কালো মেয়ের কালো চশমা

আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০১৬, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

নার্গিস আখতার কনক


বুকের ভিতর দুরু দুরু কাঁপছে। খুব অস্থির লাগছে। খুব সোয়েটিং হচ্ছে। রাতে ভালোমত ঘুমও হয়নি। আলমারি থেকে সব জামাকাপড় বের করে ফেলেছি। এতদিন যে জামাগুলো মানাতো খুব, আজ মনে হচ্ছে ওগুলোতেও গায়ের রং বেশি চোখে পড়ছে।
রাত থেকে রূপাকে অনেক জ্বালায়েছি। রূপা আমার খালাতো বোন। ছোট বেলা থেকেই সকল হাসি আনন্দ আর দুঃখের দিনগুলোতে আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। কাল থেকে ওকে প্রায় একশ বার ফোন দিয়ে ফেলেছি।
কী করব… একটা ফোন দিই এখন রূপাকে। ভাবতে ভাবতে দিয়ে ফেললাম।
ঘুম ঘুম কণ্ঠে রূপা, হ্যালো, বল্ নিশী। আবার কী হলো?
না, মানে খুব অস্থির লাগছে।
উঁহু, জানিস এখন কয়টা বাজে?
আমি ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। সকাল ৫:৩০।
প্লিজ লক্ষ্মী বোন আমার, রাতে অনেক লেট করে ঘুমিয়েছি। এখন একটু ঘুমাই। তুইও দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে নে প্লিজ।
কী করব বুঝে পারছি না। ভাবলাম, নানুর ঘরে যাই। নানু রোজ এসময় কোরআন শরীফ পড়ে ওঠেন। আজ আমাকে এতো সকালে দেখে নানু অবাক চোখে তাকালেন।
কীরে, শরীর খারাপ? আয় আমার পাশে বস। চুলে বিনি  কেটে দিই?
আমি অসহায়ের মত এসে বসলাম নানুর বিছানায়। বললাম, আচ্ছা নানু, জনী ভাইয়ার জন্য আমরা যে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম, চোখ দুটো কি মায়া মায়া। আর কী মিষ্টি। আর চুলগুলো কতা বড়, না? ভাইয়ার কিন্তু ভারী পছন্দ হয়েছিল। তোমরা সেদিন ওভাবে উঠে চলে এসে কি কাজটা ঠিক করেছিলে?
নানু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, আমার নাতি বউ কালো হবে, এটা হতেই পারে না। আমার একমাত্র নাতি বউ হবে দুধে আলতার মতো।
কী যে হলো। আমি হ্যাচকা টানে মাথায় উপর থেকে নানুর হাত সরিয়ে ঘুরে তাকালাম নানুর দিকে।
তাই নানু, আমি যে কালো। আমার ক্ষেত্রেও যখন ছেলে পক্ষ উঠে চলে যাবে? একই ঘটনা যদি আমার সাথেও ঘটে, তখন?
রুমে এসে দরজার উপর সব রাগ ফেলে জোরে দরজা লাগালাম। কী যে করি! শোভাকে ফোন দিলাম।  শোভা, খুবই ভয় লাগছে, অস্থির লাগছে।
কেন?
কেন আবার কী? এই যে আমি কালো। আকাশে মা…
তুই তো ভালো করেই জানিস, তোর জন্য আমাদের কলেজের কত ছেলে পাগল, কত সিনিয়র ভাইয়ারাও, সেইদিনই তো রাব্বি ভাইয়া আমাকে কত কিছুর লোভ দেখালো তোকে মানানোর জন্য। তারপর তোর পাশের বাড়ির ওই পোলাটার জন্য তো তুই তোর রুমের জানালাটা খুলতেই পারিস না। নানু না পর্দা বাতাসে উড়ে যায় বলে কতগুলো সিলাই মারলো!
শোভা প্লিজ, তোর আজগুবি কথা থামাবি। আজ আকাশের মা আমাকে দেখতে আসবে। সব বাবা মা চায়, ছেলের বউ আনবে দুধে আলতা। ফর্সা হলে যেন সাত খুন মাফ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুক্ষণ দেখলাম। সৃষ্টিকর্তা কেন যে গায়ের রংটা কালো দিলো! আমি জানি, কালো বলে সব কালার লিপিস্টিকও আমাকে মানায় না। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।
আকাশ প্রায়ই আমাকে কৃষ্ণকলি কবিতার প্রথম আট লাইন শুনাতো, আর বলতো, প্রথম আট লাইন তোমার সাথে মিলে যায় একদম। কবি গুরু মনে হয় তোমার জন্যই এই কবিতা লিখেছিলেন। আর আমি তা শুনে হাসতাম।

২.
সকাল দশটায় একটা রেস্টুরেন্ট-এ উপস্থিত থাকতে বলেছেন আকাশের মা। শুনেছি, উনি আবার খুব পাঙ্কচুয়ালÑ খুব টাইম মেইনটেইন করেন। দেরী হতে পারেÑ এই ভয়ে আধা ঘণ্টা আগেই আমি চলে গেলাম রেস্টুরেন্টে।
অজানা একটা ভয় নিয়ে অপেক্ষা করছি। ঘড়িতে এখন দশটা। আমারও হার্টবিট বেড়ে গেল।
আকাশ আর চল্লিশোর্ধ এক মহিলা ঢুকলেন। মহিলার পরনে ডার্ক ব্লু রঙের শাড়ি। নাকটা একটু বোঁচা, চোখগুলো গোল গোল, কিন্তু গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। ঠিক দুধে আলতা যাকে বলে। বুঝলাম আকাশের মা ফর্সা। শুধু আকাশ একটু শ্যামলা।
উনি কাছে আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। আকাশ পরিচয় করিয়ে দিল। আমি সালাম দিলাম। সালাম দিতে গিয়ে দেখি কথা বের হতে চাচ্ছে না। গলাটা কেউ চেপে রেখেছে। আন্টি খুব তীক্ষè আর মিষ্টি চোখে আমার দিকে তাকালেন। আন্টি আকাশকে চলে যেতে বললেন। ওর বাবার অফিসে কী যেন কাজ আছে।
বুঝতে পারলাম আজ আমি শেষ। মনে মনে আওড়াতে থাকলামÑ আজ আমি শেষ। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। মনে হলো, কোন এক দানবের সামনে বসে আছি। হঠাৎ করে মনে হলো পায়ের নিচে মাটি নাই। আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করে দেখলামÑ নাহ, ঠিক আছি। আন্টি খুব মিষ্টি করে হাসি হাসি মুখে বললেন, তুমি মনে হয় নার্ভাস ফিল করছো।
জ্বী, কিছুটা আন্টি। তবে সমস্যা নেই।
আমি আকাশের কাছে তোমার কথা খুব শুনেছি। তুমি খুব এ্যাকটিভ আর লক্ষ্মী একটি মেয়ে। ক্লাস টু-এ তোমার মা মারা যাবার পর তুমিই নাকি সব সামলাও। সব সামলিয়ে আবার পড়াশুনায় রেজাল্টও ভাল করো। বাবার কথাও শুনেছি, খুব ভাল মানুষ। তোমাদের দিকে তাকিয়ে আর বিয়েও করেননি। আন্টির মিষ্টি মিষ্টি কথায় শক্তি পাচ্ছ মনে হচ্ছে। নার্ভাসনেস অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনছি আর ভাবছি, যেমন তাঁর গায়ের রং কথাতেও যেন মুক্তা ঝরছে। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর লাগছে দেখতে।
আন্টি চা ঠা-া হয়ে যাচ্ছে।
আন্টি আরও মিষ্টি করে বললেন, হ্যাঁ মা খাচ্ছি। তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। খুব খারাপ লাগে তোমার জন্য, সেই ছোট বয়সে মাকে হারিয়েছো।
এবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেনÑ আকাশ একটু কালো, তার বাবার মতো। ছেলে মানুষ কালো আর ফর্সা- তাতে কি আসে যায়! আর আমার মেয়ে আমার মতোই ফর্সা।
আমার বুঝতে দেরী হলো না এবার তিনি তাঁর মেইন পার্ট শুরু করে ফেলেছেন। এটাই হলো পৃথিবীর নিয়ম।
আন্টি দরদ নিয়ে বললেন, আমার খুব ইচ্ছা একমাত্র ছেলের বউ হবে টকটকে ফর্সা। যাতে নাতি-নাতনিগুলো ধবধবে ফর্সা হয়।
আন্টি হঠাৎ আমার হাতটা ধরে বিনয়ের সাথে বললেন, তুমি আমার কথা বুঝেছো নিশ্চয়।
আমি হালকা মাথা নাড়ালাম নির্বাকের মতো।

৩.
বাইরে কড়া রোদ। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। চেষ্টা করছি আন্টি না যাওয়া পর্যন্ত চোখের বৃষ্টি না ঝরাতে। খুব চেষ্টা করছি।
ঝাপসা চোখ লুকানোর জন্য কালো সানগ্লাসটা আজ বড্ড দরকার।
কিন্তু কেনা হয়নি।