অ্যান্টেনা

আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০২২, ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ

আইয়ুব আলী :


খাটে হেলান দিয়ে বসা। চোখের সামনে বত্রিশ ইঞ্চি রঙিন স্মার্ট টেলিভিশন। মাথার উপর সিলিং ফ্যান। তার পরেও টিভি দেখার মনোযোগ নাই। জনপ্রিয় বাংলা সিরিয়াল চলছে। মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখের সামনে অভিনেতাদের ছবি। কখনো কানের দুলের, কখনো ঠোঁটের লিপিস্টিকের রঙের, কখনো গলার হারের, এরই মাঝে মাঝে কখনও দেখানো হচ্ছে পুরো শরীরে জড়ানো বাহারি শাড়ি। বাস-বাড়ির ঘরে সভাপতির মত নির্বাক বসে দেখা ছাড়া কোন উপায় নাই। আজ হঠাৎ অতীত মনে পড়ে গেল। সারা সপ্তাহ পর কাঙ্খিত শুক্রবার। স্কুল ছুটির দিন। কখন বিকাল হবে। বিটিভিতে পূর্ণ দৈর্ঘ্য সিনেমা দিবে। গ্রামের তিন পাড়ার মধ্যে সোনারের বাড়িতে টিভি আছে। সবাই শরণার্থীর মত ঢল নিয়ে সোনারের বাড়িতে হাজির হত। হাজারও বিরক্ত সত্ত্বেও পুরো বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বসতে দিতো। সাদা কলো মনিটর হওয়ায় বিকালের সূর্যের আলোকে বাধা দেয়ার জন্য ছেলের বউদের শাড়ি টাঙিয়ে দিতো। মাথার ওপর কোন ফ্যান ছিল না। ছিল না দক্ষিণা বাতাস। ছিল না আজকের মত রেক্সোনা বা বডি স্প্রে। বদ্ধ জায়গা। গরমে সবার গা ঘেমে নাকে আসতো আমলি গন্ধ! তার পরেও একটুও কেউ নড়তো না। এর মাঝে কখনো বাতাস ভারি করে নাকে লাগতো উটকো গন্ধ। সেই গন্ধ পেয়ে অনেকে বলতো, মুলোর তরকারি কার কার বাড়িতে রান্না হয়েছে। তোরা দূরে গিয়ে বাতাস ছেড়ে আয়। নাকে গামছা চেপে বাতাসকে ফিল্টার করে শ্বাস নেয়। তবুও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাই না কেউ। সেলিমের মত অনেকে লম্বা হওয়ায় তাদের বসতে হত সবার পিছনে।

তখন বিদ্যুৎবিভ্রাটের কোনো ভয় ছিল না। বারো ভোল্টের ব্যাটারিতে টিভি চলতো। একটানা পাঁচ সাত মিনিট এডভারটাইস হতো। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটারি থেকে ক্লাম খুলে রাখা হত। একটা মাত্র চ্যানেল। ছিল না রিমোট। কখনো কখনো বাতাসে এ্যন্টেনা নড়ে গিয়ে স্ক্রিনে ছবি ঝিলমিল করতো। দু’হাতে শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে এ্যন্টেনার বাঁশ নড়াতে হতো। এক সময় সমস্বরে চিৎ্কার করে উঠতো থাম থাম হইছে। এইভাবে সিনেমার প্রতিটা মুহূর্তে থাকতো উত্তেজনা। নির্দিষ্ট সময় নিয়ে চলে সিনেমা। কেউ কোন কথা বলতো না। সবার মনোযোগ সিনেমার দিকে। কেউ কেউ নায়ক নায়িকা চরিত্রের কষ্ট সইতে পারতো না। চোখের পানি তাদের মনের অজান্তেই গড়িয়ে পড়তো। নায়ক যখন ভিলেনকে মারতো কেউ কেউ চেঁচিয়ে উঠতো মার মার, আরো দে। সেসব সিনেমা দেখে সবার মনে দাগ কাটতো। নায়কের কাল্পনিক চরিত্র নিজেদের মধ্যে ফুটিরয় তুলতো। দেলোয়ার ভাই, আনোয়ার চাচা তারা তাদের মাথার চুল পিছনে ঝাকড়া করে রাখতে শুরু করলেন। মিঠু ভাই শহর থেকে বাঁশের বাঁশি কিনে আনলেন। আবুলের ছেলে নায়কের মত জাম্প দেয়া শুরু করলো। ব্রিজের উপর থেকে ডিগবাজি দিতো। গুনগুন করে অনেকে গান গাইতে থাকে।

শীতের সময় সূর্য একটু আগেই ঘুমাতে যায়। চোখের সামনে টিভির পর্দার আলোয় অনেকে তা বুঝতে পারে না। ভরা সন্ধ্যা হয়ে যায়। ঘুলঘুলি আন্ধার হয়ে যায়। জান্নাতিরা তিন বোন নিয়মিত সোনার বাড়িতে সিনেমা দেখতে যেত। হঠাৎ একদিন জান্নাতির মা দেখে রাত হয়ে গেছে তবুও টিভি দেখে মেয়েরা বাড়ি ফিরেনি। বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাতে কাঠের বাতা নিয়ে বসে আছে। আর বলেই যাচ্ছে খাওয়ার পর তো আর তর সইবেনা। সবার চোখেই রাজ্যের ঘুম নিয়ে বিছানায় যাবে। পড়তে বসবে কখন। রিমা সবার বড় হওয়ায় বাড়ির সব দোষ তার ঘাড়েই রাখা হয়। তাকে বকা দিয়েই ছোট দুজনকে শিক্ষা দেয়। জান্নাতি প্রাইমারি পাশ করে হাইস্কুলে যায়। এতে তার মায়ের মন গর্বে ভরে যায়। সেদিন সন্ধ্যার দেশ ও জনপদের খবরের পরে সিনেমা শেষ হবে। তাই শেষ আকর্ষণ নিয়ে বসে থেকে রাত হয়ে যায়। রিমা ভাবে আজ নিশ্চিত মায়ের হাতের মাইর তাকে খেতেই হবে। বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে জান্নাতিকে সবার সামনে দিয়ে রিমা তার মাকে দরজা খোলার জন্য ডাকছে। একটা বাদুড় উড়ে এসে কলার গাছে এসে পড়া দেখে সুমা দোড়ে এসে রিমাকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক সেই সময়ই রিমার মা দরজা খুলে কাঠের বাতা দিয়ে এক বাড়ি। প্রথম বাড়িটা লাগলো জান্নাতিকে। জান্নাতি মা-রো, বাব-রো বলে চিৎকার করে উঠলো। সেই চিৎকার তার মায়ের মনে শূলের মত বিধলো। রাগ বেড়ে গিয়ে রিমাকে এক বাড়ি! সেই বাড়িও রিমাকে জড়িয়ে থাকা সুমাকে লাগলো। রিমাকে উদ্দেশ্য করে মাইরের গতি সুমার সহ্য করা খুব কঠিন। বাড়িতে মনে হচ্ছে মরা কান্দনি শুরু হয়ে গেল। পাশের বাড়ির চাচী এসে রিমার মাকে বকতে শুরু করলো। রিমার মা মনে কষ্ট নিয়ে বলছে, তাদের সে মারতে চায়নি। শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন রিমাকে।

সারা সপ্তাহ ধরে চলতো সেই সিনেমার গল্প। পরিবারের চাপে পড়ে কেউ দেখার সুযোগ না পেলে তার মন ছটফট করতো। কার কাছ থেকে শুনবে সেই সিনেমার কাহিনী। সবার মাঝে আন্তরিক ভাব ছিল। লম্বা বাঁশের মাথায় এ্যন্টেনা বাধা থাকতো। বাড়ির বাহিরে থেকে চালা ডিঙিয়ে সেই এ্যন্টেনা দেখা যেত। এই এ্যন্টেনা যেন এই সোনার বাড়ির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই মান মর্যাদা এ্যন্টেনার সমান উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ একই বাড়িতে যত ঘর! বলতে গেলে প্রত্যেক ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন। আজ এ্যন্টেনার দরকার হয় না। প্রতিক ভাই সবার বাড়িতে ডিসের লাইন দিয়েছেন। চ্যানেল পরিবর্তন করার জন্য টিভির কাছে গিয়ে কটাস খটাস শব্দ করতে হয় না। মনের অবস্থার উপর মুঠোর মধ্যে থাকা রিমোটের বাটনে টিপ পড়ে। এক সময় সারা গ্রামের সবাই মিলে যে সাদা কালো টিভি দেখতাম। সেই আন্তরিতা কোথায় চলে গেল। মনের মিল নেই। একই বাড়িতে তিনটি ঘর থাকলে প্রত্যেক ঘর চার ভাগে বিভক্ত। স্বামী বলছে তেলের দাম আগামীকাল থেকে বাড়াবে। একটু সময় দাও দেশের কি খবর তা দেখি। স্ত্রী বলছে বক বক করো না। আজ অনিন্দ শ্রীময়ীকে ছেড়ে জুনগ্রহের কাছে চলে যাবে। সবই যেন স্টার।