শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজশাহীর পদ্মায় মেলেনা বড় আকারের ইলিশ। মৌসুমে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ছোট ছোট জাটকা। ১৯৭০-এর দশকে রাজশাহীর পদ্মায় জেলেদের জালে ধরা পড়ত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। আকারে বড় ও স্বাদে ছিল অতুলনীয়। শুধু তাই নয়, দামে কম ও সহজলভ্য থাকায় সবশ্রেণির মানুষ ইলিশ খেতেন। কিন্তু পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে পানির প্রবাহ কমে যায়। পানির প্রবাহের সাথে কমতে থাকে ইলিশের পরিমাণ। এখন কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে।
জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের মধ্যে পাবনার ঈশ্বরদী ও সুজানগর এবং সিরাজগঞ্জের চৌহালী এলাকায় বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে ইলিশের প্রাচুর্য বেশি। আর রাজশাহী জেলার মধ্যে চারঘাট, বাঘায় বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। রাজশাহী বিভাগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫০৭ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৩৫ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৪১ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৮১ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০০ মেট্রিক টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৯২ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার পবা, চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মায় ইলিশ পাওয়া যায়। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি চারঘাটে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চারঘাটে ৩ হাজার ২০০ কেজি ইলিশ ধরা পড়েছে। আর আগের মাস আগস্টে ২ হাজার ৮৩০ কেজি এবং জুলাই মাসে ধরা পড়েছে ১ হাজার ৪৪৬ কেজি ইলিশ।
চারঘাটের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওয়ালী উল্লাহ মোল্লাহ বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবছর সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে। তবে আকৃতিতে ছোট। পাঁচ থেকে ছয়টা মিলে এক কেজি হয়। বড় ইলিশ ধরা পড়ে মাঝে মাঝে। ইলিশ সেভাবে নিচু এলাকা থেকে উজানে আসে না। বিশেষত নদীতে পানির গভীরতা কমে যাওয়া, বাঁধ দেওয়া, ফিল্টারেশন বেশি হওয়া (ড্রেজিংয়ের কারণে পানিতে বালুর পরিমাণ বেড়ে পানি ঘোলা হয়ে যাওয়া) কারণে ইলিশ আসা কমে গেছে। পানির গভীরতা ২০ থেকে ২৫ ফুট না হলে মাছ আসতে চায় না। এলেও চলে যায়।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একসময় পদ্মায় প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। এখন পানির গভীরতা কমে যাওয়া, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন, বাঁধ দেওয়া, নদীতে ভাটির দিকে অত্যাধুনিক জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে রাজশাহীর এলাকায় ইলিশ কমে গেছে। তবে এখন জাটকা সংরক্ষণ প্রকল্প চালু ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলে ইলিশের পরিমাণ বাড়ছে।
এ বিষয়ে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ইলিশ মাছ দ্রুত বেগে ছুটে উজানের দিকে যেতে পছন্দ করে। মাছগুলো চলাচল করে ঝাঁকে ঝাঁকে। একেক ঝাঁকে শত শত ইলিশ থাকে। পাকিস্তান আমলেও বঙ্গোপসাগর থেকে উজানে রাজশাহী হয়ে ভাগলপুর পর্যন্ত যেত ইলিশ এবং ডিম ছাড়ত। চারঘাট থেকে পদ্মার শাখা বড়াল নদীর বাঘার আড়ানীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। তখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঘরেই ইলিশ পাওয়া যেত।
বাঁধের কারণে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় স্রোতও কমে যায়। ফলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে যায়।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসাইন বলেন, পদ্মার ইলিশ ছিল বড় এবং স্বাদে অনন্য। এখন সেই বড় ইলিশ নেই, স্বাদও নেই। মেঘনা, যমুনা, সুরমা ও কুশিয়ারার মতো নদীতে ইলিশ বাড়লেও পদ্মায় বাড়েনি। এর কারণ, পদ্মার স্বাভাবিক খরস্রোতা বা যৌবন হারিয়ে গেছে। পদ্মায় ইলিশ ফেরাতে হলে এ নদীতে খরস্রোতা বা নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
অধ্যাপক ইয়ামিন হোসাইন বলেন, গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, এখন ইলিশের প্রজনন মৌসুমেও (অক্টোবর-নভেম্বর) রাজশাহীর পদ্মায় বড় ইলিশ পাওয়া যায় না। এ কারণে রাজশাহীর ইলিশের ওজন সাধারণত ২০০ থেকে ৩০০ গ্রামের বেশি হয় না। ভারতের সঙ্গে যৌথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে ইলিশ ফেরানোর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিতে আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।