকায় ক্রীড়া সংগঠক ও ব্যবসায়ী), আনজুম ফেরদৌস (পুলিশ কর্মকর্তা), সুফি আনোয়ারুল হাসান (অধ্যাপক রাবি), মলয় কুমার ভৌমিক (অধ্যাপক রাবি), লাইলাক শহীদ (অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী), পরিতোষ কুমার কুন্ডু (অধ্যাপক সরকারী কলেজ), মুকুল বর্ধন সুখেন (কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা), রফিকুল আলম (আমেরিকা প্রবাসী), বুলবুল হোসেন (ডাক্তার), বুলবুল চৌধুরী (সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী), আলী মামুদ (দিনকাল), কেএম শহীদুল হক (গ্রামীণ ব্যাংক) সাইদুর রহমান (ভোরের কাগজ) প্রমুখ। রেডিও নিউজ থেকে এলেন হাসান মীর। জমজমাট প্রেসক্লাব। মধ্যমনি পাহারাদার মনজুরুল হক।
স্বাধীনতার পরপরই জেলা পরিষদের মুখপত্র সাপ্তাহিক রাজশাহী বার্তা অফিসটি ছিল আজকের রাজশাহী মিষ্টান্ন ভা-ার গলির ঠিক দক্ষিণে। প্রশাসক ও সম্পাদক হয়ে এলেন এমপিএ হাদিভাই। মনজুরুল হক বার্তা সম্পাদক। আমিও যোগ দিলাম দৈনিক বাংলার পাশাপাশি। শুরু হলো রাজশাহীতে মনজুরুল হকের নেতৃত্বে তরুণ সাংবাদিকদের অভিযাত্রা। সোনার দেশ যার সূচনা করেছিল রাজশাহী বার্তা তা যেন কানায় কানায় পূর্ণ করার চেষ্টা করলো। একের পর এক এলেন আনিসুর রহমান (পরে বাংলা একাডেমীর উপপরিচালক), হাসিবুল ইসলাম (পরে কলেজ অধ্যাপক, সরকারী কর্মকর্তা), নাজমূল হুদা (লে. কর্নেল হাসপাতাল পরিচালক), আবুল হোসেন মালেক (সম্পাদক সোনার দেশ দ্বিতীয় পর্যায়), দীপক দাস (অধ্যাপক, বোর্ড চেয়ারম্যান), কৌশিক আহমদ (আমেরিকায় সাপ্তাহিক বাঙালী সম্পাদক), নিয়ামত আলী (লাইব্রেরিয়ান)। এসময় মনজুরুল হকের ভাগনা সৈয়দ উল আলম কাজল (নির্বাহী সম্পাদক, সোনালী সংবাদ) রাজশাহী বার্তায় যোগ দিলে মামু ডাক আরো জোরালো হলো। আরো এলেন তরতাজা একদল তরুণ। চৌধুরী খুরশিদ বিন আলম (আওয়ামী লীগ নেতা), হিফজুর রহমান বাবুল (লেখক সাংবাদিক ও অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস কর্মকর্তা এবং এখন গবেষক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), অনীল কুমার সরকার (অ্যাডভোকেট), শফিকুল ইসলাম (মুক্তিযোদ্ধা), সুলতানা নাজনীন (অধ্যাপক ও খবর পাঠক), মল্লিকা সরকার (কবি), খাইরুল আনাম (প্রয়াত) সহ অনেকে (যাঁদের নাম মনে পড়ছে না বলে দুঃখিত)।
ভাগনা ও ভাগিনীর সংখ্যা বেড়েই চললো। দুএকজন ছাড়া সবারই প্রিয় সম্বোধন মনজুর মামু। জেলা প্রশাসনের প্রচার পত্রিকার অবয়ব বদলে গেল। মুক্তিযুদ্ধে শহিদ, গণহত্যার নির্মম কাহিনী ছাপা হতে লাগলো। রাজশাহী বার্তা হয়ে উঠলো যেন সত্যিকারের মানুষের পত্রিকা। বেড়ে চললো সার্কুলেশন। এরই মধ্যে অধ্যাপক আজিজুল হক কিছুদিন সম্পাদক থাকার পর ফিরে এলেন পুরনো সম্পাদক সামাদ চাচা (মুহম্মদ আবদুস সামাদ)। ভাগনার তালিকায় তখন যোগ হয়েছে আরো নাম। দায়েম উদ্দিন (ভাইস প্রিন্সিপ্যাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, অধ্যাপক ও প্রধান রেডিও থেরাপি বিভাগ), রেজাউল করিম রাজু (ব্যুরো প্রধান ইনকিলাব), শায়ক আকমল লাবলু (গম্ভীরা শিল্পী, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী), শাহীন আহমদ (অ্যাডভোকেট), এম এ করিম (পরে রাজশাহী বার্তা সম্পাদক) সহ অনেকে। অ্যাডভোকেট সৈয়দ একরামুর রসুল লিখতে শুরু করলেন কলাম।
একসময় রাজশাহী বার্তা ও দৈনিক বাংলা ছেড়ে দৈনিক দেশ পত্রিকার দায়িত্ব নিলেন মনজুর মামু। এই সময় রাজশাহী প্রেসক্লাবও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। নবীণ প্রবীণের সমন্বয়ে চমৎকার এক পরিবেশ। বহুদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেন তিনি। সেই সময় প্রেসক্লাবই ছিল তাঁর জীবন ঘর সংসার। বিপদে পড়ে গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে আসছেন প্রেসক্লাবে। রাজনৈতিক শূন্যতার সেই ক্ষণে প্রেসক্লাব হয়ে উঠেছে অভাব অভিযোগ সমস্যা পেশ করার জনভবন। ঢাকা থেকে নতুন নতুন কাগজ বের হচ্ছে। আর মামু তৈরি করছেন আরো সাংবাদিক। হাতে কলমে শেখাচ্ছেন সংবাদ কৌশল। ১৫ আগস্টের পর সরকারি কোপানলে হুলিয়া মাথায় নিয়ে আরো অনেকে শেল্টার পেলেন এখানে। আবদুল কুদ্দুস (পরে এমপি) এবং নূরুল ইসলাম ঠান্ডু (চেয়ারম্যান, বরেন্দ্র প্রজেক্ট) এর মত অনেককেই মামু শেল্টার দিয়েছিলেন সাংবাদিকতার খাতায় নাম লিখিয়ে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওস্তাদ হারুন উর রশিদ অনেক রাত কাটিয়েছেন প্রেসক্লাবে। প্রেসক্লাব তখন বিভিন্ন ইনডোর গেমস ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নগরীর তরুণদের মাতিয়ে রেখেছে। আজকের প্রেসক্লাবের সাইদুর রহমান তখন তরুণ ছাত্র। টেবিল টেনিস এর চ্যাম্পিয়ন পরপর কয়েকবার।
১৯৭৬ সালে ফারাক্কা লং মার্চের ঘোষণা দিয়েছেন মাওলানা ভাসানী। মাদ্রাসা মাঠ থেকে পদযাত্রা। শেষ কানসাটে ভারতীয় সীমান্ত। সারা দেশ থেকে ট্রেন ভর্তি হয়ে আসছে মানুষ। চট্ট্রগ্রাম, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ সহ শিল্পাঞ্চল থেকে শ্রমিকদের নিয়ে শত শত বাস আর ট্রাক আসছে রাজশাহীতে। ঢাকা থেকে বিদেশ থেকে সাংবাদিকরা ছুটে এলেন রাজশাহীতে। জেলা প্রশাসনের হিমশিম অবস্থা। এই অবস্থায় স্থানীয় সাংবাদিকদের খোঁজ নেয় কে? কিন্তু শেষ অবধি মনজুর মামুর ধমকে প্রশাসন মাইক্রোবাস দিতে বাধ্য হলো স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য। কোন অনুষ্ঠানে গেলে সাংবাদিকদের সম্মানে কোন রকম অবজ্ঞা দেখলে তিনি প্রতিবাদ করতেন। বয়কট করতেন।
সংসার বৈরাগী নির্লোভ মামুর পকেটে দশ টাকা থাকলেই মনে হতো রাজা। আর বিশ টাকা থাকলে মহারাজা। অনেক দিনই চা আর সিঙারা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন সারাদিন। অনেক দিন রাতে পাউরুটি খেয়েই পার করে দিতেন। পকেট ভর্তি থাকলে সবাইকে নিয়ে চলতো খাইদাই। আপদে বিপদে কেউ এসে সাহায্য চাইলে পকেট খালি করে যা আছে তা দিয়ে দিতেন। আগামীকালের কথা ভাবতেন না। এক মানব দরদি মন ছিল তাঁর। মানুষের সমস্যা নিয়ে সাংবাদিকের রিপোর্ট করার কথা। কিন্তু রিপোর্টের বাইরেও তিনি ছুটে গেছেন প্রশাসন, অফিস কিংবা দারোগার কাছে অভিযোগকারীকে নিয়ে। নিউজ হকারদের প্রতিও তাঁর ছিল প্রাণের টান। অনেককেই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন বড় এজেন্ট হিসেবে। মামুর সহযোগিতায় অনেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতি নেতা পেশাজীবী হয়েছেন।
প্রবীণ সাংবাদিকদের পরম শ্রদ্ধা করতেন তিনি। নাটোরের গজেšদ্র নাথ কর্মকার বহুদিন বিছানায় শয্যাগত ছিলেন। যতবার মামু নাটোরে গেছেন গজেনদার বাড়িতে একবার যাবেনই। হাতে কিছু টাকা অথবা পোশাক খাবার। জিয়াউর রহমান সিংড়া আসছেন গ্যাস অনুসন্ধান ড্রিলিং উদ্বোধনে। তথ্য দপ্তর ব্যবস্থা করেছে জিপগাড়ির। পথে অনেক দেরি হয়ে গেল। হাতে সময় নেই। কিন্তু নাটোর পৌঁছে জিপ ঢুকে পড়লো কাপুড়িয়া পট্ট্রির গলিতে মনজুরের হুকুমে। গজেনদার বাড়ি হয়ে সোজা সিংড়া। মুক্তিযুদ্ধের পর শহিদ সাংবাদিক আবু সাইদের পরিবার দারুণ আর্থিক সংকটে। সবাই তাঁদের ভুলে গেলেও মামু ভোলেননি। বারবার ছুটে গেছেন। চেষ্টা করেছেন পরিবারটির জন্য কিছু করার।
নিজের নামের বানান একটু এদিক সেদিক হলেই তিনি আমন্ত্রণপত্র হোক প্রেস রিলিজ হোক বাহককে ফিরিয়ে দিতেন। অথবা সংশোধন করিয়ে তবে গ্রহণ করতেন। এমনকি সরকারি প্রশাসন থেকে সিকিউরিটি পাস কিংবা চিঠি এলেও টেলিফোন তুলে সরাসরি অভিযোগ। নামের প্রথম শব্দ দুটির বহুবিধ বানান হওয়ার কারণে ভুল ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবু মানুষের নামের বানান ভুল লেখা উচিত নয় এই কথাটি তিনি শত শত বার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উর্দুতে ভালো দখল ছিল তাঁর। করাচীর বিখ্যাত জং পত্রিকায় তিনি রাজশাহী থেকে খবর পাঠাতেন। কলেজিয়েট স্কুলে এইটের ছাত্র থাকা কালেই কাগজে লেখা শুরু করেন তিনি। সৈনিক, আজাদীতেও লিখেছেন। মনজুরুল হকের শেষ দিনগুলি কেটেছে কষ্টের মাঝে। অনেক দুঃখ বুকে নিয়ে অভিমান করে বিদায় নিয়েছেন ১১ ডিসেম্বর ১৯৯১। ভিন্নপেশা আর জীবন সংগ্রামের ব্যস্ততায় আমিও তেমন করে সময় দিতে পারিনি। মাফ চাই মামু!
মনজুরুল হক সময়ের এক সাহসী সন্তান। অতিরিক্ত আবেগ হয়তো তাঁকে দিয়েছিল সীমাবদ্ধতা। তবু সাহসী এক সাংবাদিক হিসেবে, অসহায়ের সহায় হিসেবে তাঁর নাম চিরকালের জন্য লেখা থাকবে। তিনি নতুন প্রজন্মকে বন্ধুর মত আপন করে নিয়েছেন। সাংবাদিকতার দীক্ষায় উৎসাহিত করে সাহস জুগিয়েছেন। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের তরুণদের অনেক সামনে ঠেলে দিয়েছেন। তাই মামু অমর আমাদের অন্তরে।