অ্যাটর্নি জেনারেলের তৃপ্তির ঢেকুর এবং আয়কর ফাঁকির মহোৎসব

আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০১৬, ১১:৫১ অপরাহ্ণ

ফিকসন ইসলাম
সদ্য সমাপ্ত দেশব্যাপি আয়কর মেলার পঞ্চম দিনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা এবং দেশের আইনজীবীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর সভাপতি মান্যবর মাহবুবে আলম আয়কর মেলায় পরিদর্শনে গিয়ে আবেগপ্লুত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন- ‘মানুষ এখন স্বতস্ফূর্তভাবে আয়কর দেয়। রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও এ রাজস্বভবনের নিজস্ব আঙ্গিনায় আয়কর মেলায় তিনি গর্বভাবেই এই মন্তব্য করেন। সারাদেশব্যাপি ১ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর মেলা আয়োজন করে জাতীয় রাজস্ববিভাগ বা এনবিআর। দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি ৬৪টি জেলা ও ১৪টি উপজেলায় আয়কর মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয়ভাবে আয়কর মেলায় অ্যাটর্নি জেনারেল এর কার্যালয়ের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (ঘইজ) পার্টনারশিপ ডায়লগ (চধৎঃহবৎংযরঢ় উরধষড়মঁব) অনুষ্ঠানে তিনি আত্মতৃপ্তির সাথে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরে অনুষ্ঠিত আয়কর মেলার মূল প্রতিপাদ্য ছিলেন ‘সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ভাই-আয়কর দেয়ার বিকল্প নাই’- নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ গড়তে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যই হচ্ছে নিয়মিতভাবে আয়কর প্রদান করা। অ্যাটর্নি জেনারেল ওই অনুষ্ঠানে আরো বলেন ‘আমি দেখেছি ছোট বেলায় মানুষ কর দেবার সময় পালাতো, কিন্তু এখন কর দেবার সময় মানুষ পালাচ্ছে না, তারা বেশ উৎসাহ নিয়েই কর দিচ্ছে। পাশাপাশি অন্যকে কর দেবার পরামর্শ দিচ্ছে, জনগণ বুঝতে পারছে কর না দিলে দেশ উন্নত হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন কর দেবার সময় ভিড় হলেও মানুষ কর দিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে কর দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখন বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে কর আদায় করা হচ্ছে। মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ যেমন হার্ট (ঐবধৎঃ) তেমনি একটি দেশের হৃৎপি- হলো রাজস্ব, রাজস্ব হলো উন্নয়নের হৃৎপি-।’
মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব অ্যাডভোকেট মাহবুব আলম অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আশা জাগানিয়া। জনসাধারণ এতে অবশ্যই কর দিতে উৎসাহিত হবেন এবং হচ্ছেন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কারা নিয়মিতভাবে কর দিচ্ছেন। এরা দেশের একটা বড় অংশ জনগণ, এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মহোদয় সেই জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নিয়মিতভাবে কর প্রদানের জন্য। দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাঁদের অংশীদারিত্বের জন্য।
মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব মাহবুববে আলম এর বক্তব্য যেদিন দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হলো সেদিন একটি ভয়াবহ সংবাদও গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সমূহে প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম হচ্ছে “কর ফাঁকির শীর্ষে পেশাজীবীরা”- সংবাদটা শুরু হয়েছে এভাবে, দেশে আয়কর ফাঁকিতে একাট্টা আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানা ধরনের পেশাজীবী। এদের মধ্যে ব্যাংকররা কিছুটা স্বচ্ছ করদাতা হলেও আয়কর ফাঁকির শীর্ষে রয়েছেন আইনজীবী ও চিকিৎসক, শিক্ষকরা। কর অফিসের অসৎ ও অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের পারস্পরিক যোগসাজসে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন এই তিন পেশাজীবীরা। এ তথ্যগুলো অনুসন্ধান করে বের করা হয়েছে। আইনজীবীদের শীর্ষ সংগঠন আর কাউন্সিলের সভাপতি এবং দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা যখন একথা বলছেন তখন তার অনুসারীরা নিয়মিতভাবেই কর ফাঁকি দিয়ে চলেছেন। এযেন আয়কর ফাঁকির মহোৎসব চলছে আয়কর মেলার পাশাপাশি। আয়কর ফাঁকির মহোৎসব আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক প্রকৌশলীরা সবাই যেন একাট্টা। খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর এর তদন্তে পেশাজীবীদের কর ফাঁকির বিষয়টি নিশ্চিন্তভাবে ধরা পড়েছে। তাহলে যে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে কর দিচ্ছে বলে শীর্ষ আইন কর্মকর্তা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন সেই জনগণ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে। প্রকৃত অর্থে যেসব নাগরিক বা জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তারাই কেবল নিয়মিতভাবে তাদের আয়ের উৎস প্রদর্শন পূর্বক সততা ও নিষ্ঠার সাথে আয়কর দিচ্ছেন। এদের মধ্যে পেশাজীবীরা নেই, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক বা প্রকৌশলীরা নেই। যদি প্রত্যেক পেশাজীবী তাদের সঠিক আয়ের বিপরীতে নির্ধারিত আয়কর প্রদান করতো তাহলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যেতো। কর ফাঁকিবাজদের তালিকায় রাজনীতিবিদরাও রয়েছেন। যেহেতু ‘রাজনীতিকে’ কেউ পেশা হিসেবে তাদের জীবনবৃন্তান্তে উল্লেখ করেন না- তাই এক্ষত্রে পেশাজীবী হিসেবে রাজনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা সমীচিন ও হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের উচ্চ আদালতে চলমান ২৫ হাজার মামলায় ৩১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আটকা পড়ে আছে এবং অধিকাংশই কর ফাঁকি সংক্রান্ত। আয়কর ফাঁকিবাজরা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করছেন ক্রমাগতভাবে এমন অভিযোগ এখন ওপেন সিক্রেট। জনৈক এনবিআর চেয়ারম্যান (সাবেক) বলেছেন পেশাজীবীরা আয়ের উৎস প্রকাশ করতে চায় না বা করে না। সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসকদের জন্য রোগী দেখার ফি নির্ধারণ করে দিলেও তারা নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি ফি নেন সাধারণ রোগী তথা জনসাধারণের কাছ থেকে। একইভাবে একজন আইনজীবী তার মক্কেলের কাছ থেকে ঠিক কত টাকা আদায় করছেন এর হিসাবও অন্য কেউ কখনোই জানতে পারে না। স্কুল কলেজ বা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকরা বাইরে প্রাইভেট পড়িয়ে আদায়কৃত অর্থ- নৈতিকতা দেখিয়ে সে আয়ের তথ্য প্রকাশ করে না। এক কথায় আইনজীবী, চিকিৎসক ও শিক্ষকদের উপার্জিত আয় (ফিসহ) এর উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা আয়কর বিভাগের। ফলে কোটি কোটি টাকার বৈধ রাজস্ব থেকে দেশ ও জাতি পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু সরকারের নিয়ন্ত্রণ নয় তাদের লেনদেনের কোন স্বচ্ছ প্রক্রিয়াও নেই। দেশের রাজস্ব আদায়ে এনবিআর এর যে সাফল্য তা ব্যবসায়ীনির্ভর। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ে এনবিআর বা কর বিভাগ যতটা সক্রিয় ততটাই নিষ্ক্রিয় পেশাজীবীদের কাছ থেকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে। ফলে দেশের লাখ লাখ পেশাজীবী নিয়মিতভাবেই আয়কর ফাঁকি দিয়ে চলেছে কিংবা এখনও আয়করের আওতায় আসেনি। এমনকি বাংলাদেশে কতজন পেশাজীবী করদাতা আছেন, কোন পেশার করদাতা কি পরিমাণ আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছেন, এর কোন পরিসংখ্যানও নেইÑ মূলত আয়করের ওপর সরকারের রাজস্ব আয় অনেকাংশে নির্ভরশীল। সরকার পরিচালনা ও দেশের উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় হয়। পেশাজীবীদের আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে সীমাহীন ব্যর্থতা থাকায় সরকার ও বাংলাদেশ প্রতি বছর শতশত কোটি টাকা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে এমন অসংখ্যা কোটিপতি রয়েছে যাদের নাম আয়করদাতার তালিকায় নেই। যাদের নাম তালিকায় আছে তারা আবার প্রকৃত আয় (উপার্জন) অনুযায়ী আয়কর দেন না। বিশেষ করে ঘুষ বা উৎকোচ বাবদ যারা লাখ লাখ টাকা নিয়মিতভাবে আয় করেন তাদের সিংহভাগের নামই আয়কর দাতাদের তালিকায় অনুপস্থিত। দেশের উন্নয়ন ও জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে আয়কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হেেছ সে সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল বা খোদ এনবিআর চেয়ারম্যানের কোন বক্তব্য বা পরামর্শ ওই ডায়লগে ছিলো না। অথচ এই লক্ষ লক্ষ আয়কর ফাঁকিবাজদের খুব সহজেই আয়কর এর এবং আইনের আওতায় আনা সম্ভব বিশেষত এই ডিজিটাল বাংলাদেশ এর যুগে।
একজন চিকিৎসক বা শিক্ষক বা আইনজীবী প্রতিদিন বা মাসে বা বছরে তার নিয়মিত প্রাপ্য বেতনভাতার বাইরে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন সেটা বের করা কঠিন ব্যাপার নয়। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (ঘইজ) বা আয়কর বিভাগের সততা। কর বিভাগের একজন সৎ কর্মচারীকে গোপনে গোপনে কোন ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে সহজেই পরিসংখ্যান বের করা যাবে ওই চিকিৎসক প্রতিদিন কতজন রোগী ফি’র মাধ্যমে চিকিৎসা দিলেন কিংবা একজন শিক্ষক তার নিজের বাড়িতে বা প্রাইভেট হোমে কতজন ছাত্রকে অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়াচ্ছেনÑ সেটার হিসেব করা কঠিন ও দূরহ নয়। তেমনিভাবে কৌশলে একজন আইনজীবী তার মক্কেলের কাছ থেকে নজরানা বা ফি বাবদ কতটাকা নিচেছন সেটা বের করতে পারলেই একজন চিকিৎসক বা শিক্ষক বা আইনজীবী বছরে কি পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন সেটা সহজেই অনুমেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কেবল তদন্ত করে পেশাজীবীদের আয়কর ফাঁকি দেবার তথ্য সংগ্রহ করেছেন কিন্তু কোন উপায় বের করেন নি। আয়কর বিভাগের একজন নি¤œপদস্থ কর্মচারীর স্বনামে বেনামে যখন খোদ রাজধানীতে ফ্লাট কেনা হয় তখন বলতেই হবে সরিষায় ভূত রয়েছে এনবিআর এর রাজস্ব আদায়ে।
পুনঞ্চঃ রাজশাহী শহরের একটি নামকরা সরকারি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ২০০৩ সালে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতো এবং ওইখানে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতে দেখতাম। এখন ওই শিক্ষকের পাঁচতলা বিলাসবহুল বাড়ি হয়েছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে ওই শিক্ষক বছরে কত টাকা আয়কর ফাঁকি দিয়েছে।
লেখক: প্রকৌশলী