৪১ চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলেন এক ডাক্তার, গোটা হাসপাতালে অচলাবস্থা

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৪, ৯:১০ অপরাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক:


খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে বিএনপি নেতা পরিচয়দানকারী চিকিৎসকের কাণ্ডে বহির্বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। ভারপ্রাপ্ত পরিচালকসহ ৪১ জন ডাক্তারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় বহির্বিভাগে এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির দাবি, ওই চিকিৎসক দলের কেউ নন।



খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও ছাত্রদের একাংশ জোর করে উপ-পরিচালককে পদত্যাগ ও ৪১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার ঘটনায় বহির্বিভাগের সেবা প্রায় বন্ধ রয়েছে। অবাঞ্ছিত ঘোষিত ডাক্তাররা হাসপাতালে আসেননি। এই পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা।

এদিকে গতকাল পদত্যাগ ও ডাক্তারদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের একাংশকে নিয়ে নেতৃত্বদানকারী কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসক ডা. মোস্তফা কামালকে বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। তিনি নিজেকে বিএনপিপন্থি হিসেবে দাবি করেছেন। বিএনপির নেতারা দাবি করেছেন, ওই চিকিৎসক বিএনপি বা ড্যাবের কোনও কমিটির সদস্য নন। হাসপাতালে এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন নগরীর ১৭নং ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক ফারুক বলেন, ডা. মোস্তফা কামাল বিএনপির কেউ নন। কিন্তু ওনাকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে বিএনপির কোনও সম্পৃক্ততা নেই।
তিনি জানান, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম মনার নির্দেশ পেয়ে তিনি হাসপাতালে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে। কিছু বিভাগে চিকিৎসা প্রদান করছেন ডাক্তাররা। অবাঞ্ছিত ঘোষিত কোনও চিকিৎসক হাসপাতালে আসেননি। তাদের সহকারীরা জানিয়েছেন, চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেই হাসপাতালে আসেননি।

রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, গুরুতর অসুস্থ রোগী নিয়ে হাসপাতালে এসে সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) খুলনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা. আক্তারুজ্জামানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এ সময় আরও ৪১ চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেন কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোস্তফা কামাল। ফলে বুধবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে হাসপাতালে আসেননি অনেক চিকিৎসক।

হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগের ২০২নং রুমের প্রীতম চক্রবর্তী, ২০৯নং রুমের ডা. হিমেল সাহা, ২০৭নং রুমের ডা. অনিরুদ্ধ সরদার, ২০৫নং রুমের ডা. শেখ তাসনুভা আলম, ২০৪নং রুমের ডা. সুব্রত কুমার মণ্ডল, ২০৩নং রুমের আরএমও ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার, ২১১নং রুমের ডা. দীপ কুমার দাশ, ২১২নং রুমের আরএমও ডা. সুমন রায়, ১০৩নং রুমের ডা. তড়িৎ কান্তি ঘোষ, ৩০৮নং রুমের ডা. নিরুপম মণ্ডল, ২০৪নং রুমের ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন, ৪১১নং রুমের ডা. রনি দেবনাথ তালুকদার, ৪১০নং রুমের ডা. মিথুন কুমার পাল, ৪১২নং রুমের ডা. জিল্লুর রহমান তরুণ, ১০৫নং রুমের চিকিৎসক শিবেন্দু মিস্ত্রিসহ প্রায় ২০ জন চিকিৎসক অনুপস্থিত।

নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় তারা হাসপাতালে আসেননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া আন্তবিভাগে রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার ও কনসালটেন্টসহ আরও ২১ জন চিকিৎসক অনুপস্থিত। এতে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীরা সেবা না পেয়ে ফেরত যাচ্ছেন।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা থেকে আসা আরেফিন বিল্লাহ বলেন, বাড়ি থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি সকাল ১০টার দিকে। দুপুর গড়িয়ে এলেও চিকিৎসক আসেননি। আমি শিক্ষকতা করি, আজ ছুটি থাকায় এসেছি। অথচ এসে চিকিৎসক দেখাতে পারিনি। শুধু আমি নই, অন্য রোগীরাও ফিরে যাচ্ছেন।

হাসপাতালে আসা রোগী সাদিয়া আফরিন বলেন, ডাক্তার দেখাতে এসেছি সেই সকালে। এখনও দেখাতে পারিনি। আজ তো দেখাতে পারিনি, আগামীকালও ডাক্তার আসবেন কিনা জানি না।

ডাক্তারদের রুমের সামনে রোগীদের সিরিয়াল দেখভালের দায়িত্বরতরা বলেন, সকালে আমরা এসেছি। এসে দেখি চিকিৎসকরা আসেননি। ফোন করলে তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন, এ জন্য আসেননি। রোগীরা আসছেন, আবার ফিরে যাচ্ছেন।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুমন রায় বলেন, গতকাল ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের দাবির বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। এ সময় ডা. মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে কিছু শিক্ষার্থী এসে আমাদের ঘিরে ধরে। পরে তারা উপ-পরিচালককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। আর আমাদের প্রায় ৫১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। ফলে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় আমরা আসিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, গত ১৬ বছর বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তারা নিগ্রহের শিকার হোক আমরা চাই না। আমরা জানতে পেরেছি, অনেকেই ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাচ্ছেন। একজনকে সরিয়ে দিয়ে আরেকজনকে বসানোর একটা ফায়দা লোটার চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, এখানে বারবার একজন ডাক্তারের নাম উঠে আসছে। তিনি হলেন কার্ডিওলজি বিভাগের ডা. মোস্তফা কামাল। ওনাকে আমরা পাইনি। ওনার বিষয়েও আমরা তদন্ত করে দেখছি। কাউকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া আমরা সমর্থন করি না। কাউকে সরাতে হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তদন্তসাপেক্ষে ধাপে ধাপে করতে হবে। একদিনেই ৪০ জনকে সরিয়ে দেবো, এতে চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হবে। পুরো খুলনা বিভাগের ওপর প্রভাব পড়ছে। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলছি, স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গেও কথা বলবো। এখানে দুটি পার্ট রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা। শিক্ষা পার্টের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এই কাজটি করেছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগে শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার নেই, এখানে খুলনা বিভাগের নাগরিক ও রোগীদের অধিকারটাই বেশি। আমরা এখানে সুষ্ঠু সমাধানে একটি ভূমিকা রাখতে চাই।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) হত্যাচেষ্টা, হুমকি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অভিযোগ এনে হাসপাতালের পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, আরএস, আরএমও, রেজিস্ট্রারসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পোস্টের ৪১ চিকিৎসকের একটি তালিকা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওই সিনিয়র চিকিৎসক দুটি কাগজে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আক্তারুজ্জামানের স্বাক্ষর গ্রহণ করেন। আগস্টে আন্দোলন চলাকালে ডা. মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় সোনাডাঙ্গা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী চিকিৎসক।
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ