১৯৭১-এর ২৬৫ দিন

আপডেট: ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

রাজিউদ্দীন আহ্মাদ


সময়টা অল্প, ১৬ই ডিসেম্বরকে হিসাব থেকে বাদ দিলে মাত্র ২৬৫ দিন, মাসের হিসাবে প্রায় ৯ মাস, বছর পুরতে আরও ১০০ দিন বাকি কিন্তু কাটিয়েছিলাম যেন যুগ যুগ। তবে, সময়টা সার্থক। ৯ মাসে যেমন একটা মনুষ্য সন্তানের জন্ম হয় তেমনি ১৯৭১-এর ওই ৯ মাসে ধর্মীয়, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়েছিল একটি মানবগোষ্ঠি, জন্ম নিয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশ। পার্থক্য, এখানে একজন মায়ের বদলে একটি নবজাতকের আবির্ভাবের সমস্ত আনন্দ-বেদনার সরাসরি অংশিদার ছিল গুটিকয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস আর শান্তি কমিটির মেম্বর বাদে দেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি জনতা। তাই, এ গল্প উত্তেজনায় ভরপুর Ñ সে উত্তেজনা যেমন বেদনার তেমনি আনন্দের। সেই সময়ের স্মৃতি বিচিত্র Ñ কিছু কিছু স্মৃতি আজও আমাকে আনন্দে উদ্বেলিত করে, কিছু এমনই ভীতিকর যে ভাবলে আজও বিহ্বল হয়ে পড়ি, আবার কিছু বিস্ময়কর। আমি, রাজিউদ্দীন আহ্মাদ, পিতা জালালউদ্দীন আহমাদ, আপনাদের সে সব স্মৃতি থেকে কিছু কিছু শোনাব।
সে সময়ে আমি ছাত্র, ঢাকায় লেখাপড়া করি। সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স ২৫ পার হয়েছে Ñ বর্তমানে (২০১৬) আমার প্রকৃত বয়স ৭৩। ১৯৬৮-তে আমি বিয়ে করি এবং যু™েধর সময় আমি দুই জমজ কন্যার পিতা। প্রকাশ্যে মস্কোপšথী ছাত্র ইউনিয়ন করি, আর গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির একজন ক্যাডার। মনি সিং, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক এবং এমন অনেকেই আমার আদর্শ। মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদে দীক্ষা নিচ্ছি ও দিচ্ছি। বাড়ি রাজশাহী Ñ একাত্তরের ২৫ মার্চ আমি রাজশাহীতে ছিলাম। আজ যে কটা গল্প (ভধপঃং, হড়ঃ ভরপঃরড়হ) আমি বলব তার সময়কাল ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আব™ধ, তাই ২৪ জানুয়ারি-৭ মার্চ আসবে না, আসবে না আরও কিছু চমকপ্রদ গল্প।
এক. বোমাতক্সক
দ্বিতীয় বিশ্বযু™েধর শেষের দিকে ফেলা দু-একটা বোমার শব্দ শুনেছি কি না আমার মনে নেই Ñ তখন অনেক ছোট ছিলাম। তার ২৫ বছর পরে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীতে যখন বোমা হামলা হলো তখন সত্যিই আতক্সিকত হয়ে পড়েছিলাম। বিকট শব্দ, সমস্ত শহর প্রকম্পিত, শহরবাসী সন্ত্রস্ত। প্রাণভয়ে চারিদিকে পালাও পালাও রব। আমরাও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আর থাকবই বা কীভাবে? বোমাটা যে আমাদের বাড়ির খুব কাছেই পড়েছিল! পরের দিনই প্রায় সব কিছু ফেলে রেখে কয়েকটা রিক্সা নিয়ে আমরা, মা-বাবা ও পরিবারের সকলে, রাজশাহী ছেড়ে নওয়াবগঞ্জের অদূরে চামাগ্রামে আমাদের দাদির বাড়ি পাড়ি জমাই। সক্সেগ আমার ১ বছরের ছোট জমজ মেয়েরা।
দুর্বিসহ সেই রিক্সাভ্রমণ ছিল মনে রাখার মতো। চৈত্রের খাঁ খাঁ রৌদ্রে বরেন্দ্র অঞ্চলের লালচে কাঁচা পথ ভেক্সেগ চলা। এ এলাকাটাতে জনবসতি আগাগোড়াই কম, তার উপরে গত-কালের বোমা হামলা! পথ খালি, মানুষ-জনের দেখা পাওয়া ভার। পথের ধারে নাই কোনো দোকানপাট, বাড়ি-ঘরও তেমন নাই। রাজশাহী থেকে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে মাঝেমধ্যে মাঠে কর্মরত দু-একজন কৃষকের দেখা মিলেছে মাত্র। সকলের একই প্রশ্ন, রাজশাহীর খবর কী? পাকসেনারা কতো দূর এগোলো? সকলেরই ভেতরে এক ধরনের চাপা আতক্সক আর উত্তেজনা। কেবল শুরু Ñ কী হচ্ছে আর কীই বা হবে সে সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই। তবু এঁদের দেখেই কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমরা একা নই। গরম আর ক্ষুধায় সকলেই বিধ্বস্ত বিশেষ করে ছোট দুটো বাচ্চা ও ছোট দুই ভাই আর রিক্সাচালকরা। এই দুই ভাইয়ের একজন তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র ও অন্যজন ফোরের। আমরা যারা বড় তারা মাঝেমধ্যেই হেঁটে চলে রিক্সাচালকদের ভার লাঘব করার চেষ্টা করছিলাম। ৩০/৩২ মাইল পথ পাড়ি দিতে আমাদের লেগে গিয়েছিল সারাটা দিন। নওয়াবগঞ্জের কাছাকাছি এসে অবশ্য আমাদের এক আত্মীয়বাড়িতে সামান্য কিছু পানাহার করে নিলে ধড়ে প্রাণ এসেছিল। আমার এক ভাই তখন ঢাকায়, মেডিকেল কলেজের ছাত্র, সেই কেবল আমাদের সক্সেগ ছিল না Ñ কোথায় ছিল তাও জানতাম না। তাকে ফেলেই পালাচ্ছি।
কিছু টাকা-পয়সা ও পরনের কাপড়-চোপড় ছাড়া সক্সেগ আর তেমন কিছুই নিতে পারি নি। কয়েকটা ট্রাংক-সুটকেস রেখে এসেছিলাম আমার এক ব›ধুর বাড়িতে। বাকি আর সবকিছুই বাসায় অনিশ্চয়তার ভেতর রেখে চলে যেতে হয়েছিল। প্রাণ রক্ষার্থ পলায়ন ছাড়া এটা আর কী ছিল!
দুই. দাদির বাড়ি থেকে নানির বাড়ি
অশীতিপর দাদি তখনও বেঁচে ছিলেন। দাদা ছিলেন না Ñ গত হয়েছেন কয়েক বছর হলো। সেই বাড়িতে আর ছিলেন আমার সেজ চাচা ও তাঁর পরিবার। প্রকৃতপক্ষে এটা ওই চাচারই বাড়ি Ñ তাঁকে এই বাড়িটা আমারই উদ্যোগে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল কবছর আগেই। এ নিয়ে অন্য চাচারা আমার উপর অনেক রাগ। তা যা-ই হোক, এখানে তো আর বেশি দিন থাকা যায় না! কদিন থেকেই নানির বাড়ি যাওয়ার সি™ধান্ত হলো। কিন্তু যাই কোন পথে? কোন পথ বেশি নিরাপদ? আমনুরা হয়ে ট্রেনে যাওয়া যায়, কিন্তু সেটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলো। আর যাওয়া যায় গরুর গাড়িতে অথবা নৌকাযোগে। অবশেষে রওয়ানা হলাম জলপথে Ñ আমার দাদির বাড়ি আর নানির বাড়ি দুটোই মহানন্দা নদীর একই পাড়ে, একটা নওয়াবগঞ্জ থানায় আর একটা গোমস্তাপুর থানায় Ñ গ্রামের নাম বোয়ালিয়া। দাদির বাড়ি থেকে নানির বাড়ি যেতে হবে উজানে Ñ ¯্রােতের বিপরীতে। অন্য সময় হলে, এটা একটা উপভোগ করার মতো নৌকা ভ্রমণ Ñ এর আগেও এ পথে দু-একবার গেছি।
একটা নৌকা ভাড়া করা হলো। হপ্তাখানের দাদির বাড়ি থেকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সকলের জন্য কিছু শুকনো খাবার-দাবার, বাচ্চাদের জন্য দুধ ও খাবার পানি বেঁধে নেয়া হয়েছে। এখনকার প্রজন্মের জন্য এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল, তখনকার প্রেক্ষাপট কিন্তু এখনকার থেকে অনেক আলাদা। মোবাইল ফোন তো দূরের কথা ল্যান্ড ফোনও তখন ছিল বিরল Ñ হাতে গোণা। টেলিভিশন তখনও আমাদের দেশে চালু হয় নি, রেডিও-ট্রান্সিস্টারও ছিল সামান্য। বোতোলে পানি বিক্রি হওয়ার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। আর, নৌকা মেশিন দিয়ে চালানোর কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবত না। এ কথাগুলো আরও বিস্তারিত পরে বলা হবে। এখন নৌকা ভ্রমণের কথায় আসি।
এখনকার মতো শীর্ণ ছিল না তখনকার নদী, ¯্রােত যা ছিল তাতেই সেই চৈত্রেও নৌকা বেয়ে যাওয়া বেশ কষ্টকর। আমি জোয়ান মানুষ Ñ মাঝেমাঝে হাল ধরেছি, কখন কখন দাঁড়ও টেনেছি। ওই কাজগুলো করতে আমি পারতাম। কিন্তু অনভ্যাসের টিপ যে এতোটাই চড়চড় করবে, কে জানতো! সারাদিনের ভ্রমণে কয়েক ঘণ্টা দাঁড় টেনেছিলাম কিন্তু তার জন্য শরীরের ব্যথায় ভুগেছিলাম মাসখানেক। যাকগে, সারাদিন ভ্রমণের পরে নানির বাড়ি পৌঁছুলাম, আর অযাচিতভাবে সেখানে গিয়ে পড়লাম আমার এক দূর সম্পর্কের মামার নজরে। তিনি তখন পাক সেনাদের সহযোগী একজন মানুষ, যিনি পরবর্তিতে পিস কমিটির মেম্বরও হয়েছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে আমার মেডিকেলের ভাইটা নানান পথ ঘুরে তার পরিচিত অসহায় একজনকে নিয়ে এসে হাজির হলো। নাম বদরুল, ১৮/২০ বছর বয়সের যুবক, হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আমি, আমার তিন ছোটভাই, বদরুল, আমার এক খালাতো ভাই রবিউল, সব মিলিয়ে আমরা বেশ কজন নানির বাড়িতে- যাদের সন্দেহ করা যেতেই পারে। কিছু দিনের মধ্যেই বিষয়টা পাকমনোভাবাপন্নদের জন্য ভীতিকর হয়ে দাঁড়ালো। এরপর, আমার সেই পিসফুল মামা সকাল বিকাল আমাদের ভাল-মন্দের খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মাঝেমধ্যে সেই অপরিচিত যুবককে নিয়ে আলোচনা। আমরা ভাল আছি কি না তা জানার আগ্রহ দেখে আমাদের অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় নি তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল। তাঁর এই অযাচিত আদরে আমরা একটু অসুবিধার মধ্যে পড়েছিলাম বৈ কি! তবে, তিনিও এখন বেশ অসুবিধার মধ্যে আছেন যদিও অনেক দেরিতে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমি ছিলাম এই গ্রুপটার মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র Ñ আমি ছাড়া প্রত্যেকেই প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গোপনে ভারত থেকে ঘুরে আসত নানান খবর ও সক্সেগ আমার জন্য কিছু সিগারেট নিয়ে। আমি পুরো যু™ধ চলাকালীন অবশ্য এক দিনের জন্যও ভারতে যাই নি।
তিন. রাজশাহী হয়ে ঢাকা ও রাজশাহীতে ফেরা
যু™ধ শুরু হয়ে গেছেÑ ঢাকায় যেতে হবে। নানির বাড়ি কিছুদিন থেকে রাজশাহী যখন একটু শান্ত তখন রাজশাহীতে ফিরে এলাম। পরি¯িথতিটা বোঝার জন্য এলাম ট্রেনে করে। কিন্তু ঢাকা যাই কীভাবে? শেষে, প্লেনে করে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে রওয়ানা হলাম এক দিন। তখন রাজশাহীতে এয়ারপোর্ট ছিল না, প্লেন ধরতে হতো ঈশ্বরদী থেকে। পিআইএরই একটা বাস যেত রাজশাহী থেকে প্লেনের প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে। সেই বাসে করে গেলাম ঈশ্বরদী। কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই ঈশ্বরদী পৌঁছলাম, কিন্তু বাধা আসল প্লেনে বোর্ডিং-এর সময়। উর্দুওয়ালা এক সেপাই আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। এদিকে আমি আবার উর্দু বলতে পারতাম না। তারপরেও আমার আইডি কার্ড দেখিয়ে এবং আমার পরীক্ষা আছে বলে পার হওয়ার চেষ্টা করলাম ভাক্সগা ভাক্সগা উর্দু দিয়ে। তাতেও সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শেষে, আমি পরিবার নিয়ে মুভ করছি দেখে ছেড়ে দিল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঢাকায় পৌঁছুলাম। আমার কমরেডরা তো আমাকে দেখে খুশি। চলল একের পর এক মিটিং Ñ কাজ ভাগ করে নিতে হবে। আমার ভাগে পড়ল, রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুর জেলায় সাংগঠনিক কাজ। ৬ দফা-১১ দফার একগাদা লিফলেট নিয়ে কয়েকদিন পরেই আবার রাজশাহীতে ফিরে এলাম সপরিবারেÑ এবার এলাম ট্রেনে। তখনও ট্রেন চলাচল করছিল কিন্তু পাক আর্মিতে ভরা। আমার স্যুটকেসটা খুলতে বললেই শেষ।
চার. কাজ শুরু
রাজশাহীতে এসেই প্রথমে প্রোগ্রাম করলাম রংপুরে। ট্রেনে রওনা হলাম অল্প দিনের মধ্যেই। বর্তমান প্রজন্ম ভাববে এতো রেল ভ্রমণ কেন! আসলে ওই সময় বাস চলাচল প্রায় করত না বললেই চলেÑ ট্রেনই ছিল চলাচলের প্রধান মাধ্যম। ঢাকা-চট্টগ্রামে টাউন সার্ভিস ছিল কিছু কিন্তু দূরপাল্লার কোনো বাস সার্ভিস ছিল না। আজকের মতো রাস্তাও ছিল না। ¯থানীয়ভাবে বাস চলতো কিছু কিছু। যেমন, এক সময় আমনুরা-চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ রেল যোগাযোগ ছিল না। তখন আমরা চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ আমনুরার মধ্যে চলাচল করতাম বাসে করে। চুয়াডাক্সগা থেকে ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরাও যেতে হতো বাসে করে। এই মহকুমা শহরগুলোতেও রেল যোগাযোগ ছিল না, এখনও নেই। মাগুরা-যশোহর রাস্তাও ছিল না। যেতে হতো ঝিনাইদহ হয়ে প্রাই দ্বিগুণ পথ পাড়ি দিয়ে। এ সব রাস্তা থাকলে কী হতো তা নিয়ে পরে কিছু আলাপ করার ইচ্ছে আছে।
এই ভ্রমণগুলো ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পাকসেনারা তখন অত্যন্ত তৎপর। মানুষখেকো বাঘের মতো তারা তখন রক্তের স্বাদ পেয়ে (২৫ মার্চ দিবাগত রাতে) পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছে। এতোটুকু রিস্কও তারা নিতে চাচ্ছে নাÑ সন্দেহ হলেই ধরে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়েই গুলি করে মেরে ফেলছে। যু™েধর নীতি অনুসরণ করে পাক সেনারা যদি কেবল বিপক্ষ অস্ত্রধারীদের মারত তবে কিছুতেই গড়ে প্রতি সাড়েসাত সেকেন্ডে এক জন করে বাঙালি মারতে পারতো না। প্রকৃত যু™ধ এটা ছিল না, এটা ছিল নিষ্ঠুর একটা অনৈতিক হত্যাযজ্ঞ যা হিটলারকেও হার মানিয়েছিল। আর আমাদের জন্য ছিল প্রাণের দায়ে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা বা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। প্রতিদিন তখন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছিল যদিও আমি ওই দলে ছিলাম না।
ফেরার পথে বগুড়া হয়ে রাজশাহী ফিরে আসলাম। তখনকার প্রধান কাজ ছিল সেই সময়ের পরি¯িথতিটাকে বিশ্লেষণ করে সামনে এগুনোর পথ সম্পর্কে আলোচনা করা। কেন আমরা ওই সময়ে আন্তর্জাতিকতাকে বাক্সবন্দি করে রেখে জাতীয়তাবাদী একটা যু™েধর সক্সেগ যুক্ত হব। পেটি-বুরজোয়া শ্রেণির পার্টি আওয়ামি লীগকে আমরা কীভাবে হ্যান্ডল করব যেখানে শেখ মুজিব অনুপ¯িথত Ñ পাকিস্তানে বন্দী। ৬-দফাতে কি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছু বলা আছে! এমন তরো নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা যা এই রচনার জন্য জরুরি নয়। তাই, অন্য প্রসক্সেগ ফিরে যাচ্ছি।
পাঁচ. লিফলেট শেষ
ঢাকা থেকে যে লিফলেটগুলো নিয়ে এসেছিলাম তা শেষ হয়ে গেল। ওই পরি¯িথতিতে কেবল লিফলেটের জন্য ঢাকা যাওয়া তো আর কাজের কথা নয়। ¯থানীয় কোনো প্রেস থেকে ছেপে নেব ঠিক করলাম। কিন্তু কে ছেপে দিবে? সকলেই ভয় পায়। শেষে কনুমিঞা নামে পরিচিত একজনকে পেলাম। আমার চেয়ে বয়সে বড় এই কনুমিঞা নিজ গুণে ম্যানেজ করে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সমস্ত ছাপার কাজগুলো একচেটিয়াভাবে করতেন। পছন্দ করতাম না মানুষটাকে তেমন, কিন্তু তিনিই শেষ পর্যন্ত আমার সাহায্যে এগিয়ে এলেন Ñ তাঁর প্রেসে বলে দিলেন। আর আমাকে বললেন, আমি যেন রাত ১০টার পর থেকে নিজে বসে থেকে রাতের মধ্যে কাজ শেরে প্রেসেই শুয়ে থাকি এবং সকালে মানুষ চলাচল শুরু করলে বাসায় ফিরে যাই।
চলে গেলাম রাতে কনুমিঞার প্রেসে। হার্ট অব দ্য সিটি, বাটার মোড়েই ছিল তাঁর প্রেস। তখনকার সময়ে সীসার অক্ষর একটার পর একটা সাজিয়ে সাজিয়ে ম্যাটার তৈরি করতে হতো। সময় লাগতো বেশ। রাত একটা-দেড়টা নাগাদ অক্ষর সাজানো শেষ হলো। তারপরে কোনো রকমে একটা প্রিন্ট বের করে ঝটাপট প্রুফ দেখে ফেললাম। মেশিনে সেট করে ছাপানোর কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সকাল। এর পরে ম্যাটারটা ভেক্সেগ ফেলে, টেস্ট প্রিন্ট ইত্যাদিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে সুবোধ বালকের মতো বেঞ্চের উপর শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। বেশ সকালেই লুচি-শবজি এলো। খেয়ে দেয়ে সকাল সাড়ে আটটা নটার মধ্যেই বাসায় ফিরলাম বহালতবিয়তে। এ কাজটাও বেশ রিস্কের ছিলÑ আমার জন্যেও, কনুমিঞার জন্যও। বলাবাহুল্য, কনুমিঞা কিন্তু এর জন্য কোনো টাকা-পয়সা আমার কাছ থেকে নেন নি, উপরন্তু নাস্তা করিয়েছিলেন। কনুমিঞা বন্দুক নিয়ে যু™েধ নামেন নি ঠিকই Ñ তাই বলে কি তিনি মুক্তিযো™ধা ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন।
এরপরে আমার কাজ পুরো উদ্যোমে শুরু হলো। নানার বাড়ি গিয়ে এবারে আরও একটিভভাবে কাজ করলাম। আমার অব্যবহিত ছোটভাই ও খালাতো ভাই মুক্তিযু™েধ চলে গেল। তৃতীয় ভাইটিও বদরুলকে নিয়ে চলে গেছে। আমার সেই পিসফুল মামা পিস কমিটির সক্সেগ আরও ঘনিষ্ট হয়েছেন। তাঁর আপন ছোটভাই আওয়ামী লীগের কর্মি Ñ তিনিও তাঁর খবরদারি থেকে রেহায় পান নি। এই সময়ে জানতে পারলাম পাশের ইউনিয়নের (মহানন্দার এপার-ওপার) আমার আপন ফুফাও পিস কমিটির মেম্বর। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তাঁর কার্যকলাপ কিছুটা ধোঁয়াটে। পাক সেনাদের সক্সেগ সক্সেগ মুক্তিযো™ধাদের সক্সেগও তিনি যোগাযোগ রাখতেন। মুক্তিযো™ধারা তার বাড়িতে এসে খেতো, এমন কি বিশ্রামও নিতো। তিনি অবশ্য এখন আর নেই Ñ গত হয়েছেন ১৬ বছর আগে। আমার নানা চাইতেন, পাকিস্তান টিকে থাক। এটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত মতামতÑ এ নিয়ে তিনি কখনই কোনোপ্রকার বাড়াবাড়ি করেন নি। আমাদেরকে তিনি বলতেন, বাংলাদেশ হলে তোরা বুঝবি হিন্দুরা কী Ñ আমরা দেখেছি। আমার একটু দূরের এক নানা, গরিবুল্লাহ মোহাম্মদ আরিফ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতেন ঢাকাতে। তিনি ও তাঁর বড় ছেলে মিন্টু খাঁটি রাজাকার। এরাই এক পর্যায়ে এসে পাক সেনাদের দিয়ে বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করিয়েছিল এবং শেষে কয়েকটা গ্রামকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের শাস্তি দিবার চেষ্টা করেও দিতে পারি নি। এ এক করুণ কাহিনি!
এই গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার আগেই আমি আবার রাজশাহী ফিরে গিয়েছিলাম। তখন জানতাম না ঢাকার রাজাকাররা এসে গ্রাম পুড়িয়ে দেবে। জানলে অন্তত আমার পুরোনো কয়েনগুলো ওখানে রেখে আসতাম না!
(আগামীকাল সমাপ্য)