ও মানুষ! শুনতে কী পাও, নদী আর চলনবিলের কান্না?

আপডেট: ডিসেম্বর ৭, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

মোঃ আবুল কালাম আজাদ:


নদী আর প্রমত্বা চনবিল মানুষের বর্ববর নির্যাতনে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ও মানুষ,শুনতে কী পাও,নদী আর চলনবিলের কান্না? বড়াল-আত্রাই-নন্দকুঁজা-গুমানি নদীই হচ্ছে উপমহাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রান ।এই ’চলনবিল’কে বাঁচাতে হলে সবার আগে বাঁচাতে হবে চলনবিলের প্রান সঞ্চালনকারি বড়াল-নন্দকুঁজা-আত্রাই ,গুমানি এবং শাখা- উপ শাখা নদী ,জলা-জলাশয়কে।নাব্যতা ফিরিয়ে বাড়াতে হবে পানির প্রবাহ।আমরা কী পারিনা নদী আর চলনবিলকে বাঁচাতে? উন্নয়নের নামে নদ-নদী,জলা-জলশয় দখল-দুষন নির্যাতনে নদ-নদীর নব্যতা ও অস্তিত্ব হারিয়ে গুমরে গুমরে ভাষাহীন কান্না করছে। নদ-নদীর প্রবাহ না থাকায় উপ মহাদেশের বিশাল জলাভ’মি চলনবিলও পানিশুন্য মরুময়। হারিয়ে গেছে মাছ-পাখি,জলজ সম্পদ।পাল্টে গেছে জলবায়ু, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনযাত্রা।ঝুঁকিতে চলনবিলের মানুষ- পরিবেশ।

নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবেনা। তাই মানুষের জীবন রক্ষার্থেই নদীর জীবন বাঁচাতে হবে। বলা হয় নদীর সাথে জীবনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদী না বাঁচলে চলনবিল, হাওর-বাওর ও পরিবেশ বাঁচবেনা। আর পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ, প্রাণি , জীববৈচিত্র বাঁচবেনা। তাইতো নদীকে বাঁচাতে নানা প্রক্রিয়ায় চলছে আন্দোলন । গড়ে উঠেছে হাজারো সংগঠন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ ডিসেম্বর সোমবার নিজ মন্ত্রলায় কক্ষে ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর নব্যতা রক্ষা ও দুষন রোধে প্রণিত মহা পরিকল্পনার আলোকে সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্প গ্রহনের নীতিগত সিদ্ধানত নিয়ে এক সভায় বলেন,’ দেশকে রক্ষ করতে হলে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’ আমরা যদি বাংলাদেশকে রক্ষা করতে চাই তাহলে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে’।এছড়াও তিনি নদ-নদী সুরক্ষায় কঠোর দিকনির্দেশনা দেন। (দৈনিক মানব জমিন,ভোরের ডাক,সময়ের আলো, প্রথম আলো সহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত-৫/১২/২০২৩) ।

মানব সভ্যতার উন্নয়ন, জীববৈচিত্র এবং পরিবেশই গড়ে উঠেছে নদী কেন্দ্রিক । ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় , পৃথিবীতে যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর তীরে।ব্যবসা-বানিজ্য, শহর, নগর সবই নদীর অবদান। মানুষের আর্থ-সামাজিক, জীব বৈচিত্র, পরিবেশ, জলবায়ূ , কৃষি-শিক্ষা সবকিছুর মুলে নদী। দিনে দিনে মানুষ নিজের স্বার্থে নদীর দুই কুলে জেগে ওঠা সিকস্তি-পয়স্থি ভ’মি বিভিন্ন সময়ের সরকার ,ভুমি খেকো প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতারা বেপরোয়া ভাবে দখল-দুষন আর নির্যাতন করে নদীর টুটি টিপে মেরে ফেলছে। নদীর সাথে মেরে ফেলেছে ঐতিহাসিক ’চলনবিল’কে। কোন বাধাই মানছেনা। আর এর জড়িত অসাধু ভুমি অফিসের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা।

নদী ও নারী নির্যাতন সমানভাবে চলছে। এই নির্যাতন থেকে নদীর জীবনী সত্বাকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা), বেলা, নদীরক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলন, আত্রাই-গুমানি- নন্দকুঁজা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন ,নারোদ নদ রক্ষা আন্দোলন কমিটি জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি সংস্থা নানাভাবে আন্দোলন করে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন সময়ে আদালতের নির্দেশে কিছু কার্যকরি পদক্ষেপ নিলেও প্রভাবশালী ভ’মিখেকোদের কাছে নদী দখল উচ্ছেদ আর দুষন রোধে সরকারের কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়েন। নদী কমিশনের চেয়ারম্যান নদি দখলে এক মহিলা মন্ত্রীকে ইংগিত করে কথা বলায় চেয়ারম্যানকে পদই হারাতে হলো।

নদীর সঠিক মালিকানা নিয়েও চলছিল টানাহ্যাঁচড়া।নদীর মালিকানা নিয়ে পানি উন্নয় বোর্ড (পাউবো) হয়ে উঠেছিল দুর্নিতির রাঘব বোয়াল। কথিত আছে পানিউন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারনেই নদ-নদীর অপমৃত্যু হচ্ছে। নাটোর(গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) ৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য চলনবিলের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আলহাজ অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি এবং বিভাগীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সভায় অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন “ আমি যদি এক ঘন্টার জন্যেও প্রধানমন্ত্রী হতাম তাহলে সর্বপ্রথম পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্তির ঘোষনা দিতাম।” উক্তিটি যথার্থই ছিল বলে নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

মহমান্য হাইকোর্ট নদ-নদীর দখল, দুষন,ভরাট,সংরক্ষন ও ব্যাবস্থাপনার বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষনা করেন। একই সাথে মহামান্য আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়- জলাধারের অবৈধ দখল ও দুষনকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গন্য করার আদেশ জারী করেছেন।রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৮৬ ও ৮৭ ধারা এবং ১৪৯(৪)ধারা অনুসারে জাতীয় নদী কমিশনকে নদীর জীবনী স্বত্বা রক্ষার মালিকানা প্রদান করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও নদী খেকোদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছেন।

চলনবিল অঞ্চলের খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশি লিখেছেন. চারশত বছর পুর্বে এই বিলটি রাজশাহী,পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রম্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিম উত্তোরাংশে চলনবিল বিরাজিত।অবস্থান, আকৃতি ও প্রকৃতিতে দেখাযায়,চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী স্নায়ুজলের নাভি কেন্দ্র। কিন্তু ১৯১৬ সালে পাকশি- সিরাজগঞ্জ এবং পাকশি-শান্তাহার রেল লাইন করায় বড়াল , আত্রাই- নন্দকুঁজা-গুমানি সহ সংশ্লিষ্ট আরো নদ- নদীর প্রস্থ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এখান থেকেই শুরু হয় চলনবিলের নদ- নদীর অপমৃত্যুর উদ্বোধন ।

চলনবিলের প্রান সঞ্চালনকারী( জীবনদায়িনী) অন্যতম প্রধান নদী -আত্রাই-বড়াল-গুমানি এবং নন্দকুঁজা নদীর প্রবাহ পরিচিতি প্রজন্মের জানা দরকার। তা হচ্ছে-
আত্রাই নদী নাব্যতা হারিয়ে এখন জোলায় পরিনত ঃ আত্রাই তিস্তার শাখা নদী। দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার উত্তরে এ নদী করোতোয়া নদী নামে প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদী ছোট যমুনায় মিশে দক্ষিন-পুর্বে প্রবাহিত হয়ে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় ত্রী- মোহনায় নন্দকুঁজার সঙ্গে মিলিত হয়ে গুমানি নাম ধারণ করে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার নুননগর এসে বড়ালের সঙ্গে মিশে বড়াল নামে ভাঙ্গুড়া ও বনানিনগড় ফরিদপুর উপজেলা হয়ে বেড়া উপজেলার কাছে মুল যমুনায় মিশেছে। এই-জন্য আত্রাই নদীকে বলা হয় যমুনার উপনদী।আত্রাই নদী ছোট যমুনা হতে প্রবাহিত হয়ে, নওগঁ হয়ে বৃহত্তর চলনবিলের বুকচিড়ে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা হয়ে গুরুদাসপুর উপজেলার পৌরসভার ত্রী-মোহনায় নন্দকুঁজা এবং গুমানি নদীর সঙ্গে মিশেছে।

আত্রাই নদীর নামকরনে নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা নামে একটি উপজেলা এবং রেল ষ্টেশন স্থাপিত হয়েছে। আত্রাই নদীর পাড়ে ভাটরা পতিসরে বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদার বাড়ি অবস্থিত। এখানে বসেই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ কবিতাটি। আত্রাই নদীকে এক কথায় বলা হয় চলনবিলের মূল শিরা । কারন আত্রাই নদীর দীর্ঘ প্রবাহের মাধ্যমেই চলনবিলের উৎপত্তি হয়ে বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তোর বিল বলে ইতিহাস খ্যাত।আত্রাই নদীর মুল প্রবাহেই চলনবিলের স্রোত চলমান আছে আজো। সেই আত্রাই নদীর দুই পাড়ে পলি জমে নব্যতা হারিয়ে এখন জোলায় পরিনত হয়েছে।

আত্রাই নদীর বহু উপনদী বা শাখা নদী রয়েছে। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ডান তীরে ফকিরনি নদী, নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাম তীরে গুড়নই নদী এবং গুরুদাসপুর উপজেলার বাম তীরে হরদমা গ্রামে বেশানী নদী বর্তমানে ভাসানী নদী ও যোগেন্দ্র নগর বাম তীরে মরা আত্রাই নামে শাখা প্রবাহিত। আত্রাই নদীর প্রত্যেক শাখা- উপ-শাখা দিয়ে পানির স্রোত গিয়ে পড়ছে চলনবিলের মধ্যে। এই শাখ উপ শাখার স্রোত-ধারার কারনেই চলনবিল চলমান। তাই নাম হয়েছে চলনবিল। আত্রাই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ কিলোমিটার।

আত্রাই নদীর নব্যতা উদ্ধারে ড্রেজিং কাজে দুর্নিতী ও অনিয়মের অভিযোগ ঃ পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার যমুনা থেকে বড়াল,গুমানী এবং আত্রাই নদীর নব্যতা উদ্ধারের জন্য অভ্যন্তরিন নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের (বিআইডব্লিউটিএ) উদ্যোগে ২০১৭ সালে ড্রেজিং এর কাজ চলছে। নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে বেড়া থেকে শুটকিগাছা রাবারড্যাম পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার খনন সম্পন্ন হয়েছে। ড্রেজিং এর কাজে গুরুদাসপুরের নদীরক্ষা আন্দোলন কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সাংবাদিক ও সচেতন নগরিক সমাজ ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিষয়টি দুদক, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন এবং বিআইডব্লিউটিএর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ আমলে নিয়ে ১১/৪/২০১৯ তারিখে গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাঁদের ম্যপিং জরিপের ভুল স্বীকার করেন এবং প্রয়জনীয় পদক্ষেপের আশ^স দেন।

বড়াল নদী ভুমি খেকোদের দখলে ঃ চলনবিলের জীবন সঞ্চালনের অন্যতম প্রধান ধমনি হচ্ছে বড়াল নদী। রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার চারঘাট পদ্মা(গঙ্গা) থেকে বড়াল নদীর উৎপত্তি। চারঘাট পদ্মা হতে বড়াল নদী প্রবাহিত হয়ে পুর্ব দিকে রাজশাহী জেলার বাঘা থানা ও নাটোর জেলার লালপুর, বাগাতি পাড়ার দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্টের গা ঘেষে উত্তর-পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়িয়া এসে পুর্বদিকে বনপাড়া, বড়াইগ্রাম, জোয়ারী, মৌখাড়া, লক্ষ্মিকোল, জোনাইল, চাটমোহর উপজেলার ওপর দিয়ে ধানকুনা, নুননগর-বিন্যাবাড়ি গিয়ে গুমানী নদীর সঙ্গে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া উপজেলা, বনানি নগর ফরিদপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেড়া উপজেলায় যমুনার সঙ্গে মিশেছে।

আশির দশক পর্যন্ত পদ্ম্ার উর্বরা পলিযুক্ত পানির স্রোতের তীব্রতায় ছিল প্রমত্মা। সেসময় এই স্রোতস্বনী নদী দিয়ে চলতো বানিজ্যিক বড় বড় নৌকা, বজরা, লঞ্চ, স্টীমারসহ নানা কাঠামোর জলযান। পাওয়া যেত সুস্বাদু নানা প্রজাতির মাছ। এই নদনীর তীরে গড়ে উঠেছে বনপাড়া, জোয়ারী, মেীখাড়া, লাক্ষীকোল , জোনাইল, হরিপুর এবং চাটমোহর হাটবাজার এবং বানিজ্যিক কেন্দ্র।

প্রমত্মা বড়াল নদী আজ মৃত । পদ্মার শাখা নদী রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলা থেকে শুরু হয়ে পাবনার বেড়া পর্যন্ত চলনবিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনার সাথে সংযোগকারী বড়াল নদী। বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জসহ ৪ টি জেলার চারঘাট, বাগাতিপাড়া, লালপুর,বড়াইগ্রাম, চাটমোহর,ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর,শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলাসহ ৯ টি উপজেলার মধ্যে দিয়ে বড়াল প্রবাহিত। বড়ালে অনেক শাখা, উপ-শাখা প্রবাহ আছে।

আশির দশকের পর সেই স্রোতস্বিনী বড়াল নদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাহীন দুর্নিতী আর স্বেচ্ছাচারিতার কারনে আজ সম্পুর্ন মৃত।এর সাথে শাখা,উপ শাখাও মৃত এবং দখলদারদেও দৌরাত্বে বিলুপ্ত। ১৯৮২ সালে পদ্মা থেকে বড়ালের উৎসমুখ রাজশাহী জেলার চারঘাটে বড়ালের প্রসস্ততা সংকুচিত করে ৩০০ ফুট থেকে হ্রাস করে ৩৫ ফুটপ্রস্থ স্লুইস গেট নির্মান করে এবং স্লুইসগেট থেকে উজানে পদ্মা পর্যন্ত সংকুচিত করে পানি প্রবাহের গতি কমানো হয়। ১৯৮৯ সালে চারঘাট থেকে ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে বাগাতিপাড়া এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার সিমান্ত দয়ারামপুরের -আটঘড়িয়া এসে পুর্বদিকে প্রবাহিত বড়ালের মুখে দুইপাড় আরো সংকুচিত করে এবং বড়ালের শাখা নদী নন্দকুজা নদীর মুখে আরো দুইটি স্লুইসগেট ও ৩টি ক্রসবাঁধ নির্মান করায় প্রমত্বা বড়াল ও নন্দকুঁজা জীবন প্রবাহের মৃত্যু ঘটে। । চারঘাট থেকে প্রবাহিত বড়ালের শাখা নদীগুলিই হচ্ছে নারোদ নদ,নন্দকুঁজা, মির্জামামুদ ,মুসা খাঁ ,বোয়ালিয়াএবং তুলসিগঙ্গা নদী। এই নদিগুলিই চলনবিলের প্রাণ।

বড়ালের প্রধান শাখা নদী নন্দকুঁজা বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়িয়া হতে উৎপত্তি হয়ে উত্তর দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার আহমেদপুর, নাটোর সদর উপজেলার হালসা, সিংড়া উপজেলার বাহাদুরপুর ও হেলাইগাড়ি এবং গুরুদাসপুর উপজেলার চন্দ্রপুর, নাজিরপুর , গুরুদাসপুর পৌরসভার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রী-মোহনায় এসে আত্রাই ও গুমানি নদীতে মিশেছে। আটঘড়িয়া হতে চাঁচকৈড় ত্রী- মোহনা পর্যন্ত নন্দকুঁজা নদীর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার।

১৯৮৯ সালে আটঘড়িয়ায় বড়াল নদী থেকে উৎপত্তিস্থলে বড়াল- নন্দকুঁজা নদীর মুখে দুই পাড় সংকুচিত করে স্লুইসগেট নির্মান করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করায় মরা নদীতে পরিনত হয়েছে।নন্দকুঁজা নদী বড়ালের শাখা নদী বিধায় পদ্মার পানির প্রবাহ নন্দকুঁজা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি- মোহনায় গুমানি নদীতে পড়ে। আটঘড়িয়ায় অ-প্রস্বস্থ স্লুইস গেটের কারনে বড়ালের মুল স্রোত নন্দকঁজা দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্ত নন্দকুঁজার মুখেও স্লুইসগেট নির্মান করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে বর্ষা মওসুমে অর্ধেকেরও নীচে প্রবাহিত হচ্ছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় পর্যন্ত আহমেদপুর , হালসা, চন্দ্রপুর, হোলাইগাড়ি, নাজিরপুর , গুরুদাসপুর ও চাঁচকৈড় হাটবাজর ও ব্যবসায়িক বানিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।নাটোর সুগারমিল এবং যমুনা ডিষ্টিলারিজের বিষাক্ত বর্জ্য নারোদ নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নন্দকুঁজা নদীতে পড়ে পানি দুষিত হচ্ছে। ফলে নারোদসহ নন্দকুঁজা নদীর মাছ ও জলজ সম্পদ মরে- পচে নদী এলাকার পরিবেশ মারাত্নকভাবে দুষিত করছে।

এছাড়াও নন্দকুঁজা নদীতে বেশীরভাগ সময় পানি না থাকায় এবং পলি জমে দুই পাড় ভরাট হওয়ায় প্রভাবশালী ভুমি খেকোরা দখল করে প্রমত্মা নদীকে নির্মমভাবে হত্যায় মেতে উঠেছে। বড়ালসহ এই নন্দকুঁজা নদীকে সকলপ্রকার দখল-দুষন থেকে রক্ষা এবং চারঘাট ও আটঘড়িয়ার স্লুইসগেট অপসারনের দাবীতে গুরুদাসপুরের নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি মানব বন্ধন, নদীপথে ৪০ কিলোমিটার নৌ র‌্যালীসহ বহু কর্মসুচি পালন করে আসছে।

মির্জামামুদ নদী বড়াইগ্রাম উপজেলার কাছুটিয়া বড়াল নদী থেকে উৎপত্তি। কাছুটিয়ার বড়াল নদী থেকে মির্জামামুদ নদীর প্রবাহ গুরুদাসপুর উপজেলার কান্দাইল, ধানুড়া, পুরুলিয়া, তুলাধুনা চন্দ্রপুর, চকআলাদত খাঁ, গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলের ভেতর দিয়ে সোনাবাজু ঝাঁকড়া হয়ে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াল নদীর আর ১ শাখা তুলসিগঙ্গা নদীতে মিশেছে।

কথিত আছে একসময়ে এই মির্জমামুদ নদী দিয়ে বড় বড় বানিজ্যিক নৌকা ,বজরা , লঞ্চ চলাচল করতো।বর্তমানে এই স্রোতস্বিনী নদী সম্পুর্ন মৃত। নদীখেকোরা নদীর উৎসমুখ থেকে ধানুড়া পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে।পুরুলিয়া থেকে গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলে ভিতর দিয়ে সোনাবাজু পর্যন্ত এখনও নদীর ধারা থাকলেও দখলদাররা চন্দ্রপুর এলাকায় নদীর মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে।বর্ষা মওসুমে এই নদী দিয়ে ধানুড়া , হালসা, রানিনগর , চন্দ্রপুর , গোপিনাথপুর, বৃকাশো ও চাকলের বিলের পানি নিস্কাশিত হয়। মির্জামামুদ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার।

তুলসিগঙ্গা এবং বোয়ালিয়া নদী মানচিত্র থেকেই বিলুপ্ত। বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়ারি বড়াল নদী থেকে উৎপত্তি। জোয়ারি বড়াল থেকে উত্তর-পুর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নওদাজোয়ারি, গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা, খামারপাথুরিয়া, নওপাড়া, ইদিলপুর , তেলটুপি, মকিমপুর ,রওশনপুর , ঝাঁকড়া, সোনাবাজু, পোয়লশুরা পাটপাড়া, শিধুলি,ধারাবারিষা, বড়াইগ্রম উপজেলার ভিটাকাজিপুর হয়ে দক্ষিন চলনবিলের চেঁচুয়ার বিলের মধ্যদিয়ে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার কাটেঙ্গা কিনুর ধর গিয়ে গুমানি নদীতে মিশেছে। তুলসি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দখলদারদের দৌড়াত্বে একসময়ের প্রমত্মা তুলসি নদী জোয়ারি উৎসমুখ থেকে রওশনপুর পর্যন্ত পুকুর খনন করে মাছ চাষ , বসতবাড়ি,মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান কেেরছে। এমনকি এই নদী প্রভাশালীদের মদদে মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে।

গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরের মামুদপুর নন্দকুঁজা নদীর শাখা বোয়ালিয়া নদী। । বোয়ালিয়া নদীর প্রবাহ উৎপত্তিস্থল নন্দকুঁজা থেকে মামুদপুর , জুমাই নগর, বিন্যাবাড়ি, দক্ষিন নারিবাড়ি, শিধুলি, উদবাড়িয়া, দাদুয়া, খাঁকড়াদহ, এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার কচুগাড়ি হয়ে ভিটাকাজিপুর তুলসিগঙ্গা নদীর সাথে মিশেছে। দখলদারদের দৌড়াত্বে নদীটির অস্তিত্ব মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে। উপজেলার নদীর তালিকায় বোয়ালিয়া নদীর কোন নামগন্ধই নাই। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তুলসিগঙ্গা ,মির্জামামুদ এবং বোয়ালিয়া নদীর পানি দক্ষিন চলনবিলের প্রান সন্চালন করতো এবং বিশাল অঞ্চলের সব কয়টি বিলের পানি নিস্কাশিত হয়।

সুপারিশ ঃ- নদী-জলা-জলাশয় রক্ষায় আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সি এস রেকর্ড অনুযায়ী জরিপ করে সীমানা নির্ধারন পুর্বক অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও পুনঃখনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। বড়াল ও নন্দকঁজা নদীর তিনটি স্লুইস গেটসহ সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।পৌরসভা, হাট-বাজার এবং কল- কারখানার সকল প্রকার বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর উপড় স্থাপিত চারঘাট এবং আটঘড়িয়ার স্লুইসগেটসহ সকল প্রকার অবৈধ স্থাপনা অপসারন করতে হবে।নৌ পুলিশ গঠন করতে হবে।আর প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধে গনজোয়ার গড়ে তুলতে হবে।
মোঃ আবুল কালাম আজাদ,সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, প্রধান উপদেষ্টা,গুরুদাসপুর,নাটোর,০১৭২৪০৮৪৯৭৩  ৬/১২/২০২৩

Exit mobile version