‘দুরন্ত বার্ধক্যে’র উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত: ৭৯ বছর বয়সেও দুরন্ত সাইফুল!

আপডেট: অক্টোবর ১৬, ২০২৪, ৭:৪১ অপরাহ্ণ

মাহাবুল ইসলাম:


‘দুরন্ত শৈশব’ এই শব্দটি যতটা পরিচিত, ঠিক ততটাই বিরল ‘দুরন্ত বার্ধক্য’। কেননা বার্ধক্য ও দুরন্ত দুইটা দুই মেরুর বিষয়। আবার বার্ধক্য কিভাবে দুরন্ত হই? কিংবা বার্ধক্যের সঙ্গে দুরন্ত শব্দের মিশ্রণ ঘটাতে হলে কতটা প্রাণশক্তির প্রয়োজন হয়; তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতেই পারে। তবে এতোসব মাত্রা পরিমাপের বাইরেও দৃশ্যত বার্ধক্যও যে দূরন্ত হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন ৭৯ বছর বয়সের নতজানু শরীরে ভর করা সাইফুল ইসলাম! ‘নানা’ নামের খ্যাতি পাওয়া এই ব্যক্তির এ বয়সে এসে যে প্রাণশক্তির প্রদর্শন করছেন, তা যে কাউকে অবাক করতে পারে। আর একারণেই নাকি নাতিদের সঙ্গেই তার ভাব বেশি। এ বয়সে বন্ধুত্বও গড়েন কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।

প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও তার জীবনবোধের শিক্ষা দীপ্তিমান। হাতের দক্ষতাও দুরন্ত। কথা, শখ, বন্ধুত্ব, দায়িত্ববোধ ও ভ্রমণেও সেই শৈশবের দুরন্তপনা। নজরুলের যৌবনের গান রচনার উক্তি ‘বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আকড়াইয়া পড়িয়া থাকে’- সে বিশেষণেও মেলে না সাইফুলের জীবনবোধের চেতনা। তার জীবনে যা কিছু পুরোনো সবই বস্তুগত। মনচেতনা ও মনোজগতে ১৬ আনা বিদ্যমান দুরন্তপনা।

রাজশাহী নগরীর প্রাণকেন্দ্র নিউ মার্কেট এলাকায় একটি ছোট দোকানে ছেলে বেলা থেকেই সেলাইয়ের কাজ করে আসছেন সাইফুল ইসলাম। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন বিমানচত্বর এলাকায়। চার ছেলে ও এক সন্তানের জনক তিনি। মেয়ে মারা গেলেও চার ছেলের ঘরে এখন নাতি-নাতনি। ছেলেরাও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। বাবা সাইফুল কাজ করুক এটাও চান সন্তানরা। তবে বোঝা হতে চান নি তিনি। ৭৯ বছর বয়সেও একটা টাকার জন্য কারও কাছে হাত পাতেন না।

বুধবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে তার দোকানেই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। চোখে চশমা ছাড়া অন্য কোন শারীরিক সমস্যা নেই তার। এ বয়সেও সুঁইয়ের সুতা এক নিমিষেই প্রবেশ করালেন তিনি। এরপর চলতে থাকলো কাজ। শরীরে বার্ধক্যের ছাপ থাকলেও তার কথা, শখ, জীবনবোধে বিন্দুমাত্র বার্ধক্য ফুটে ওঠে নি। বরং প্রকাশ পেয়েছে দুরন্তপনা।

সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার কর্মজীবনের শুরুটা ছিল সুঁই-সুতা দিয়েই। আমার জন্ম ভারতে। ১৯৬৫ সালে ভারতে দাঙ্গার সময়ে বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই নিউমার্কেটের হাসান টেইলার্সে কাজ শুরু করি। এরপর ছোট ভাইয়ের অনুরোধে লাইফ টেইলার্সে কাজ শুরু করি। এরপর ১৯৭৫ সালে বর্তমান যে দোকানে আছি, সেখানে চলে আসি।

তিনি বলেন, আমার কোন শারীরিক জটিলতা নেই। আমি এখনো একা একাই বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করি। আমার অনেক বন্ধু আছে। প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও যাই। কয়েকদিন আগেই শিবগঞ্জ থেকে ঘুরে আসলাম। সেখানে আমার বন্ধুরা আছে। বয়স আমার মনে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। আমার জীবন একইভাবে একই ছন্দে চলছে। আমার জীবনে তেমন কোন উত্থান-পতনও নেই।
সাইফুল আরও বলেন, আমার সন্তানরা বারবার আমাকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলে। আমার কাছে মনে হয়, বিশ্রাম মানেই অলসতা। আর অলস বসে থাকলেই এক সময় তা তার শরীর ও মনকে দুর্বল করে ফেলবে। আমি স্বাধীনচেতা মানুষ। জীবনকে সহজভাবে চালিয়ে নিতে চাই। কখনো জটিল করবো না।

তিনি বলেন, এই দোকানটি শুধু আমার জীবিকার মাধ্যম নয়, বরং এটি আমার কাছে আত্মসম্মানের। গ্রাহকরা যখন আমার কাছে আসেন, তারা শুধু সেলাই করা পোশাকই পান না, বরং পান আমার হাতের স্পর্শে বোনা ভালোবাসা। প্রতিটি সেলাইয়ের মধ্যে মিশে আছে একান্ত যতœ। এই যতœ আমাকে স্বতন্ত্র করে তোলে। আর আমি প্রতিনিয়তই শিখি। আমার শেখাতে কোন বিরতি নেই। আমৃত্যু শিখে যাবো।
সৎভাবে চলে কবরের বাসিন্দা হওয়ার মনবাসনা জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, জীবনে বাড়ি-গাড়ির স্বপ্ন-প্রত্যাশা কিছুই নাই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন সৎভাবে চলেই কবরে যেতে পারি। সন্তানদেরও বলি, এ হাতের দ্বারা যদি কারও উপকার না হয়; অন্তত কারও যেন ক্ষতি না হয়। সন্তানদেরও নিজের দক্ষতা ও আদর্শে গড়ে তুলছেন জীবনযুদ্ধে দুরন্ত সাইফুল ইসলাম।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ