অর্থহীন ভালোবাসা, অন্ধ

আপডেট: জুলাই ৫, ২০২৪, ১:০০ পূর্বাহ্ণ

অর্থহীন ভালোবাসা, অন্ধ
সালাম হাসেমী:


দুলা রিক্সা থেকে নেমে বোশেখের দগ্ধ দুপুরে পায়ে হেঁটে মতিঝিল ‘রায়হান গ্রুপ’ অফিসের সামনে এসে থেমে যায়। দুলার ফর্সা গায়ে ব্লাউজের ম্যাচ করা আকাশি রঙের শাড়ি, কানে ঝুল-মাকড়ি দুল, গলায় গোল্ডের চেইন, বাম হাতের অনামিকায় হীরের আংটি, ঠোঁটে আকাশি রঙের লিপস্টিক। রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে অফিসের সাইন বোর্ডটা কিছুক্ষণ পড়ে। বেশ কয়েকবার পড়ে। তারপর মনে মনে ভাবে এটাই রায়হানের কোম্পানী হবে। এ অফিসে মনে হয় রায়হান বসে। রায়হানের সাথে দেখা করতে হলে এ অফিসেই যেতে হবে। অফিসটি দশতলা বিলডিং। অফিসের বিশাল বড় গেট। গেটের সামনে দারোয়ান দাঁড়ানো। দুলা ধীরে ধীরে গেটের সামনে যায়। দারোয়ানের হাতে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, -আপনাদের কোম্পানীর মালিক রায়হান সাহেবের হাতে এ কাডটি দিয়ে বলুন যে একজন ভদ্র মহিলা অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে আছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য।

-আমাদের সাহেব যখন তখন কারো সাথে দেখা করেন না। আপনি পরে আসুন।
– দেখুন, আপনি গিয়ে আমার কথা বলুন, আমি তাঁর বিশেষ পরিচিত। তাঁর সাথে আমার দেখা করা বিশেষ প্রয়োজন। এই ভিজিটিং কার্ড দেখলেই তিনি আমাকে চিনবেন।দারোয়ান কয়েকবার দুলার দিকে তাকিয়ে মাথা হতে পা পর্যন্ত পরখ করে সাহেবের পিয়ন জলিলকে টেলিফোনে ডাকল। জলিল এলে তার হাতে দুলার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, এ কার্ডটি বড় স্যারের কাছে দাও। এ ভদ্র মহিলা স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। জলিল কার্ডটি নিয়ে স্যারের হাতে দিলে রায়হান সাহেব বেশ কয়েকবার কার্ডটি পড়লেন তার পরে অস্পষ্ট করে কয়েকবার দুলা শব্দটি উচ্চারণ করে জলিলকে বললেন, ‘আসতে বলো’। জলিল গেটে এসে দুলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আসুন ম্যাডাম স্যার আপনাকে ডেকেছেন’

দুলা জলিলের পিছু পিছু হেঁটে লিফটে ছ’তলায় গিয়ে রায়হান সাহেবের রুমে প্রবেশ করলে রায়হান সাহেব চক্ষু তুলে ভালো করে তার অফিসের আগন্তুক মহিলাকে ভালো করে পরখ করে ধীর গলায় বললেন, বসুন। অপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। আপনার পরিচয় দিন।
-আমি দুলা। আমার বাড়ি কাশদোলা গ্রামে। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। আমার বাবা সাজ্জাদ চৌধুরী। আমি তার একমাত্র মেয়ে।
-আপনর বাড়ি কাশদোলা গ্রামে ?
-না। আমার বাড়ি কাশদোলা গ্রামে নয়। আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না। আমার কাছে কি জন্য এসেছেন ?
-আপনি আমাকে চিনেও না চেনার ভান করছেন। আপনি কাশদোলা গ্রামের সাজ্জাদ চৌধুরীকে চেনেন না ? আপনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন।
-রাগবেন না। কি খাবেন, ঠা-া না গরম ?
রায়হান সাহেব কলিং বেল টিপলেন। পিয়ন জলিল আসল। বললেন, -মেহমানকে একটা ঠান্ডা এনে দাও।জলিল একটা ঠান্ডার বোতল প্লেটে করে মেহমানের সামনে রাখলেন।
-বলুন, আর কি বলবেন ?
-না। আপনার সাথে আমার কথা বলার আর ইচ্ছে নেই। কারণ আপনার জন্ম যে কাশদোলা গ্রামে। যে গ্রামে আপনার জন্ম। যেখানে আপনার শৈশব কাল, কিশোর, যৌবন কাটলো আজ আপনি সে কাশদোলা গ্রাম চিনছেন না! ধন্যবাদ আপনার রূপ বদলকে। ধন্যবাদ আপনার জন্মভূমি ভুলে যাওয়াকে। যে তার জন্মভূমিকে ভুলে যায়, তার ভিতরে তো দেশাত্ম বোধ নেই। সে দেশের পরগাছা।

-চিনি না তা নয়। দুলা, কাশদোলা গ্রাম, সাজ্জাদ চৌধুরী এরা আমার স্মৃতি। দুলা ও সাজ্জাদ চৌধুরী আমার হৃদয়ের মাঝে ক্ষত। এ ক্ষত কখনো সেরে উঠার নয়। এ ক্ষত আজীবন থাকবে। তুমি আমি কাশদোলা গ্রামে একই প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। সেই শৈশব কাল হতে আমরা দুজন দুজনাকে ভালোবাসতাম। তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার বাড়ির আম, জাম, কাঁঠাল ও নানা ধরনের খাবার এনে আমাকে খাওয়াতে। আরো কত কি। তা বলে শেষ করা যায় না। দুজনে প্রাইমারি পাস করে হাই স্কুলে উঠলাম।

এসএসসি পাস করে আমরা জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হলাম। এইচএসসি পাস করে তুমি জেলা শহরের কলেজে অনার্সে ভর্তি হলে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদিকে তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দিতে চাইলেন। তুমি বিয়ে করতে রাজি না হলে তোমার বাবা খোঁজ খবর নিয়ে যখন জানতে পারলো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমাদের দুজনের প্রেমের কথা শুনে তিনি দেখলেন যে আমি হলাম গরীব দিনমজুরের ছেলে আমার সাথে বিত্তবান চৌধুরী বংশের মেয়ের সাথে বিয়ে হতে পারে না।

তখন তিনি নতুন ফন্দি আটলেন। আমার সাথে তোমার বিয়ে দিবেন বলে তোমাকে ঢাকা থেকে তোমার বাবা বাড়িতে নিয়ে আসলেন। তোমার বাবার সাথে আমাকে দেখা করতে বললে তুমি। আমি দেখা করলাম। তিনি আমাকে শাসিয়ে বললেন তুমি দুলাকে ভুলে যাও। নতুবা তোমাকে আজীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। কোন দিন হাজতখানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমি তাঁর কথায় রাজি হলাম না। আমি বললাম যে আমি দুলাকে ভুলতে পারবো না। তার দুদিন পরেই আমি হত্যা মামলার আসামী হয়ে জেল খানায় চলে গেলাম।

জেলখানা হতে শুনতে পারলাম যে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। সাত বছর হাজত খাটার পরে উক্ত মামলা হতে খালাস পেলাম। খালাস পেয়ে আমি আর বাড়ি গেলাম না। সরাসরি ঢাকায় চলে এলাম। পড়া লেখা আর হলো না। মনে মনে ভাবলাম যে টাকা আয় করে জীবনে বড় ধনী হতে হবে। সাজ্জাদ চৌধরীর চেয়ে বড় ধনী। ছোটখাটো ব্যবসা করতে শুরু করলাম। ছোট ব্যবসা করতে করতে আমি বড় ব্যবসায় পা রাখলাম। এখন আমি বড় ব্যবসায়ী।
-আমি তো আর ইচ্ছে করে বিয়ে করিনি। বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।
-আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি পালিয়ে বিয়ে করতে চাইলে না। এখন তো তুমি সুখেই আছো। আমার দুঃখ দেখার জন্য আমার অফিসে চলে এসেছো।
-তুমি তো শুধু আমার সুখই দেখলে। জানতে চাইলে না আমি কেমন আছি। বলে দুলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তখন রায়হান সাহেব দুলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,

-তুমি আসলে কেমন আছো ? তুমি কাদছো কেন ?
-বিয়ের দুবছর পরে আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মাারা যায়। তার এক বছর পরে আমার বাবা মারা যায়। তার কিছুকাল পরে দেখলাম বিধবার একাকী জীবন ভালো লাগছে না। তখন আমি আমার মামার সহায়তায় ঢাকায় একটা স্কুলে চাকরি পাই সে চাকরি করে জীবন নির্বাহ করছি। ঠিক সে মুহূর্তে রায়হান সাহেবের পিএস নবিতা এসে বলল,

-স্যার ম্যানেজার স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন। জেনারেল মিটিং শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে যেতে বলেছেন।
-ম্যানেজার সাহেবকে বলো, আমার শরীর আজ ভালো লাগছে না। আজ মিটিং হবে না। আগামী কাল হবে। আমি এখন বাসায় যাবো। ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলো। দুলা চলো আমার বাসায়। কয়েক দিন বেড়াবে। দুলা রায়হান সাহেবের সাথে তার গাড়ি করে বাসায় চলে গেল। রায়হান সাহেব পোশাক বদলিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসলেন। দুলাও হাত মুখ ধুয়ে করে খাওয়ার টেবিলে এসে বসল। বাড়ির বাবুর্চি খাবার পরিবেশন করল। খাওয়া শেষে রায়হান সাহেব দুলাকে একটা ঘর দেখিয়ে সেখানে বিশ্রাম নিতে বলল। নিজে গিয়ে দুলা সে ঘরে বিশ্রাম নিতে লাগল। দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। রোদ পড়ে আসলে দুলা ও রায়হান সাহেব ছাদে গিয়ে বসল। তখন দুলা রায়হান সাহেবকে প্রশ্ন করল,
– বাবুর্চি খাবার দিচ্ছে যে, রায়হান তোমার স্ত্রী কোথায় ?
-আমি তো বিয়েই করিনি।
-কেন বিয়ে করোনি ?
-আমি যদি এখন বিয়ে করতে চাই তা হলে এদেশের এক জন ধনী লোক আমাকে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু এই আমি যদি গরীব হই তা হলে ওই ধনী লোক আমার সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে না। সেই জন্য আমার ধারণা মানুষ কখনো মানুষকে ভালোবাসে না। মানুষ ভালোবাসে তার অর্থ-সম্পদকে। অর্থ-সম্পদ না থাকলে তাকে কেউ ভালোবাসে না। ভালোবাসা হলো, অর্থের মূল্য। অর্থ ছাড়া শূন্য হৃদয়ের ওপর ভালোবাসা দাঁড়াতে পারে না। আমার যদি প্রথম জীবনে অর্থ-সম্পদ থাকতো তাহলে তোমার সাথে আমার বিয়ে হতো। আমাদের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেতো না। আমাাকে তোমার বাবা মিথ্যা মামলায় সাতবছর হাজত খাটাতো না। যে কারণে আমি বিয়ে করতে চাই না। এ জগতে যতদিন বেঁচে আছি ততদিন শুধু অর্থ আয় করে যাবো। শুধু আমাকে কেউ ভালোবাসে না। ভালোবাসে আমার অর্থ-সম্পদকে। অর্থশূন্য হৃদয়ে যদি ভালোবাসা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো তাহলে আমি একজন নারীকে বিয়ে করে ঘর বাঁধতাম।

ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ছাদের ওপর আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। রায়হান সাহেব ছাদ থেকে নিচে নামবেন এমন সময় দুলা রায়হান সাহেবের হাত ধরে বলল,
-শোনো রায়হান, দোষ যা করার আমার বাবা তার অর্থের অহংকারে করেছে, আমি তো করিনি। সব দোষের কথা ভুলে গিয়ে এখন আমরা সংসার করতে পারি না।

-না দুলা। তা হয় না। তখন আমি অর্থহীন শূন্য হৃদয়ে তোমার হৃদয়ের ওপর দাঁড়াতে পারোনি, এখন আমার অর্থ হয়েছে, এ অর্থই হলো একজন মানুষের ভিত। এখন আমার ভিত হয়েছে, এ ভিতের চাহিদা সকলের কাছে। ভিতের চাহিদা সকলের থাকবে কিন্তু এখান আমি কাউকে এ ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেব না। ভালোবাসা দাঁড়ায় ভিতের ওপর। আমার হ্নদয়ে এখন আর ভালোবাসা নাই। আমার ভালোবাসা তোমার বাবার অর্থের চাপায় দলিত হয়ে মাারা গেছে।
রায়হান সাহেবের কথা শুনে দুলা আঁচলে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর অনেকক্ষণ রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল।