শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. নজরুল ইসলাম
বাংলা চমৎকার ও শ্রুতিমধুর ভাষা। পৃথিবীব্যাপি বহু মানুষ বাংলায় কথা বলে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। আমাদের ত্যাগের কথা সবাই জানে। বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎসভূমি হচ্ছে এ দিনটি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন এটি।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে বাঙালি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শ্রেণির মানুষই। এর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বুকের রক্ত ঝরিয়ে মায়ের মুখের বুলিকে সম্মান জানিয়ে তা রক্ষা করেছিল মধ্যবিত্ত্ব, নি¤œমধ্যবিত্ত্ব আর গরিব শ্রেণি। বাঙালির রক্তঝরা এ দিনটি সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান জানিয়েছে ভাষা শহিদদের প্রতি। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহাসিক দিন।
মায়ের মুখের ভাষার সতীত্ব রক্ষায় বাংলার নির্মম মৃত্যুভয় নির্লিপ্ত দুর্জয় সন্তানেরা আপন বুকের রক্তে পিচঢালা কালো রাস্তাকে রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
এই ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্দমনীয় সংকল্পের গভীরে প্রোথিত শেকড়ে রস সঞ্চার করে দেশকে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে।
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই আন্দোলন।
ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত- পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে সব রাজনৈতিক আন্দোলন করেছিল তার মধ্যে ভাষা আন্দোলনই ছিল সবচেয়ে ব্যাপক, তীব্র ও গুরুত্বপূর্ণ।
৭১’র মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। ভাষা আন্দোলনের গভীরে ছিল পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার অন্যতম দাবিদার। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি ও মুসলিম লীগ চক্র তা না করে মুষ্টিমেয় লোকের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। বাঙালি ছাত্র সমাজ, যুব সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী ও আপামর জনসাধারণ এ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনা করে, ইতিহাসে যা ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত।
এ আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বাঙালির ভাষা আন্দোলন বিশ্ব সমাজে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অমর সাক্ষি হিসেবে বিবেচিত।
এভাবেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৫২ সালে এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ লাভ করলো। সারা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে উঠলো। পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রথম শহিদ হলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরো অনেকে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার যাঁদের কথাই আমরা বলি বা ভাবি না কেন তাঁদের আর্থ-সামাজিক পরিচয় কিন্তু এর চেয়ে বেশি নয়। অর্থাৎ কেউ ধনিক গোষ্ঠিভুক্ত নয়। এই শ্রেণিই কিন্তু ১৯৫৪, ৬৬, ৬৮, ৬৯ এ ধারাবাহিক শ্রম, রক্ত আর প্রাণ উৎসর্গ করে নিয়ে এলো ৭১’র চরম মুহূর্ত। ৭১’এর পুরো সময়টার অগ্রভাগে ছিল এ শ্রেণি। পুরো সময়টি ছিল তাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর।
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিল। যার প্রেরণায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত তেজ দীর্ঘ সংগ্রামই হলো মুক্তিযুদ্ধ। তাদের কারণেই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠে জনযুদ্ধ। বাঙালির জীবনধারা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার রূপ সঞ্চালনের প্রচেষ্টায় ৭১’র মুক্তি সংগ্রামই এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মাত্র ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও তা নিছক ৯ মাসের যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধ ছিল অনেক দিনের, লড়াই ছিল বহু পুরনো। বলতে গেলে ১৯৫২ সালের একুশের চেতনায় ভাস্বর ভাষা আন্দোলন বা তার চেয়ে পুরনো ছিল সেই সংগ্রাম। ইতোমধ্যেই আমাদের ভাষা সংগ্রামের ৬৬ বছর পূর্তি হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর ইতোমধ্যে ৪৫ বছর পূর্ণ হয়েছে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটনার পর থেকে বাংলার জনসাধারণ বুঝতে পেরেছিল মিষ্টি কথায় অধিকার আদায় হয় না। এর জন্য রক্ত ঝরাতে হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় একুশের চেতনায় বাঙালি জনসাধারণের আত্মজাগরণ ঘটেছিল বলেই সম্ভবপর হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অবদান রয়েছে।
৬২’র শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন এবং সর্বপরি ১৯৭১ সালের মহান মক্তিযুদ্ধ।
সারা বাংলাদেশে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে সংগ্রামের আগুন। এমন পরিস্থিতি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ইতিহাসের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন-“এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।” তিনি আরো বলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে তবু মুক্ত করে ছাড়বো ইনশআল্লাহ। তিনি উদাত্তভাবে আহ্বান জানান, “ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে ব্যাপক গণহত্যা, ঢাকাসহ সারাদেশে চলে এই হত্যাযজ্ঞ।
গণগত্যার ইংরেজি হলো জেনোসাইড। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশিয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি নরপিশাচরা, প্রায় আড়াই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম বিনষ্ট করেছে। এই গণহত্যার শুরু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, চলে স্বাধীনতা অর্জনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত, মানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা, সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস, কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ, নাটকে মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রামাণ্য চিত্র, মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রপত্রিকা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনন্য প্রেরণার উৎস।
আজ আমরা স্বাধীন বটে, কিন্তু একুশের চেতনার সিঁড়ি বেয়ে অর্জিত দীপ্ত ও অহংকারের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হবে যখন আমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্ত চেতনার সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা লালন করতে হবে। পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তবেই আমরা একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। একুশের চেতনাই ছিল শ্রেণি ও শোষণহীন সমাজ। সব মিলিয়ে আসুন আমরা আমাদের একুশের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশকে বর্ণিল ও অর্থবহ করে তুলি। একুশের চেতনায় সমাজ গড়ি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও টিউটর, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, বাউবিÑ তালন্দ ললিতমোহন ডিগ্রি কলেজ, তানোর