২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

আপডেট: মার্চ ২৫, ২০১৭, ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ

ড. এম হাসিবুল আলম প্রধান



আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির শৌর্য, বীর্য আর অহংকারের প্রতীক। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি বর্বর সামরিক বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ পৈশাচিক বর্বরতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালি মরণপণ সংগ্রাম করেছে। ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মাহুতি আর দু লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো বিশ্ব মানচিত্রে। শোষণ, শাসন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে ৪৭ সালের পর থেকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন তার সফল পরিণতি ছিল মুক্তিসংগ্রামে বাঙালির বিজয় এবং লাল সবুজ পতাকার দেশ বাংলাদেশের আবির্ভাব। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা ৭১’এ এহেন কোনো ভয়াবহ অপরাধ নেই যা তারা করেনি। খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা, দেশান্তরিত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন থেকে শুরু করে সব ধরনের পৈশাচিকতা চালিয়েছে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। তবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বীভৎস দিকটি হলো গণহত্যা ও ধর্ষণ। ৭১-এ সংঘটিত এই গণহত্যার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসলেও এবং নানাভাবে পালন করা হলেও এর ব্যাপকতা ও বীভৎসতা  নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরতে এতদিন কোন সরকারিভাবে ঘোষিত কোন দিবস ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে যেহেতু পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল, তাই এই দিনটিকে সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস পালনের জন্য গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদকে দেশবাসীর পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। এদিন গণহত্যা সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে আবেগঘন বক্তব্য রেখেছিলেন, তা অনেকের মনে দাগ কেটেছে। বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধেরই অংশ। গণহত্যা বলতে বোঝায় জাতি, উপজাতি, বর্ণ বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো একটি জনসমষ্টিকে আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মূল করার লক্ষ্যে পরিচালিত হত্যাকা-কে।  ইতিহাস সাক্ষি হয়ে আছে যে, ৭১-এর গণহত্যার প্রধান শিকার আমাদের দেশের সাধারণ বাঙালি জনতা। ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট ৪টি জেনেভা কনভেনশন যা একটি মৌল নীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত যা স্বাক্ষরিত হবার আগে ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন নামে একটি কনভেনশন গৃহীত হয়। যেখানে গণহত্যার সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক সংজ্ঞা দেয়া হয় যাতে এ ধরনের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন আমাদের দেশে প্রণীত হলে সেখানেও গণহত্যার সুবিন্যস্ত সংজ্ঞা দেয়া হয়। ১৯৯৮ সালে গৃহীত রোম সনদ যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সনদ হিসেবে পরিচিত, সেখানে যুদ্ধাপরাধের বিশেষ সংজ্ঞা ও নির্দিষ্ট পরিচিতি পেয়েছে সেখানেও গণহত্যার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে যা আইসিসি সনদ, জেনোসাইড কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল)১৯৭৩, আইন এর আওতায় গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে। এ আলোচনার আলোকে এটি খুবই স্পষ্ট যে ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী, তাদের সহযোগী বাহিনীসমূহ ও স্থানীয় সাহায্যকারী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা সুস্পষ্ঠভাবে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের আর একটি বিশেষ দিক হলো ব্যাপক গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘পোড়ামাটি’ নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে এবং ব্যাপক গণহত্যা পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয় এবং প্রায় দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রমহানি ঘটে। এ সময় বাংলাদেশ চেতনার পরিপন্থী কিছু মানুষ ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে এ দেশের মানুষকে হত্যা ও নারীদের সম্ভ্রমহানি করতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করে। এই বাংলাদেশ পেতে দীর্ঘ ৯ মাসে যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ব্যাপক আকারে সংগঠিত হয়েছে, তা বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দেয়। কলঙ্কিত করে মানবসভ্যতার ইতিহাসকে। মাত্র ৯ মাসে ত্রিশ লাখ বাঙালি নিধন এর পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে সহজেই বুঝা যায় ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালি নিধনের ব্যাপকতা যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণহত্যার পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তাানি বর্বর বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে যে যুদ্ধ শুরু করে, তা ছিল একটি পরিকল্পিত গণহত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করবার নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়া। ডা. এমএ হাসান রচিত ‘প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জেনারেল টিক্কা ও তার সহকর্মীদের এই বীভৎস গণহত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র ২৫ মার্চের মধ্যরাতেই ঢাকা নগরীতে ঘুমন্ত ও হঠাৎ ঘুমভাঙা প্রায় সাত হাজার নিরীহ বাঙালি নিহত হন। ২৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত মাত্র আড়াই দিনেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তেরো হাজারে। ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা জেলায় নিহতদের সংখ্যা ত্রিশ হাজার পেরিয়ে  যায় এবং যুদ্ধের ৯ মাসে এই গণহত্যাগুলো কখনও থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংগঠিত বিভিন্ন নির্মম গণহত্যাগুলোর স্বাক্ষর বহন করে চলেছে আমাদের দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমি, গণকবর ও গণহত্যা স্পট। এ যাবত গণকবর ও গণহত্যা স্পট আবিস্কৃত হয়েছে প্রায় ৯২০টি। ৮৮টি নদী, ৬৫টি ব্রিজের উপরে হত্যা নির্যাতনের শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। একাত্তরের গণহত্যাযজ্ঞ যে কতটা ব্যাপক, ভয়ঙ্কর ও পরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পাকিস্তানি বাহিনীর অসংখ্য গণহত্যা স্পটের কয়েকটি চিত্র দেখলেই। ডা. এমএ হাসান রচিত ‘প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বাড়িয়া গণহত্যায় একই দিনে পাকিস্তানি আর্মি হত্যা করে দুইশ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে যাঁদের মধ্যে পঁয়তাল্লিশজন ছিলেন নারী। একইভাবে তারা ছাব্বিশাতে সাতজন নারীসহ চল্লিশজন, গোলাহাটে একশজন নারীসহ চারশ তেরজন, বানিয়াচং থানার জিলুয়া-মাকালকান্দিতে ছাব্বিশজন নারীসহ একশজন, কড়াইকাদিপুরে ষাটজন নারীসহ তিনশ একষট্টিজন, হাতিয়া-দাগারকুঠিতে চল্লিশজন নারীসহ তিনশ’জন, সিলেটের বুরুঙ্গাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের একশজন, শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে পঞ্চাশজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া খুলনার চুকনগর, বরিশালের আগৈলঝাড়া, মাদারিপুরের হাওলাদার জুট মিল, বরগুনা জেলখানা, জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ানসহ দেশব্যাপী অসংখ্য গণহত্যা স্পটের বিবরণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সন্নিবেশিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ এবং যুদ্ধ ও নারী গ্রন্থে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ দেশের সেরা সব বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি আর্মি। ৭১’র ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হাত, চোখ ও মুখ বেঁধে যে নৃশংস কায়দায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়, তা গণহত্যার আর একটি ভয়ঙ্কর রূপ। আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণি ও শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করায় ৭১ এ সংগঠিত গণহত্যা বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায়নি।
গণহত্যা ও নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধসহ প্রায় পনেরো রকম মানবতাবিরোধী অপরাধ ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মাটিতে সংঘঠিত হলেও ওইসব ঘৃণ্য অপরাধের একটিও জাতিসংঘ, মানবাধিকার হাইকমিশন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো কর্তৃক সত্যিকার অর্থে বিশ্লেষিত হয়নি। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে এসব অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের শিকার হলে বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয় এবং যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিপুল ভোটে  জয় লাভ করে ক্ষমতায় আসলে তাদের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলছে এবং ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ফাঁসিসহ যাবজ্জীবন কারাদ-ের মত রায় প্রদান করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৬ জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার শুধু এশিয়া মহাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, কিন্তু বিচারের পাশাপাশি গণহত্যার বিষয়টি সরকারকে আন্তর্জাতিক  পরিম-লে তুলে ধরতে হবে, যাতে ২৫ মার্চকে সারা বিশ্বে জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক  গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারিকে যেভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য সরকার কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হয়েছিল, ঠিক তেমনি ২৫ মার্চকে ঘিরে সরকারকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে যেমন ২৫ মার্চকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের পথ সুগম হবে, তেমনি পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক শক্তির উপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য আর কতকাল অপেক্ষায় থাকতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে? বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সাহায্যকারীদের সংঘটিত অপরাধগুলো সরাসরি জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন। এটা খুবই স্পষ্ট যে হাজারো নিদর্শন ও সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। মার্কিন সিনেটর এডলাই স্টিভেনসন বাংলাদেশে তার সফর শেষে মন্তব্য করেন, লোমহর্ষক অত্যাচারের ভয়াবহতা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং বাঙালি সংস্কৃতি নির্মূলের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। ব্রিটেনের লেবার পার্টির সংসদ সদস্য জন স্টোনহাউজ ৭২ সালের ৯ জানুয়ারিতে বলেন, “জেনারেল ইয়াহিয়া খান অবশ্যই একজন দোষী ব্যক্তি”। তিনি অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের জন্য পাকিস্তানিদের বিচারের দাবি জানান। এমনকি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টও পাকিস্তানিদের কর্তৃক যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে সত্যতার স্বীকৃতি দিয়েছে। অপরাধ অপরাধই। অপরাধ সংঘটিত হবার পর কত বছর অতিবাহিত হয়েছে তা বিবেচ্য নয়। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যাপারে স্থান ও কালের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই এটি এখন বিশ্বে সার্বজনীন নীতি, সকল সভ্য রাষ্ট্র এ নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি হত্যাযজ্ঞের ষাট বছর পরেও নাৎসি ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ও হচ্ছে ন্যূরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালে। কম্বোডিয়া ও চিলিতে অনেক পূর্বে সংঘটিত অপরাধের বিচার এখনো চলছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী কর্তৃক সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের  বিচারও এখন সময়ের দাবি। দেশীয় বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে সোচ্চার। বিদেশেও জনমত গড়ে তোলার জন্য প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ও সংগঠন কাজ করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে নিউজার্সির কিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স চালু করা হয়েছে। আমরা যদি ৭১’র গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ঠিকমত আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে পারি, তাহলে বিশ্ব শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে একদিন পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানি যুদ্ধাপারাধীদের বিচার করতে বাধ্য হবে।
২৫ মার্চ যখন দেশে সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস পালন হচ্ছে তখন এই গণহত্যা সংক্রান্ত ডকুমেন্ট ও প্রমাণ সরকারি উদ্যোগে সংগ্রহ করে তা আন্তর্জাতিক পরিম-লে তুলে ধরতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি সরকারি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে গণহত্যা সংক্রান্ত ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে। আমার ধারণা এখনও অসংখ্য গণহত্যার সাক্ষ্য ও প্রমাণ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যার প্রতিবাদের চিঠির মত ডকুমেন্ট আছে যা এ লেখায় উপস্থাপন করা যেতে পারে। ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে ‘একুশে পদক’ প্রাপ্ত আমার বড় চাচা শ্বশুর অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসের একটি চিঠি গণহত্যার এক অনন্য ও অসাধারণ প্রতিবাদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ শামসুজ্জোহা হলে স্থাপিত সেনা ক্যাম্পে ধর্মের নামে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন, ধর্ষণ, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা দেখে অধ্যাপক মজিবর রহমান অতিষ্ট হয়ে ওঠেন। ১০ মে’৭১ মজিবর রহমান তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা নষ্ট করবার এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্মিদের ক্যাম্পে পরিণত করবার জন্য একটি ইংরেজিতে প্রতিবাদ লিপি দেন এবং মুসলমান হয়ে আর এক মুসলমানের উপর পাকবাহিনীর নির্মমতা দেখে নিজের নাম পরিত্যাগ করে নতুন নাম ‘দেবদাস’ ধারণ করেন। প্রতিবাদ লিপি বা চিঠিতে তিনি পূর্বের নাম উল্লেখসহ পরিবর্তিত নাম দেবদাস উল্লে¬খ করেছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ ও গণহত্যাকালীন তিনি যেখানে অবস্থান করবেন তার ঠিকানাও চিঠিতে উল্লে¬খ করা হয়। চিঠিতে তিনি লিখেন ‘ঞযরং রং ঃড় রহভড়ৎস ঃযব ধঁঃযড়ৎরঃু ঃযধঃ ও ধস মড়রহম ঃড় ষবধাব ঃযব ঈধসঢ়ঁং ংরহপব ঃযব টহরাবৎংরঃু ঈধসঢ়ঁং যধং, ধঃ ঃযব সড়সবহঃ, নববহ ফবমৎধফবফ ঃড় ঃযব ংঃধঃব ড়ভ সরষরঃধৎু পধসঢ়. ও সধু পড়সব ঃড় ঃযব পধসঢ়ঁং যিবহ ঁহরাবৎংরঃু ৎবমধরহং রঃং ংঃধঃঁং ড়ভ ংধহপঃরঃু ধহফ ংঃধৎঃং ভঁহপঃরড়হরহম ধং ধ ঁহরাবৎংরঃু রহ ঃৎঁব ংবহংব ধহফ যিবহ …ও যড়ঢ়ব ঃড় নব শবঢ়ঃ রহভড়ৎসবফ ধনড়ঁঃ ংরঃঁধঃরড়হ যবৎব রহ ঃযব ধফফৎবংং হড়ঃবফ নবষড়,ি যিবৎব ও যড়ঢ়ব ঃড় ংঢ়বহঃ ঃযবংব ফধুং ড়ভ পধষধসরঃু, মবহড়পরফব ধহফ ভৎববফড়স সড়াবসবহঃ. চষবধংব হড়ঃব পযধহমব ড়ভ সু হধসব ধহফ হবি হধসব ংযড়ঁষফ নব ঁংবফ রহ ভঁঃঁৎব পড়সসঁহরপধঃরড়হং.’।  যখন চারিদিকে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে সারা দেশবাসী ভীত ও সন্ত্রস্ত, ঠিক তখন পাকিস্তানি গণহত্যার প্রতিবাদে নিজের নাম পরিত্যাগ করে অধ্যাপক মজিবর রহমান এই দুঃসাহসী চিঠি দিয়েছিলেন। প্রশাসনিক তৎপরতায় অতিদ্রুত অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসের চিঠি পৌঁছে গেল পাকিস্তানি সামরিক দপ্তরে। অবশেষে ১২ মে ১৯৭১ এই প্রতিবাদী অধ্যাপকের জীবনে নেমে এসেছিল সেই নির্মম পরিণতি। অধ্যাপক মজিবর রহমান তখন ক্যাম্পাসের পূর্বপাড়ায় তাঁরই সহকর্মী অধ্যাপক সুব্রত মজুমদারের একটি পরিত্যক্ত ফ্লাটে থাকতেন। লাঞ্চের প্রস্ততি নিচ্ছিলেন অধ্যাপক রহমান। জনৈক সামরিক ক্যাপ্টেন এসময় হাজির হলেন জনাব রহমানের শূন্য ফ্লাটে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইবনে আহমদ। রান্নায় ব্যস্ত অধ্যাপক রহমানের সাথে ক্যাপ্টেনের বাক্যালাপের কিছু অংশ প্রয়াত নাজিম মাহমুদের ‘যখন ক্রীতদাস : স্মৃতি’৭১’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। অকৃতদার অধ্যাপক মজিবুর রহমান একাই ছিলেন শূন্য ফ্লাটে। ক্যাপ্টেন প্রশ্ন করলেন : দডযধঃ রং ুড়ঁৎ হধসব? ‘উবাধফধং’ নির্বিকার উত্তর। পত্রের প্রসঙ্গক্রমে আবার ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন :‘ডযধঃ ফড় ুড়ঁ সবধহ নু মবহড়পরফব?’ অধ্যাপকের সাফ জবাব : ‘ঃযধঃ যিরপয ুড়ঁ ধৎব পড়সসরঃরহম ঃযবংব ফধুং.’ ক্যাপ্টেনের মুখের উপর ঠাস করে এমন কথা কেউ তখন ছুঁড়ে দিতে পারে তা কল্পনারও অতীত। তাই ক্যাপ্টেন তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেন : ‘ঈড়সব রিঃয সব. অধ্যাপক রহমান অনুরোধ জানালেন ’‘খবঃ সব যধাব সু ষঁহপয ভরৎংঃ. ও ধস হড়ি পড়ড়শরহম.’। কিন্তু ক্যাপ্টেন তাঁকে সেই সময় দিতে নারাজ : ‘ ঙয ফড়হ’ঃ নড়ঃযবৎ. ও রিষষ মরাব ুড়ঁ ধ নবঃঃবৎ ষঁহপয.’
এভাবে বেটার লাঞ্চ এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রায় চারমাস ধরে তাঁর উপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তার চোখের কোণায় সুচ ঢুকিয়ে, শরীরে  ইলেকট্রিক শক দিয়ে এবং লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে নানা রকম নির্যাতন চালিয়েও পাক হানাদার বাহিনী তার কাছ থেকে কোনো তথ্য বা কথা বের করতে পারে নি। তিনি শুধু বলতেন, অমি একজন বাঙালি, আমি তোমাদের ঘৃণা করি। অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের বিবরণ পাওয়া যায় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খ-’র ৫৭৯ থেকে ৫৮২ পৃষ্ঠায় ‘অধ্যাপক মজিবর রহমান আজ দেবদাস হয়ে বেঁচে আছেন’ শিরোনামে নজরুল ইসলাম বুলবুলের লেখায়। পাকিস্তানি বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনে অধ্যাপক রহমান যখন বদ্ধ উন্মাদপ্রায় তখন ৫ সেপ্টেম্বর’৭১ তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয় নাটোর ক্যাম্প থেকে, পাক সামরিক শাসকের সাধারণ ক্ষমার প্রেক্ষিতে। মুক্তির পর তিনি চলে যান জয়পুরহাটে। অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যধিক নির্যাতনের ফলে এরপর তাঁর কথাবার্তায় দেখা দিতে থাকে অসংলগ্নতা। দেশ স্বাধীন হলেও নির্যাতিত অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস আর  ফিরে আসতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। তিনি আজ বেঁচে থেকেও মৃত। তাই হয়ত জীবন্ত শহিদ বুদ্ধিজীবী এই রকম উপাধি নিয়ে উদভ্রান্ত জীবন যাপন করছেন জয়পুরহাট জেলার এক নিভৃত মহুরুল গ্রামে। অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস-এর উপর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিদুল হক ’কান পেতে রই’ নামে একটি ডকুমন্টারি নির্মাণ করেন যা গণহত্যা হত্যার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে তুলে ধরতে প্রমাণ হিসেবে সহায়ক হবে।
২৫ মার্চ ১ম গণহত্যা দিবসে শুধু সরকার নয়, দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত পরিবার, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কাজ করেত হবে, যেন আমরা অচিরেই ২৫ মার্চকে সারা বিশ্বে জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে পারি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষত দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইন, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিলেবাসে জেনোসাইড সংক্রান্ত কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এমনকি এ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র বিভাগও খোলা যেতে পারে। প্রয়োজনে ইউজিসি এ মর্মে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিঠি পাঠাতে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ” নামে একটি গবেষণাধর্মী একাডেমিক ইনস্টিটিউশন খোলা হয়েছে যা প্রশংসিত হয়েছে। দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘঠিত জেনোসাইডের উপর কোর্স পড়ানো হচ্ছে, তখন আমাদের দেশে পড়ানো এটা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।