গুরুদাসপুরের হরদোমা নালায় নেই সেতু || নৌকায় চলে শবযাত্রা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ

গুরুদাসপুর প্রতিনিধি


কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে হরদোমা নালা পর হয় সুফিয়ার শবযাত্রা
কবরস্থান থেকে গ্রামটিকে বিচ্ছিন্ন করেছে প্রবাহমান একটি নালা। ওই নালার ওপর জীবদ্দশায় সেতু দেখে যেতে পারেন নি সুফিয়া বেগম (৭২)। তার বাড়ি থেকে নালার মুখ ও কবরস্থান পর্যন্ত সাড়ে তিন কি.মি. সড়কটিও কাঁচা। নিচু ওই সড়কটিতে বছরজুড়েই পানি জমে থাকায় পায়ে হেটে চলাচল করাও কঠিন।
৭২ বছরে চাখের সামনে কতজনের প্রয়াণ দেখেছেন তিনি। নৌকায় দেখেছেন এদের শবযাত্রা। ভেবে ছিলেন এ সরকারের আমলে অন্তত সেতুটি নির্মিত হবে। নিজের শবযাত্রা নৌকায় যাবে না। সম্প্রতি বার্ধক্যজনিত কারণে সেতুর স্বপ্ন বুকে চেপে সুফিয়া বেগম স্মৃতি বিজরিত বিলহরিবাড়ি গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরপাড়ে। চলে গেছে সুফিয়ার শবযাত্রাও, তবে নৌকায় নয়। জীবনের চরম পর্যায়ে সুফিয়া বেগমের লাশটি কবরস্থানে নেয়া হয়েছে ‘কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে’। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই গ্রামের বাশিন্দা শতবর্ষী রহিম ব্যাপারীও চিরতরে চলে গেছেন গ্রাম ছেড়ে। গতকাল শুক্রবার তার শবযাত্রা কবরস্থানে নেয়া হয় নৌকায় করে। সুফিয়া বেগম আর রহিম ব্যাপারীর এ গল্প জানাচ্ছিলেন ওই গ্রামের ষাটোর্ধ আবুল মিয়া। প্রয়াত সুফিয়া বেগম, রহিম ব্যাপারীর বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের বিলহরিবাড়ি গ্রামে।
একটি সেতু ও সাড়ে তিন কিলোমিটার কাঁচা সড়কের আক্ষেপ শুধু সুফিয়া বেগম রহিম ব্যাপারী আর আবুল মিয়ার নয়। প্রায় ৫ হাজার জনসংখ্যা বেষ্টিত এই বিলহরিবাড়ি গ্রামের উত্তরপাড়াবাসীর। সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষের দুঃখ জড়িত গল্প পোঁছায়না উচ্চ পর্যায়ে। বেঁচেও মরার মতো অধ্যায়কে সঙ্গী করে এভাবেই দিন কাটাচ্ছেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, প্রবাহমান ওই নালা বিলহরিবাড়ি-হরদমা গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে গ্রামটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। দুর্গাপুর-যোগেন্দ্র নগর রাবারড্যাম হয়ে একটি পাকা সড়ক ওই নালার দক্ষিণপাড়ে এসে শেষ হয়েছে। নালার দক্ষিণপাড়ে জনবহুল হরদমা গ্রাম। এখানে রয়েছে প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও বাজার। সুবিধাবঞ্চিত এ উত্তরপারের মানুষদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ যাবতীয় প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়। দুভোর্গ এড়াতে এলাকাবাসী নিজ উদ্দ্যোগে ওই নালার বিলহরিবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় পয়েন্টে ছোট্ট একটি খেয়া নৌকা রেখেছেন। তবে কোন মাঝি নেই। সাড়ে তিন কি.মি. কাঁচা সড়কের কাদা মাড়িয়ে ওই নালা পার হয়ে তারা ওই সব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এছাড়া উত্তরপাড়ের মানুষের জেলা শহরসহ বিভিন্ন এলাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী একমাত্র মাধ্যমও এটি।
বিলহরিবাড়ি গ্রামের হালিমা বেগম (৫৫) বলেন, কিছুদিন আগে গর্ভবতী এক নারীর প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। কিন্তু বাড়িতে জন্মদানের কাজ করা সম্ভব হয় নি। সড়কটি কাঁচা হওয়ায় কোন যানবাহন পাওয়া যায় নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার জন্য স্থানীয়রা কোন রকমে ওই নালা পর্যন্ত নিয়ে আসেন। কিন্তু পাড়াপারের জন্য নৌকা না থাকায় ওই গর্ভবতীকে হাসপাতালে নেয়া যায় নি। সেখানেই সন্তান জন্মদানের কাজ করতে গিয়ে প্রচ- রক্তক্ষরণের পর মেয়েটির মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রা জানান, উত্তরপাশের বিলহরিবাড়ি গ্রামের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে অতিকষ্টে সাড়ে তিন কিলোমিটার কাদাযুক্ত কাঁচা সড়ক ও ওই নালা পারাপার হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই দুর্ভোগ নিয়ে পারাপার হলেও জনপ্রতিনিধিরা কাঁচা সড়কটি পাকাকরণ ও সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন বহুবার। কিন্তু আশ্বাসেই শেষ, এলাকাবাসীর ভাগ্যোন্নোয়নে ৪৩ বছরেও তা নির্মিত হয় নি।
বিলহরিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী, আরিফুল, সান্তা, মরিয়ম, আঁখি ও শাপলা জানায়, বিদ্যালয়ে যেতে কাঁচা সড়ক ও নৌকায় পার হতে হয়। কাঁদাযুক্ত পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক সময় পা পিছলে পড়ে যায়। এজন্য প্রতিদিন বাড়তি পোষাক নিয়ে তারা বিদ্যালয়ে আসে।
বিলহরিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোজাফফর হোসেন বলেন, বিলহরিবাড়ি গ্রামের সড়কটি কাঁচা ও তুলনামূলক নিচু হওয়ায় বছরজুড়েই পানি জমে থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসতে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তাছাড়া বর্ষাকালে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কম হয়। তাছাড়া আএাই নদীর দূর্গাপুরÑযোগেন্দ্র নগর পয়েন্টে রাবারড্যাম থাকার কারণে বর্ষা এবং শুস্ক মৌসুমেও পানি থাকায় নালাটি বচরজুড়েই প্রবাহমান থাকে। এ কারণে শত শত ছাত্র-ছাত্রী ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করে। এতে করে বিলহরিবাড়ি এলাকার লোকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় বছরজুড়েই। নৌকার ওপর ভর করে চলছে এই গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য বেলাল হোসেন বলেন, ‘সড়কটির বেহাল অবস্থার কারণে কৃষকদের পণ্য পরিবহনে বাড়ে অসহোনীয় ভোগান্তি। বিশেষ করে ইরি-বোরো মওসুমে ধান বহনকারী গরু ও মহিষের গাড়ি কোন রকমে সড়ক বয়ে আসলেও ওই নালা পারাপারে দুর্ভোগ দেখা দেয়। তাছাড়া প্রসূতি ও অসুস্থ্যরা সময়মতো চিকিৎসা সেবা না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ চেয়ে এলাকাবাসী গণস্বাক্ষরে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত আবেদন করেছেন। তারা ওই কাঁচাসড়ক এবং সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।’
বিয়াঘাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রভাষক মো. মোজাম্মেল হক বলেন,  ‘সেতু না থাকায় নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীসহ বিলহরিবাড়ি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পারাপার হন। তাছাড়া সড়কটি কাঁচা আর নিচু হওয়ায় বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকে। এতে এই গ্রামের মানুষ চরম ভোগান্তি নিয়ে বসবাস করেন। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছি। এখনো বরাদ্দ পাই নি। বরাদ্দ এলে বিলহরিবাড়ি গ্রামের মানুষের ভোগান্তি লাগবের জন্য কাঁচাসড়কটি পাকাকরণ ও সেতু নির্মাণের ব্যাপারে নজর দেয়া হবে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সাংসদ নাটোর জেলা আ’লীগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস বলেন, অচিরেই ওই গ্রামের মানুষের সুবিধার্থে বিলহরিবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় পয়েন্টে একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। সেতু হলেই কাঁচা সড়কটিও পাকাকরণ করা হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ