সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
আবদুর রউফ রিপন, রাণীনগর
নওগাঁর রাণীনগরের আতাইকুলা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী একমাত্র ঐতিহাসিক বধ্যভূমিতে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও আজও উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগে নি।
পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৫২ জন শহীদদের পরিবার এখনও পায় নি কোন সাহায্য সহায়তা। পায় নি কোন বিধবা ভাতা কিংবা বয়স্ক ভাতা। বাড়ির কর্তাদের হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এসব শহীদ যোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা। আজ অনেকেই মানুষের বাড়ি বাড়ি ঝি এর কাজ করছেন। বধ্যভূমিটি শহীদ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের উদ্দ্যোগে কোন রকমে ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে মাত্র। শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এলাকাবাসীদেরও দাবি শহীদ পরিবারের এই বধ্যভূমি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের।
ওই দিনের নারকীয় ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যাওয়া আতাইকুলা গ্রামের প্রদ্যুত চন্দ্র পাল, সাধন চন্দ্র পাল ও নিখিল চন্দ্র পাল ওই দিনের করুণ হত্যাযজ্ঞের কাহিনী অশ্রুসিক্ত নয়নে বর্ণনা করে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল রোজ রোববার সকাল ১০টায় ছোট যমুনা নদী পার হয়ে আসে একদল হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা এই গ্রামে আছে বলে তারা সন্দেহ করে প্রথমে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে প্রতিটি বাড়ি থেকে নগদ টাকা স্বর্ণালংকারসহ বাড়ির নারী পুরুষকে ধরে নিয়ে ওই গ্রামের বলরাম চন্দ্রের বাড়ির উঠানে নিয়ে যায়। সেখানে পুরুষদের উঠানে সারিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রাখে আর উঠানের পাশেই নারীদের এক ঘরে করে রাখে। একের পর এক নারীদের ওপরে চালিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে। পরে সারিবদ্ধ পুরুষদের উপরে চলে ব্রাশ ফায়ার। মুহূর্তের মধ্যেই ওই গ্রামের ৫২ জন শহীদ হন। পরে তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে চলে যায়। শহীদদের মধ্য থেকে গুলিবিদ্ধ হয়েও কোনো রকমে বেঁচে যায় প্রদ্যুত পাল, সাধন পাল ও নিখিল পাল।
প্রদ্যুত পাল জানান, ওই দিন তার বাবা, কাকা জ্যাঠা এবং গ্রামের লোকজনের সাথে তাকেও সারিবদ্ধ করে চালায় ব্রাশ ফায়ার। মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারায় ৫২ জন। হানাদার বাহিনীরা চলে যাবার পর রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লাশের মধ্য থেকে কোন রকমে বেঁচে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় সে তার বাড়িতে যায়। তিনি জানান সবাইকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়েছি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও কোন সরকারের আমলে কোন শহীদ পরিবার এখনও কোনো সাহায্য সহায়তা পায় নি। কোন স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে উঠে নি এই বধ্যভূেিত।
সাবেক সাংসদ শাহীন মনোয়ারা হক গত ১৯৯৬ সালে নিজ উদ্যোগে কিছু অনুদান দিয়ে কোন রকমে ফলকে শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করলেও আর কোন কাজ হয় নি। বধ্যভূমিটি পরে আছে অযতœ অবহেলায়। সাধন পাল জানান, ৩ দিন ৫২টি লাশ পরে থাকার পর পাশের গ্রামের লোকজনরা কোন রকমে ঘটনাস্থলের পাশেই মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখে।
নিখিল পাল জানান, যুদ্ধে বেঁচে গেলেও আজও তাদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হয় নি। কোন রকমে হারিয়ে যাওয়া পাল সম্প্রদায়ের মাটির ব্যবসা করে বেঁচে আছে তারা। বিধবা রেনু বালা, ফেন্তু বালা ও সবেজু বালা তাদের সেই দিনের করুণ কাহিনীর বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা বলেন, স্বামীকে হারিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনেক দুঃখে কষ্টে, অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে এখনও বেঁচে আছেন তারা। দুঃখের সাথে তারা আরো বলেন, ঘটনার ৪৪ বছর পার হলেও এখনও কোন সরকার তাদের কোন সাহায্য সহায়তা করে নি। তাদের ভাগ্যে জোটে নি বিধবা ভাতা বা বয়স্ক ভাতার কোন কার্ড। আর কত বয়স হলে তারা বয়স্ক ভাতা বা বিধবা ভাতা পাবেন। অবিলম্বে সরকারি ভাবে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক এবং এই সব অসহায় সুবিধা বঞ্চিত শহীদ পরিবারগুলোকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা হোক বলে জোর দাবি এলাকাবাসী ও শহীদ পরিবারের।