একুশ আসছে : কিসের আমন্ত্রণ!

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


গোলাম কবির:একদা আমরা গাছের পাতায় আমন্ত্রণ জানাতাম। সে পাতা অনেকটা সুলভ ছিলো। এখন মুদ্রণ যন্ত্র পৌঁছে গেছে গ্রামে-গঞ্জে। এমন সভ্যতার আলোকে সে গাছ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। তবে বিলুপ্ত হয়নি। অশ্বথ বৃক্ষ মুষ্ঠিমেয় হয়ে আসছে। নবাবগঞ্জে (চাঁপাই) এ গাছ প্রচুর পাওয়া যেত। লোকে বলতো ‘পাইকোড়’ গাছ। এনিয়ে এক সময় লোক কবিতা ও কেউ কেউ লেখতন। একে হোঁলিও বলা হতো। ‘এক গাছ বাজে, এক গাছ সাজে, এক গাছে মরার মাথা আর এক গাছে ছেড়া কাঁথা।’ ছেলে বেলায় এই কবিতা নিয়ে ‘ফস্টি’ ধরতাম।

এই পাইকোর পাতা আমাদের আমন্ত্রণে চমৎকার মাধ্যম ছিলো। সাধারণত নববর্ষ এবং ভাষা শহিদের স্মরণের দিন। রবীন্দ্রনাথ এই অশ্বথ বৃক্ষকে প্রেমের অনির্বাণ স্বাক্ষর করে রেখে গেছে: “ধরাতলে দীনতম ঘরে/ যদি জন্মে প্রেয়সী আমার নদীতীরে কোন এক গ্রাম প্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে/অশ্বত্থ ছায়ায়, সে বালিকা বক্ষে তার রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার/ আমরি লাগিয়ে সযতনে।” স্বর্গ হইতে বিদায়, চিত্রা, ২৫৫ পৃষ্ঠা, সঞ্চয়িতা, জন্ম শতবর্ষ সংখ্যা।

আমরা এই বৃক্ষের পাতায় আমন্ত্রণ পত্র ছাপাতাম। নববর্ষ কিংবা ভাষাÑশহিদ দিবসের আগে। তাতেই নতুন বছর কিংবা বাংলা ভাষার মর্যাদা তীর ছাপিয়ে আকুল করতো আমাদের। আমরা তা ভুলিনি। তবে ভুলিয়ে দিচ্ছে কিছু শেকড়হীন মানুষ। প্রয়োজনহীন অনুষ্ঠানে নিজের ভেজাল আভিজাত্য প্রমাণ করতে গিয়ে বিজাতির ভাষার পত্রাদি ছাপিয়ে চমক লাগাতে চেষ্টা করছে। আমরা বুঝছি না এর পরিণতি কত ভয়াবহ। আঠারো শতকে নগর কলকাতায় ইংরেজি শেখার যে কসরত আমরা লক্ষ্য করেছি, তার পরিণতি দেখার জন্য দীর্ঘ সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হয়নি। আমরা পরাধীনতার শেকলে বাঁধা পড়ে গেছি।

আজও মুক্ত হতে পারিনি। হলো দেশভাগ, আর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকে উপহাস করে অতি সাধারণ পরিবার অভিজাত সাজার প্রতিযোগিতায় নেমে ন্যক্করজনক ভাবে বিদেশি ভাষায় আমন্ত্রণপত্র দিয়ে আভিজাত্যের সারিতে দাঁড়িয়ে জাতিকে উপহাস করছে।

এমন স্বাধীনতা পরাধীনতার নামান্তর। তা তারা বুঝে না, সুতরাং সচেতন মানুষের উচিত, এমন উদ্যোগের প্রতি ভর্ৎসনা জানানো। সে ইচ্ছাটুকু বোধকরি হারিয়ে ফেলেছি। শুভশক্তি যত ধীরে কমুক না কেন অশুভশক্তি তার বহুগুণ বাড়িয়ে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদাকে গ্রাস করবে। আমাদের ভাষা আন্দোলনকে ভ্রƒকুটি করবে! সেই সাথে স্বাধীনতাকে তামাসায় পরিণত করছে। যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
আমরা মরে বাঁচবো, না বেঁচেই মরবো, বুঝি না। পথ না দেখে পা ফেলি। ফলে অঘটন ঘটে যাচ্ছে বৃহত্তর জাতীয় জীবনে। আমরা সেদিকে তাকাইÑআমাদের মুক্তি আসবে যে পথে।

মধুসূদন বিদেশি ভাষায় লিখে ভুল করেছিলেন সংশোধিত হয়ে অক্ষয় হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ লেখেননি নিজের লেখা নিজেই অনুবাদ করে জগৎজোড়া স্মরণীয়। সবাই আমরা এমনটি হতে পারবো না। তাই বলে মাতৃভাষাকে কেন খাটো করবো!

লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ