নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে মাঠে নেমেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাদের অবস্থানের কারণে আন্দোলনকারীরা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র রেলগেট এলাকায় আসেননি। তারা নগরীর তালাইমারী হয়ে ভদ্রা পর্যন্ত আসার পর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ফিরে গেছেন।
এদিকে মোহনপুরে উপজেলা সদরে রোববার (৪ আগস্ট) দুপুরে ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে একদল বহিরাগত। উপজেলা সদরে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলে নজিরবিহীন এ তান্ডব। এ সময়ে বহিরাগতরা মোহনপুর থানা, উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ইউএনও অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, সরকারি খাদ্য গুদাম ও থানা সংলগ্ন ১৫টি দোকানে আগুন দিয়েছে। এদিকে গোদাগাড়ীতে আন্দোলনকারীরা একটি বাস ভাঙচুর করেছে।
এর আগে রোববার (৪ আগস্ট) সকাল ১০টা থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরুর প্রথম দিন আন্দোলনকারীরা রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সামনে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তারা তালাইমারী মোড় হয়ে ভদ্রায় আসেন। তালাইমারী মোড় ও ভদ্রা এলাকায় পুলিশের লাগানো কয়েকটি সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন তারা।
আগের দিন শনিবার আন্দোলনকারীরা একইভাবে রুয়েটের সামনে থেকে ভদ্রা হয়ে রেলগেট পর্যন্ত আসেন এবং বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালান। এ জন্য আজ আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাদের প্রতিরোধের জন্য রেলগেট এলাকায় অবস্থান নেন।
এদিকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে শিক্ষার্থীদের হাতেও ছিল লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক, লোহার পাইপ ও রড। দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা আর সামনে না এগিয়ে ফিরে যান। তারা দুপুর ১২টার দিকে ভদ্রায় আসেন এবং ১টার দিকে ফিরে যান। উত্তেজনা থাকলেও রেলগেট কিংবা ভদ্রা এলাকার কোথাও পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
ভদ্রা এলাকায় আন্দোলনকারীরা সাংবাদিকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। তাদের কয়েক দফা ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে দেয়। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা-কর্মীদের দেখা গেছে। মিছিলে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। যুবদলের রাজশাহী মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম জনিকে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে তার মোবাইলে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়।
রেলগেট এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আগের দিন এই রেলগেটে জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছবি ভাঙচুর করা হয়েছে। এটি কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না। যারা মুক্তিযুদ্ধ মানে না, বঙ্গবন্ধু-জাতীয় চার নেতাকে মানে না, এটি তাদের কাজ। এরা শিক্ষার্থীদের ওপর ভর করে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখছে। তাদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা হবে। এ জন্য দলের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
নগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার জামিরুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনরতরা সকাল থেকে বিক্ষোভ করলেও পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকারি স্থাপনা ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কেউ জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা করলে পুলিশ তা প্রতিরোধ করবে।
আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে মোহনপুর থানার দুটি পিকআপ, এসিল্যান্ডের একটি সরকারি গাড়ি ও থানার ভেতরে থাকা ২৫টি মোটরসাইকেল। পরে দমকল বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
রাজশাহী-৩ (মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ নজিরবিহীন তান্ডবের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, যারা এই তান্ডব চালিয়েছে তারা কেউই ছাত্র নয়। পার্শ্ববর্তী বাগমারা, মান্দা, আত্রাই, রানীনগরসহ আশেপাশের এলাকা থেকে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা এসে মোহনপুরে নজিরবিহীন তান্ডব চালিয়েছে। আসাদ বলেন, দুই ঘণ্টাব্যাপী সহিংসতার পরও পুলিশ ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। আমরা এমন ধ্বংসযজ্ঞ মানতে পারছি না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল পৌনে ১১টার দিকে একদল বহিরাগত ভটভটি, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলযোগে বিভিন্ন দিক থেকে এসে মোহনপুর সরকারি কলেজের সামনে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের ওপর সশস্ত্র অবস্থান নেন। এ সময়ে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বাঁশের লাঠি ও লোহার রড হাতে বহিরাগতরা প্রথমে মহাসড়ক সংলগ্ন মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ঘেরাও করে ব্যাপক ভাঙচুর করে ও পরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এদিকে পরে বহিরাগতরা মোহনপুর থানায় ঢুকে প্রথমে ওসির পিকআপ ও পুলিশের আরেকটি টহল পিকআপে আগুন ধরায়। থানার বাউন্ডারি লাগোয়া ১৪ থেকে ১৫টি দোকানেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানার ভেতরে বিভিন্ন মামলার আলামত ও পুলিশ অফিসারদের ব্যবহৃত ১৫টি মোটরসাইকেল ও ছোট যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ সময় থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্য মূল ভবনের কলাপসিবল গেইট লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করেন। বহিরাগতরা তান্ডব চালিয়ে পরে ছুটে যায় উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের ভেতরে অবস্থিত এসি ল্যান্ডের অফিসে। সেখানে অফিসের সামনে থাকা এসি ল্যান্ড ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের একটি সরকারি গাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় তারা।
বহিরাগতরা মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ভবনের কয়েকটি কক্ষে ভাঙচুর চালায়। প্রায় দুই ঘণ্টাকালব্যাপী তান্ডব চালিয়ে বহিরাগতরা মহাসড়ক ধরে কেশরহাটের দিকে চলে যায়। পরে দমকল বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি এসে আগুন নেভানোর কাজ করেন।
মোহনপুর বাজারের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেন, নজিরবিহীন তান্ডব চালানো হলেও পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা থানার ভেতরে গেইট লাগিয়ে অবস্থান করেন। এ সময়ে বহিরাগতরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দেন। থানা ভবনের মূল ফটক ভাঙার চেষ্টা চালায়।
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, তিন শতাধিক বহিরাগত রোববার সকাল থেকেই মোটরসাইকেল ও ভটভটিতে করে এসে মোহনপুর সরকারি কলেজের সামনে মহাসড়কে অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমরা পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু একজন পুলিশও থানা থেকে বের হননি।
তান্ডব শেষ হলে জেলা পুলিশের সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএইচএম এরশাদ আলী মোহনপুর থানায় গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হরিদাস মন্ডল বলেন, হামলাকারীর থানার ভেতরের গ্যারেজে থাকা পুলিশের দু’টি পিকআপ ও থানা প্রাঙ্গণে থাকা বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দিয়েছে। সরকার খাদ্য গুদাম, আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে এসি ল্যান্ড ও ইউএনও অফিস। আমরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আছি। ওসি আরও বলেন, হামলাকারীরা ছাত্র বলে আমাদের মনে হয়নি। অধিকাংশই আসে হামলা করতে।
মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, খুবই খারাপ কিছু ঘটেছে। তাদের টার্গেট ছিল সরকারি স্থাপনায় হামলা করা। আমার অফিসেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। আমাদের এসি ল্যান্ডের গাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসি ল্যান্ড অফিসেও ভাঙচুর ও নথিপত্র তছনছ করা হয়েছে।
এদিকে রোববার দুপুরে গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ি এলাকায় একটি বাস ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। বাসটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে যাত্রী নিয়ে রাজশাহীতে আসছিল। গোদাগাড়ী পার হওয়ার পর মহিষালবাড়ি পৌছালে বাসটি থামিয়ে ভাঙচুর চালানো হয়। বাসটির সুপারভাইজার আবদুল হালিম বলেন, বাসে যাত্রী ছিল। তারা আতঙ্কিত হয়ে বাস থেকে নেমে ছোটাছুটি করতে থাকে। লোহার রড, পাইপ, লাঠি দিয়ে বাসের কাঁচ ভেঙে দেওয়া হয়।
গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুল মতিন জানান, একটি বাস ভাঙচুর হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কেউ থানায় অভিযোগ দেয়নি। কারা সেখানে ছিল তা খোঁজ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।