১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১: পল্টন ময়দানে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ, ইয়াহিয়ার পদত্যাগ

আপডেট: ডিসেম্বর ১৮, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৮ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ঢাকার পল্টন ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।

বাবাসহ দুই মেয়েকে অপহরণকারী বিহারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করে সমাবেশে আনা হয়। গণরায়ের ভিত্তিতে অপহরণকারী বিহারিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এ সময়।
১৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরলে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ শুরু হবে বলে জানানো হয়।

১৮ ডিসেম্বর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ৪টি ট্যাংক বসানো হয়। মূলত হোটেলে আশ্রয় নেয়া পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর ডা. এ এম মালিকের নিরাপত্তার জন্য এই সমরাস্ত্র মোতায়েন করা হয়। ডা. এম এ মালিক আগের দিন বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন এবং নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। পরে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কর্নেলকে হত্যা করতে গেলে মুক্তিবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় ভারতীয় মিত্র বাহিনী গিয়ে তাদের শান্ত করে। এরপর ২ পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়।

১৮ ডিসেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অপূর্ব অনুপ্রেরণা, সাড়ে ৭ কোটি বাংলাদেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ মুক্তি সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের ফলেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।’

এএইচএম কামারুজ্জামান স্বাধীন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠনের মূল লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক চিরকাল থাকবে।’
সংবর্ধনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আমিরুল ইসলাম, কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র মণি সিংহ এবং আব্দুস সামাদ।

১৮ ডিসেম্বর দিল্লিতে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। সমাবেশে লোকসভার সদস্য ও কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা হীরেন মুখার্জি বলেন,’বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে হবে। এটি এখন সমগ্র মানব সমাজের দাবি। সমাবেশে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান বি জি খোবরা গাড়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি না দিলে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক পাকিস্তানি সেনা ও পাকিস্তানি নাগরিকরা যেন পাকিস্তানে ফেরত যেতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা হোক।’

১৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জাতীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। এ সময় নুরুল আমীন সংকটের জন্য গত ৩ বছরের নীতিকে দায়ী করেন।

১৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিণ্ডি, করাচি, লাহোর ও পেশোয়ারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পদত্যাগ চেয়ে তীব্র বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীরা এ সময় ফেস্টুন- প্ল্যাকার্ডসহ বিক্ষোভে পাকিস্তান ভাঙার জন্য ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করেন। পেশোয়ারে ১ হাজারেরও বেশি মানুষ এদিন প্রাদেশিক সরকার ভবনে বিক্ষোভ করে এবং ‘ইয়াহিয়া বেরিয়ে যাও’ শ্লোগান দেয়।

১৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিণ্ডিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের জনৈক মুখপাত্র বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়েছে। সাক্ষীদের জেরাও করা হয়েছে। তবে কখন রায় ঘোষণা করা হবে সে সম্পর্কে আমি জানি না। রায়ের তারিখ খুব দ্রুতও হতে পারে, আবার এ মাসের শেষেও হতে পারে।’

১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ হানাদারমুক্ত হলে হানাদার বাহিনী সেখান থেকে পালিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়। এরপর ১৭ ডিসেম্বর সকালে রাজশাহীতে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনী। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নাটোরে গিয়ে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা। রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে সমাবেত হাজারো মানুষের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন লাল গোলা সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী।