রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ঘিরে সারা দেশে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। এ ছাড়া সংঘর্ষ চলাকালীন বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
রোববার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সংঘর্ষে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় দুই, নরসিংদীতে ছয়, ফেনীতে পাঁচ, সিরাজগঞ্জে তিন, রংপুরে চার, কিশোরগঞ্জে তিন, মুন্সীগঞ্জে তিন, বগুড়ায় চার, মাগুরায় তিন, ভোলায় তিন, পাবনায় তিন, সিলেটে দুই, কুমিল্লায় পুলিশসহ দুই, জয়পুরহাটে এক ও বরিশালে একজনসহ ৪৫ জন রয়েছেন।
ঢাকা
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শিক্ষার্থীসহ দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডির জিগাতলা এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী (২৩)। তিনি রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি বিকালে গুলিস্তান থেকে জহির উদ্দীন নামে এক ব্যক্তিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়।
নরসিংদী
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে ছয় জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রবিবার দুপুরে মাধবদী বাজার বড় মসজিদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাধবদীর পৌর মেয়র মোশারফ হোসেন মানিক। তিনি বলেন, ‘নিহত ছয় জনই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।’
নিহতরা হলেন চরদিগলদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন (৪০), সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন (৩৮), জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য শ্রমিক লীগ নেতা মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া ওরফে নাতি মনির (৪২), শ্রমিক লীগ নেতা আনিছুর রহমান সোহেল (৪০), মাধবদী পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার নওশের (৪০) ও অজ্ঞাত আরও একজন।
ফেনী
ফেনীতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে পাঁচ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রবিবার বেলা ২টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হয়। সকাল থেকে বিক্ষোভকারীরা অসহযোগের সমর্থনে মহিপাল এলাকায় বিক্ষোভ করছিলেন। তবে দুপুর ২টার দিকে মহিপাল সেতুর নিচে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা মিছিল নিয়ে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় মুহুর্মুহু গুলি, ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সংঘর্ষে নিহত পাঁচ জনের নাম পরিচয় জানা যায়নি। এ ছাড়া তিন গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার আসিফ ইকবাল বলেন, ‘এই মুহূর্তে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঁচ জনের লাশ রয়েছে। তারা সবাই মহিপালে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।’
এ ছাড়া ইটের আঘাতে আহতদের মধ্যে আছেন বাংলা ট্রিবিউন ও বাংলাভিশনের প্রতিনিধি রকিবুল ইসলাম, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন সুলতান মাহমুদ (২৩), জবাবদিহি পত্রিকার সাংবাদিক হাসনাত তুহিন (৪৫), পথচারী সাইফুল ইসলাম ও যুবদল নেতা সাইদুল ইসলাম (৩২)। তারা ছাড়াও আরও পাঁচ জন গুলিবিদ্ধ হন। তবে তাদের নাম জানা যায়নি।
সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জ শহরে দুপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় তিন জন নিহত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘শহরে সংঘর্ষ চলাকালে মারা যাওয়াদের মধ্যে জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জু রহমান রয়েছেন। বাকি দুই জন হলেন সুমন শেখ (২৮) ও আব্দুল লতিফ (৪২)। তারা যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মী।’
রংপুর
রংপুর নগরীতে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা, পশুরাম থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হারাধন রায়সহ চার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আট সাংবাদিকসহ শতাধিক। গুরুতর আহত অবস্থায় ৯ জনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিহত বাকি তিন জন হলেন যুবলীগ কর্মী খসরু, তার বাড়ি রংপুর নগরীর গুড়াতিপাড়ায়, নিহত মাসুমের (৩১) বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া নিহত আরেকজনের নাম-পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। রবিবার দুপুরে জেলা শহরের স্টেশন রোড এলাকায় এ সংঘর্ষ ঘটে। এতে তিন জন নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনকারীরা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে সংঘর্ষে তিন জন নিহত ও দুজন গুলিবিদ্ধসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
মুন্সীগঞ্জ
মুন্সীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় কাজে যাওয়ার পথে দুই নির্মাণশ্রমিকসহ তিন জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষে সাত জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ জন।
বগুড়া
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। তিন জনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করেছেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ এবং অপরজনের বিষয় নিশ্চিত করেছেন বেসরকারি স্বদেশ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক। তিন জনের মধ্য দুজনের লাশ শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ ও একজন বেসরকারি স্বদেশ হাসপাতালে রয়েছেন। নিহতের মধ্যে একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার নাম মনিরুল ইসলাম (২২); বাড়ি কাহালু উপজেলায়।
মাগুরা
মাগুরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষের সময় গুলিতে তিন জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন জেলা ছাত্রদলের সহ-সম্পাদক মেহেদী হাসান রাব্বি (২৬), সদরের রায়নগর গ্রামের ফরহাদ হোসেন (২৩) ও মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া গ্রামের সুমন শেখ। সংঘর্ষে ছাত্র, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন।
ভোলা
ভোলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে দুপুরে তিন জন নিহত হয়েছেন। সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। বিএনপির দাবি, তাদের দুই কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দাবি, তাদের এক যুবলীগ কর্মীকে বিক্ষোভকারীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ তাদের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বিক্ষোভকারীদের তোপের মুখে ছাত্রলীগ পিছু হটে। পরে বিক্ষোভকারীরা আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ একাধিক সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়, মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
পাবনা
পাবনায় আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ চলাকালে সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে তিন জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রবিবার দুপুরে শহরের ট্রাফিক মোড়ে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রফিকুল হাসান তিন জন নিহতের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় আরও ৩৪ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
সিলেট
সিলেটের গোলাপগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ধারাবহর হাসপাতালের সামনের দুজন নিহত হন। সংঘর্ষে পুলিশ বিজিবি ও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ ৫০ জন আহত হন। এ ছাড়া কয়েকজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রবিবার দুপুর ২টার দিকে গোলাপগঞ্জের ধারাবহরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত দুই জন হলেন ব্যবসায়ী বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী তাজ উদ্দিন (৪৩) ও উপজেলার শিলঘাটের বাসিন্দা সানি আহমদ (১৮)।
কুমিল্লা
কুমিল্লার দেবিদ্বারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষের সময় গুলিতে এক যুবক নিহত হয়েছেন। দুপুর দেড়টার দিকে দেবিদ্বার আজগর আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। নিহত যুবকের নাম আব্দুর রাজ্জাক রুবেল (২৬)। তিনি দেবিদ্বার পৌর এলাকার বারেরা গ্রামের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে।
পাশাপাশি সংঘর্ষ চলাকালে ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। তিনি ওই ফাঁড়িতে কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. খায়রুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জয়পুরহাট
জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও ছররা গুলি ছোড়ে। এ সময় গুলিতে মেহেদী হাসান নামের একজন নিহত হয়েছেন। হামলা ও সংঘর্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদুসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। জয়পুরহাট ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এস এম গালিব আনোয়ার নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বরিশাল
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বরিশাল নগরীর করিম কুটির ও চৌমাথা এলাকা। রবিবার দুপুরে ওই এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হন। নিহত টুটুল চৌধুরী নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন