জাতীয় নেতার শেষ যাত্রা

আপডেট: ডিসেম্বর ১, ২০২২, ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীন শেখ ভুলু:


১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টা। রাজশাহী পুলিশ লাইন মসজিদের দক্ষিণ পাশে রোলকল মাঠে বটগাছের নিচে বসে আছি। স্ট্যান্ডবাই ডিউটি। আমার গ্রুপের ৪ জন সেপাই নাস্তা করতে গেছেন। ওরা ফিরে আসলে আমরা নাস্তা খেতে যাবো। পুলিশ লাইনে ভিতরে তেমন লোকজন নাই। থমথমে ভাব। সামনে ম্যাগজিন গার্ড (অস্ত্রাগার)। ভিতরে একজন সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আরআই (রিজার্ভ অফিসার) এর অফিস থেকে ফোর্স-সুবেদার বাঁশি বাজাতে বাজাতে আমার দিকে দ্রুত হেঁটে আসছেন। আমি হতভম্ব। দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। মুহূর্তে এসপি আবু তালেব সাহেব জিপে করে উপস্থিত হলেন। তিনিও বেশ উদ্বিগ্ন- অস্থির। তিনি উত্তেজিত, ফোর্স-সুবেদারকে বললেন, ইমারজেন্সি ফোর্স কোথায়? পিক-আপ রেডি কর এবং ফোর্সদের উঠতে বলো।
ওইসময় সঙ্গী ফোর্সদের অর্ধেক নাস্তা করতে গেছেন। ততক্ষণে পিকআপ চলে এসেছে। এসপি সাহেব অস্ত্র রেখেই গাড়িতে উঠে বসতে বললেন। আমি সহ ৫ জন পিক-আপে উঠে বসলাম। এসপি সাহেব তাঁর গাড়িকে ফলো করতে বললেন। আমাদের আর নাস্তা করা হলো না।
এসপি সাহেবের জিপের পেছনে পিকআপ দক্ষিণ দিকে (নদীর দিকে) যেতে থাকলো। পুলিশ লাইনের গেটের কাছে আসতেই পূর্বদিক থেকে বিকট আওয়াজ তুলে একটি হেলিকপ্টার উড়ে আসতে দেখা গেল। বর্তমান কেন্দ্রীয় উদ্যানের হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টারটি অবতরণ করলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জলপাই রঙের বিশাল হেলিকপ্টার। আমাদের গাড়ি হেলিপ্যাডের কাছে গিয়ে থামলো। এসপি সাহেব আমাদের গাড়ি থেকে নামতে বললেন। তিনিও তাঁর জিপ থেকে নামলেন। আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকলো। হেলিকপ্টারের পাখা তখনও শব্দ করে ঘুরছে। খুব জোর বাতাস বইছে। দাঁড়িয়ে থাকাও দায়। এসপি সাহেব আমাকে বললেন, হেলিকপ্টারের দিকে যেতে। আমি দুই সঙ্গী নিয়ে মাথা নিচু করে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম। হেলিকপ্টরের পাখা প্রচ- বেগে ঘুরছে, বিকট শব্দ। অন্য কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কাছে যেতেই হেলিকপ্টারের দরজা খুলে গেল। একটা সিঁড়ি বের হয়ে এলো। একজন সেনাসদস্য কপ্টারের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলেন। আমাদেরকে ইশারা করে কপ্টারের দরজার কাছে ডাকলেন। এরপর তিনি আবারো কপ্টারের ভেতর প্রবেশ করলেন। কপ্টারের ভিতরে দেখলাম আরো সৈন্য আছেন। তারা ভারি অস্ত্রসজ্জিত। প্রথম সেনাসদস্য ভেতর থেকে একটি কফিন ঠেলে কপ্টারের দরজার কাছে নিয়ে আসলেন। আমাদের নামাতে বললেন। আমরা ধরাধরি করে নিচে নামালাম। আমার পিছনে এস,পি সাহেব দাঁড়িয়ে। তিনি কফিনের ঢাকনা খুলতে বললেন। কীভাবে খুলবো বুঝতে পারছিলাম না। কফিন পেরেক দিয়ে আঁটকানো। আমার কোমরে বেল্টে ঝুলানো রাইফেলের বেয়নেট আছে। তাই দিয়েই ঢাকনা খুলে ফেললাম। এসপি সাহেব আমার কাঁধের উপর দিয়ে দেখছেন, আমরাও দেখছি- কফিনের ভেতর চা-লিকার দিয়ে ঢাকা একটি মরদেহ। কাফন পরানো মৃতদেহ। শুধু মুখম-লের একাংশ দেখা যাচ্ছে, মাথাটা ডান দিকে কাত করা। কপ্টার যে দিকে দিয়ে এসেছিল, উড়ে সেদিকেই চলে গেল।
এসপি সাহেব হাত-ইশারা করলেন। কফিন পিকআপে তোলা হলো। কফিনটি এতো ভারি যে পিকআপে তুলতে আমরা হিমশিম খেলাম। আমরাও পিকআপে উঠে বসলাম। গাড়ি নদীর ধার দিয়ে পূর্বদিকে চলতে শুরু করলো। সামনে এসপি সাহেবের জিপ। গাড়ি আসতে আসতে চলতে থাকলো। আমি কফিনের পাশে বসে। বেশ উদ্বিগ্ন। তখনও বুঝতে পারিনি মরদেহটি কার! মরদেহের মুখের যতটুকু দেখেছি তাতে বুঝে ওঠার মত ছিল না। তবে এটা নিশ্চিত হচ্ছি যে, নিশ্চয় কোনো বড় মাপের মানুষের লাশ হবে। দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতিও মনে বেশ উৎকণ্ঠা জাগাচ্ছিল। এই তো আড়াই মাস আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অবশ্য ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতাকেও হত্যা করা হয়েছে। তবে চারনেতার হত্যাকা- নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। ওই সময় সারা দেশ সংশয় আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
যাহোক, আমাদের শববাহী গাড়ি পুরাতন পোস্ট অফিস হয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাশ দিয়ে সদর হাসপাতাল হয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে পূর্ব দিকে চলতে শুরু করলো। শহর বেশ থমথমে। লোক চলাচল খুবই কম। যারা প্রয়োজনে বের হয়েছেন তাদের চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অবাক-বিস্ময়ে আমাদের গাড়ি দেখছিলেন। শববাহী গাড়ি মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ডানপাশ দিয়ে গিয়ে মহিলা কলেজের উত্তরপাশে কাজিরগঞ্জে সরু রাস্তার এক স্থানে এসে থামলো। এবার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। এ লাশ আমাদের জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবের। অর্থাৎ জেলহত্যা-ের ঘটনা সঠিক বোঝা গেল। এসপি সাহেব আমাদের গাড়ি থেকে কফিন নামতে বললেন। তিনি উত্তরদিকে একটি ফাঁকা স্থানের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাকে বললেন, কবর খুঁড়তে হবে। উচুনিচু ফাঁকা একটি স্থান। ছোট ছোট গাছ, ঘাস লতাপাতায় ভরা। একদিকে ভাংড়ি ইটের স্তুপ। সামনেই এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি এসপি সাহেবকে স্থানটি দেখালাম। তিনি সম্মতি দিলেন। কিন্তু কবর খুঁড়বো কীভাবে?
আশেপাশে বসবাসরত বাসিন্দাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয় ও আতঙ্কে তারা ঘরের মধ্যে চুপচাপ। কবর খোঁড়ার জন্য কোদাল লাগবে, পাবো কোথায়? পূর্বদিক বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়ার ওপারে একটা ছোট খড়ির আড়ত মনে হলো। সেখানে লোকজন আছে দেখলাম। আমি সিপাইদের কবরের জন্য নির্দিষ্ট স্থান পরিস্কার করতে বলে আড়তের দিকে গেলাম। দেখলাম বেশ কয়েকজন উকিঝুঁকি দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। তাদের মধ্যে কয়েক জনকে চিনতে পারলাম। এই মুহূর্তে তাঁদের সবার নাম মনে করতে পারছি না। তবে মনে আছে, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম, তাঁকে পুলিশ লাইনের যুদ্ধের আগে দেখেছিলাম। অপরজন আওয়ামী লীগ নেতা হাজি রফিক উদ্দিন আহমেদ। তাঁদের বললাম, একটা কোদাল ও শাবল ব্যবস্থা করে দিতে। তাঁরা আড়তের ভেতর থেকে একটা কোদাল এনে দিলেন। আমি বললাম, এ কোদাল দিয়ে কবর খনন করা যাবে না। বেশ নড়বড়ে। হাতলের সাথে মজবুত করে লাগানো নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম বললেন, আমি ভাল কোদাল-শাবল জোগাড় করে আনছি। তিনি কোদাল-শাবল আনতে গেলেন। নড়বড়ে কোদালসহ আড়তের এক শ্রমিককে নিয়ে আমি নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসলাম। লোকজনের সাথে কথা বলার সময় এসপি সাহেব তা গভীর কৌতুহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
কবর খোঁড়ার জন্য মাটিতে কোপ দিলাম কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এই কোদাল দিয়ে কবর খোঁড়া সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম বেড়ার ওপার থেকে আমাকে কোদাল নিয়ে যেতে বললেন। ইতোমধ্যেই বেড়ার ওপারে দু’একজন করে আরো কৌতুহলি মানুষ অপেক্ষা করছেন। এপারে কাউকে আসতে দেয়া হচ্ছে না। একজনকে দিয়ে কোদাল পাঠাতে বললাম। ওই সময় দেখলাম মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রাম রতন চারজন ফোর্স নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। এস.পি সাহেব তাদের একটা ধমক দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে বললেন। তারা দৌড়ে আমাদের দিকে আসতে লাগলেন। এসময় কবর খোঁড়ার জন্য আনা দুই শ্রমিক ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। প্রাণভয়ে রীতিমত কাঁপতে শুরু করলেন। আতঙ্ক চোখেমুখে- এদিক ওদিক ফ্যালফ্যাল তাকাতে লাগলেন। আমি তাদের আশ্বস্ত করলাম, সাহস যোগালাম। রাম রতন হাবিলদারকে বললাম, আপনারা ইটের ভাংড়ি সরানোর ব্যবস্থা করেন। আমি গাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।
এরইমধ্যে পূর্বদিক থেকে বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) এর সশস্ত্র সেনা বোঝাই গাড়িবহর সেখানে এসে পৌঁছলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে সৈন্যরা নেমে চারদিকে পজিশন নিল। সামনের জিপ থেকে একজন অফিসার নেমে এসপি সাহেবের সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি তাঁদের পাশ কাটিয়ে কফিন রাখা পিক্আপের কাছে গেলাম। দেখলাম খালিল খান বিহারী (এসপি সাহেবের বডিগার্ড) কফিনের উপর পা তুলে বসে আছে। আমার মাথায় রক্ত চড়ে বসলো। তাকে ধমকের ভাষায় বললাম, ‘তুমি জানো কফিনের ভীতর কে আছেন?’ ইতরের বাচ্চা ইতর বললো- ‘হামনে কিয়া কিয়া?’ তার কথায় মেজাজ হারালাম। তাকে আক্রমণে উদ্যত হলাম। এ সময় আমাদের পিকআপ ড্রাইভার ইসহাক হাত ধরে থামালেন। মাথা ঠান্ডা রাখতে বললেন।
সেই মূহূর্তে গাড়ির অপরদিকে এসপি সাহেবের অপর বডিগার্ড হাবিলদার কুমদরঞ্জন দাসও দ্রুত এসে আমাকে থামালেন। বললেন, তুমি শান্ত হও। ওই বিহারির বাচ্চা কি বুঝে? কুমদরঞ্জনের বাম হাত ভাঙ্গা। গলার সাথে ব্যান্ডিস দিয়ে ঝোলানো। সেই অবস্থাতেও তাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যাহোক, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।
এর মধ্যে এসপি সাহেব আমাকে কফিন নামিয়ে তাঁর সামনে নিতে বললেন। কফিন নামিয়ে তাঁর জিপের সামনে রাখলাম। এসপি সাহেব খালিল খানকে ধমক দিয়ে সরে যেতে বললেন। আমাকে কফিনের ঢাকনা খুলতে বললেন। আবারো বেয়নেটের সাহায্যে কফিনের ঢাকনা খুলে দাঁড়াতেই দেখি আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে মরদেহ দেখছেন বিডিআর-এর কর্নেল সাহেব। তিনি মরদেহ দেখার সাথে সাথেই বললেন কফিনের ঢাকনা লাগিয়ে দিতে। তিনি লাশ দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলেন না। তিনি পিছু হটে দাঁড়ালেন। ওই সময় আমি সিনিয়র হাবিলদার। সাধারণত অফিসারদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার প্রচলন পুলিশে নেই। তবুও কৌতুহল আটকাতে পারলাম না। আমি বিডিআর কর্মকর্তার অবয়বের দিকে তাকালাম। এক অভাবিত দৃশ্য- যা দেখে আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলাম। প্রথমতঃ আমি ওই কর্মকর্তাকে চিনতে পারলাম। তার র‌্যাংক দেখে বুঝলাম তিনি লেফটেনেন্ট কর্নেল পদের কর্মকর্তা।
তিনি হলেন, আমার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার মেজর রশিদ। চোখে কালো রঙের চশমা। চশমার ফাঁক গলে চোখের পানি বাঁধ মানছে না। আমি হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো এসপি সাহেব এ বিষয়টি খেয়াল করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কর্নেল সাহেব আমাকে চিনলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি? আমি বললাম, পারিবারিক কারণে পুলিশ বাহিনীতে ফেরৎ এসেছি স্যার। তিনি এসপি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এ খুব স্মার্ট বয়, এর দিকে খেয়াল রাখবেন। চোখের পানি লুকানোর প্রবণতা বেশ স্পষ্ট। এসপি সাহেব বললেন, ইয়েস স্যার! লেফটেনেন্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ সাহেবকে জিয়া হত্যাকা-ের প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
খেয়াল করলাম, কর্নেল রশিদ রাস্তা থেকে উত্তর দিকে দ্রুত কিছু দূর গিয়ে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। আর এসপি সাহেব তার গাড়ির পিছনে দুই সিভিলিয়নের সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি কবর খননের কাজের দিকে এগুলাম। ওই সময় দেখলাম, কয়েক জন লোক খড়ির আড়ত এর দিক থেকে বের হয়ে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন। উত্তর দিক থেকে ক’জন বয়স্ক নারীও এগিয়ে আসছেন। বিডিআর-এর এক সুবেদার তাদের রাস্তা আগলে দাঁড়ালো। একজন নারী উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে সুবেদারকে ধাক্কা মেরে আমাদের দিকে আসতে থাকলো। কর্নেল সাহেব হাত ইশারা করে সুবেদারকে থামতে বললেন। নারীদের পথ ছেড়ে দিতে বললেন। নারীরা কফিনের কাছে আসলেন। পরিস্থিতি তখন আরো থমথমে হয়ে উঠলো। জানিনা ওই নারীরা কারা। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নারীরা শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামানের স্বজন হবে। বেড়ার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের কৌতুহলের শেষ নেই। এসপি সাহেব তার জিপের আড়ালে চলে গেলেন। আমিও পিক-আপের আড়ালে দাঁড়ালাম। কর্নেল সাহেব নিজে কফিনের ঢাকনা খুলে মরদেহ দেখতে দিলেন ওই নারীদের। তখন নারীরা সমস্বরে কেঁদে উঠলেন। হৃদয়-বিদারক কাঁন্না। তাঁদের আজাহারিতে মুহূর্তে বাতাস ভারি হয়ে উঠলো।
তখন দুপুর ১ টা বেজে গেছে। সকালে নাস্তা হয়নি- প্রচ- ক্ষুধা পেয়েছে। ওই মুহূর্তে পকেটে একটা টাকাও নেই যে, দূর-পাশের কোনো দোকান থেকে কিছু একটা কিনে খাবো। আবেগঘন এই পরিবেশ থেকে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ক্ষুধা-তিব্রতায় হাঁটতেও পারছিলাম না। রাস্তার ডানে একটা পুকুর (পুকুরটি এখনো আছে), পুকুরের পূর্বে উত্তরদিকে পায়েহাটা পথ চলে গেছে। আমি সে দিকে হাঁটা ধরলাম। রাস্তায় কোনো মানুষ দেখলাম না। এমন কী বাড়িঘর থেকে মানুষের কোনো সাড়াশব্দও নেই। কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা সংলগ্ন পশ্চিমে মসজিদ। উত্তর ও পশ্চিমে বাড়িঘর আছে। ওইসব ঘরবাড়িতে মানুষজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। ভয়-আতঙ্কে ঘরের বাসিন্দারা নিরব।
রাস্তার শেষে জমিদারি স্টাইলে গেট। ওই গেট মাড়িয়েই বড় একটি ভবনে ঢুকতে হবে। ওই বাড়ির দরজা খোলা ছিল। আমি ওদিকে তাকাতেই ঘরের মধ্য থেকে ধোয়া বের হতে দেখলাম। আগুন লেগেছে কী, কৌতুহল! ভিতরে ঢুকে দেখলাম বিরাট আঙিনা। উত্তরপাশের্^ পূর্ব-পশ্চিম লম্বা একটা ঘর থেকে ধুয়া বেরুচ্ছে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি সেখানে বড় বড় চুলা। বেকারির কারখানার মত। একদিকে লম্বা একটা টেবিল। ধুয়ার উৎস হলো, কিছুক্ষণ আগেও লাকড়ির চুলা জ্বলছিল; তাতে কেউ বা পানি ঢেলে দিয়েছে। ওই বাড়িতে কেউ নেই। অর্থাৎ পরিস্থিতি দেখে ঘরের লোকেরা সবাই পালিয়ে গেছেন। যাওয়ার সময় পানি ঢেলে চুলা নেভানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু ভালভাবে নেভানো সম্ভব হয়নি। আমি চুলা থেকে লাকড়িগুলি বের করে নিভিয়ে দিলাম।
আসলে সেটি বড় আকারের রান্নাঘর ছিল। ডালিতে ভাত, গরম- ধোয়া উঠছে। একটা অ্যালমোনিয়ামের বড় ডালায় মাছ রান্না। আরেক পাত্রে কাটা সবজি। খাবার খোলা ছিল। খাবার দেখে আমার ক্ষুধা আরো তুঙ্গে উঠলো। নিজেকে সামলাতে পারলাম। একটি থালায় ভাত মাছ নিয়ে দাঁড়িয়েই খেলাম। বেশ স্বস্তি পেলাম।
খেতে খেতে ভাবছিলাম, কার বাড়ি? রাজশাহী অঞ্চলের মরহুম লাল মোহাম্মদ জমিদারের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো। তিনি শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামানের দাদা। কামারুজ্জামান সাহেব এ বছরের (১৯৭৫) প্রথম দিকে রাজশাহীতে শেষবারের মতন এসেছিলেন। আমরা তার প্রোটেকশন ডিউটিতে নগরবাড়ী ঘাট গিয়েছিলাম। তাঁকে পাহারা দিয়ে রাজশাহী সার্কিট হাউস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। ওই দিনের স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। মনটা হুহু করে উঠলো।
ফেরি থেকে তিনি নামলেন। গাড়িতে ওঠার আগে তাঁকে আমরা গার্ড অব অনার জানালাম। তিনি আমাকে চিনলেন। আর্শ্চয হলাম তাঁর স্মরণশক্তি দেখে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুর্শিদাবাদের কাজিপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তিনি আমার নাম ও বাবার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন। এতো বছর পরও আমাকে দেখে তিনি চিনলেন। আমরা গাড়িতে উঠলাম। ডিএসপি সাহেব বললেন, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় তোমাকে ডাকছেন। আমি তাঁর গাড়ির কাছে গেলে তিনি গাড়ির সামনের সিটে বসতে ইশারা করলেন। আমি ইতস্তত। মাথানিচু করে আদেশ পালন করলাম। নিরাহংকার মিষ্টভাষি মানুষ ছিলেন রাজশাহীর ‘হেনাভাই’। কী দুর্ভাগ্য আমার! আজ সেই মহান মানুষের মরদেহ বয়ে আনলাম! কী অভাগা আমরা। এর জন্য অবশ্যই জাতিকে একদিন ভুগতে হবে।
ভাত খাওয়া শেষ হলে বালতির পানি দিয়ে থালা পরিস্কার যথাস্থানে রেখে রান্নঘর থেকে বের হয়ে উঠানে দাঁড়ালাম। বাড়ির দরজা-জানালা সব খোলা। বাড়ি থেকে বের হয়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে সোজা কবরের স্থানে গিয়ে পৌঁছলাম। কিছু লোক কবরের শেষ কাজ সম্পন্ন করার জন্য গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কবরে মাটি দিচ্ছেন। আমিও হাতের অঞ্জলি ভরে মাটি তুলে কবরের ওপর দিলাম। একজন সিপাই আমাকে বললো, এসপি সাহেব আমাকে খোঁজ করছিলেন। রাস্তায় যেখানে এসপির গাড়ি, সেদিকে তাকালাম। এস,পি সাহেব তার জিপের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওয়্যারলেসে কারো সাথে কথা বলছেন। লে. কর্নেল রশিদ সাহেব তাঁর জিপের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায়। বিডিআর সিপাহীরা দাঁড়িয়ে চারদিক পর্যাবেক্ষণ করছেন।
এসপি সাহেব আমাদের পিকআপে উঠতে বললেন। এস.পি সাহেব মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হাবিলদার নাম রতনকে কবর পাহারার নির্দেশ দিলেন। একই সাথে তিনি হাবিলদার রাম রতনকে সতর্ক করলেন সাধারণের সাথে যাতে কোনো অস্যেজন্য ব্যবহার না করা হয়। কেননা লাশের কাছে যেতে না দেয়ার জন্য অনেকেই বেড়ার ওপার থেকে গালাগালি করছিলেন। আমাকে আমার লোক নিয়ে পুলিশ লাইনে চলে যেতে বললেন। গাড়িতে ওঠার সময় দেখি, পিকআপের পিছনের নিচে চাকার কাছে খালিল খান স্টেনগান হাতে চুপ করে বসে আছে। আমি ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি পিছনে ও কেন? হঠতে বলো! ড্রাইভার তাকে সরে যেতে বললে সে সরে গেল। যাহোক, আমার মনে উদয় হলো আমরা সবাই নিরস্ত্র অথচ এই বিহারির হাতে অন্ত্র কীভাবে এলো? ভাবলাম হয়তো এসপি সাহেবের গাড়ির ভেতরে ওই অস্ত্র ছিল! পিকআপ পুলিশ লাইনে আসলে রোলকল মাঠে বটতলায় ফোর্স সুবেদাার ও হাবিলদার মেজরসহ কয়েকজন সেপাই আমাদের অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ফোর্স সুবেদার সাহেব (নামটা মনে নেই, বরিশালের লোক) জিজ্ঞাসা করলেন, কী হলো? মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ইচ্ছে হল না। বললাম এসপি সাহেবের কাছে জেনে নিবেন। আমরা নিজেদের অস্ত্র বুঝে নিয়ে তা আবার অস্ত্রগারে জমা দিলাম। ইতোমধ্যেই সময় গড়িয়ে বিকেল সোয়া ৪টা বেজে গেছে। ভগ্নহৃদয়ে বাসায় ফিরলাম। পরিবারের সদস্যও ওই সময়র অস্থির-উদ্বেগ নিয়ে আমার অপেক্ষা করছিলেন।