দারিদ্রের হার এবং ব্যক্তির চাহিদা

আপডেট: অক্টোবর ১৮, ২০১৬, ১১:৫৫ অপরাহ্ণ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার কোন অবস্থায় রয়েছে সে সর্ম্পকিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, দারিদ্র বিমোচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশে অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে সেই হার এসে দাঁড়িয়েছে ১২.৯ শতাংশে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। বিশ্বব্যাংক ধারণা করছে বাংলাদেশ যদি তার জিডিপির প্রবৃদ্ধির ৮.৮ শতাংশ হিসাবে প্রতি বছর ধরে রাখতে পারে তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের অতি দরিদ্র জনসংখ্যার হার ২.৯৬ শতাংশে নেমে আসবে। বাংলাদেশের বর্তমানে রাজনৈতিক অবস্থা এবং তার স্থিতিশীলতার উপর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার অনেকাংশে নির্ভর। তাছাড়া বর্তমানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ সাপেক্ষে বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, ২০৩০ সাল নাগাদ গড়ে বাংলাদেশ ৮.৮ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশের অতি দরিদ্র জনসংখ্যার হার দ্রুতই হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিবেশী বহু দেশের চাইতে বাংলাদেশ দারিদ্র বিমোচনে অনেক এগিয়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ২০১২ সালে বাংলাদেশে অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার ছিল ১৬.৪ শতাংশে, ২০১৩ সালে ১৬.৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১৮.৭ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১৩.৮ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১২.৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির হিসেবে ধরলে অতিদরিদ্র জনসংখ্যা দাঁড়ায় দুই কোটি ৮০ লাখের মতো। বিশ্ব ব্যাংক অতিদরিদ্রতার হার নির্ণয় করে পারসনাল পাওয়ার অফ পারচেজিং বা ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে যা বিশ্ব ব্যাংকের আর্ন্তজাতিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে যে ব্যক্তির দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের নীচে তাকে অতিদরিদ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৮ টাকা। দারিদ্র হার নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত  তথ্যের মধ্যে সংখ্যাগত পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়।

 

 

 

দরিদ্র হার নির্ণয় করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত তারতম্য রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত অতিদারিদ্র হার নিয়ে প্রকাশিত সংখ্যাগত তথ্যেরও পার্থক্য রয়েছে ব্যাপক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি তথ্য যা প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। সেই তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ওই সময় বাংলাদেশে অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার ছিল ১৭.৬ শতাংশ। সেই সময়ের জনসংখ্যানুসারে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠির লোক সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬০ লাখ। ওই তথ্যে আরো প্রকাশিত হয় সেই সময় দেশে মোট দরিদ্র লোকের সংখ্য ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৮৯ হাজার। ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে আর সেই হিসেবে বিবেচনা করলে দরিদ্রতার হার কমেছে অনেক। ১২-২-২০১৫ সালের দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত দারিদ্র সর্ম্পকিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৫.৫৩ শতাংশ দরিদ্রসীমার উর্ধ্বে বাস করে আর ২৪.৪৭ শতাংশ দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে। অর্থাৎ অতিদরিদ্র জনসংখ্যা হিসাবে মোট জনসংখ্যার ২৪.৪৭ শতাংশকে বলা হয়েছে। সেই তথ্যানুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশে সেই সময় দরিদ্রসীমার নীচে ৩ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ রয়েছে। এই তথ্যের সাথে বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যের পার্থক্য রয়েছে। কারণ বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০১৫ সালে অতিদরিদ্র হার ১৩.৮ আর ১২-২-২০১৬ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত অর্থনৈতিক বিষয়ক সংবাদে বলা হয় বাংলাদেশে ২৪.৪৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে। দরিদ্রতা নির্র্ণয়ের তথ্যগত সূচক অর্থাৎ যে সূচকের ভিত্তিতে দরিদ্রতার হার নির্ণয় করা হয় এবং নির্ণীত হারের সংখ্যাগত পার্থক্য সংস্থা ভেদে ব্যাপক হয়ে উঠে কোন কোন সময়। ১২-২-২০১৫ তারিখের  দৈনিক প্রথম আলোর এই সংবাদটিতেই সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি তথ্য প্রকাশ করা হয় তা হলো, “ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেই প্রতিবেদনে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দারিদ্র হার তুলে ধরা হয়েছে। জিইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৭ লাখ  যা সেই সময়কার মোট জনসংখ্যার ১০.৬৪ শতাংশ।

 

 

 

অপরদিকে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার ১৮.৭ শতাংশ। ড. আবুল বারাকাতের অর্থনৈতিক বিষয়ক একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায, ২০১০ সালে দেশের চরম দরিদ্র বা অতিদরিদ্র জনসংখ্যার ছিল ৫ কোটি ৭৫ লাখ। ওই সময়ের বিশ্ব ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্যের সাথে এই তথ্যের পার্থক্য রয়েছে। ১২-২-২০১৫ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, যাদের মাসিক আয় ১৬০০ টাকার নীচে তারা দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে। সেই হিসেবে ব্যক্তির  দৈনিক আয় ৫৪ টাকা হতে হয়। অর্থাৎ যাদের দৈনিক আয় ৫৪ টাকার নীচে তারা দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে। আর এক বছর ছয় মাস পর এসে বিশ্ব ব্যাংক বলছে যাদের দৈনিক আয় ১৪৮ টাকার নীচে তারা দরিদ্রসীমার নীচে বাস করছে। দরিদ্রতা নির্ণয়ে ১ বছর ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যক্তির দৈনিক আয়ের পার্থক্য ৯৮ টাকা। কেন এই পার্থক্য? সেই হারে মূল্যস্ফিতি বাড়ার কারণে এই পার্থক্য নাকি তথ্যগত বা সূচকের নির্ণয় পার্থক্য। তবে গত দেড় বছরে মূল্যস্ফিতির এত বড় পরির্বতন ঘটেনি। এটা সূচক বা তথ্যগত নির্ধারণের পার্থক্য। কারণ বাংলাদেশের মূল্যস্ফিতি গড়ে ৬-৭ শতাংশের মধ্যে গত দুই বছর ধরে উঠানামা করছে। প্রকাশিত দারিদ্র হারের তথ্যগুলি সংস্থা ভিত্তিক ভিন্নতা দেখা যায়। তাই বাংলাদেশে প্রকৃত দারিদ্র হার কত তা নিষ্কণ্ঠক ভাবে বলা কঠিন। সরকারের নির্ধারিত দারিদ্র হার নির্ণয়ের পদ্ধতি কস্ট অব বেসিক নিডস (সিবিএন) অনুযায়ী বলা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশে অতিদরিদ্রের হার ১২.২ শতাংশ। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের দারিদ্র হার পাকিস্তান এবং ভারতের চেয়ে অনেক কম। আন্তর্জাতিক মানদ-ে ( বিশ্ব ব্যাংকের সূচকে) সারা বিশ্বে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা হল ৭৭ কোটি। যাদের দৈনিক আয় ১.৯ ডলারের কম তারাই অতিদারিদ্র, এই  হিসেবের নিরীখে এই দরিদ্রতার সংখ্যা নিরুপণ করা হয়েছে। এই ৭৭ কোটি অতিদরিদ্র জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ বা ৩৯ কোটি বাস করে সাহারা অঞ্চলে আর বাকি বিশ্বের হতদরিদ্র জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার ব্যয়ভারের ভিন্নতা দেখা যায়। তাই দারিদ্র হার নির্ণয়ের সূচকেরও ভিন্নতা রাখা প্রয়োজন। অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশের দরিদ্রতার পরিস্থিতির দীর্ঘ মেয়াদি পরিবর্তন এসেছে যাকে তারা পজিটিভ সাইন হিসেবে দেখেন। কিছু বিশ্লেষণে পাওয়া যায়,  ৫০, ১০০, ১৫০ বছর আগে এই অঞ্চলে দারিদ্রতার হার বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল। এই দরিদ্রতার হার উল্লেখযোগ্য হারে পরির্বতন ঘটেছে।

 

 

 

১৮৩০ সালে একজন কৃষি শ্রমিকের মজুরি ছিল ৬ কেজি চাল, ১৮৮০ সালে সেই মজুরি এসে দাঁড়ায় ৫.৫ কেজিতে আর ১৯৩০ সালে ৫ কেজিতে। সেই সময়ের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে কৃষি শ্রমিকের এই মজুরির পরিমাণটা যথেষ্ট ছিল। এই সময় এক কেজি চালের পরির্বতনে একটা ইলিশ বা এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া যেতো। বর্তমানে একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি যদি ৩০০ টাকাও হয় তার সমুদয় দিনের মজুরি দিয়ে ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ বা এক কেজি গরুর মাংস কেনা সম্ভব না। একজন কৃষককে এক কেজি গরুর মাংস বা ৫০০ গ্রামের একটি ইলিশ কিনতে বিক্রি করতে হয় এক মণ ধান। সার্বিক আর্থ সামাজিক জীবনযাত্রার ব্যয় সাপেক্ষে দারিদ্র চিত্রটারও ভিন্নতা রয়েছে। মাদার তেরেসা দারিদ্র সম্পর্কে বলেছেন, ডব ঃযরহশ ংড়সবঃরসবং ঃযধঃ ঢ়ড়াবৎঃু রং ড়হষু নবরহম যঁহমৎু , হধশবফ , যড়সবষবংং , নঁঃ ঃযব ঢ়ড়াবৎঃু ড়ভ নবরহম ঁহধিহঃবফ , ঁহষড়াবফ ধহফ ঁহপধৎবফ ভড়ৎ ঃযব মৎবধঃবংঃ ঢ়ড়াবৎঃু। বর্তমানে বাংলাদেশের দারিদ্র হার নিয়ে প্রকাশিত তথ্যের যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন বাস্তবে এদেশে এখন কোন মানুষকেই আর অনাহারে থাকতে হয় না। দেশের সকল স্তরের মানুষের বর্তমানে দু বেলা আহারের ব্যবস্থা নিশ্চত হয়েছে। দু বেলা খাবার পাচ্ছে বলেই সেই ব্যক্তিটি দারিদ্রের কবল থেকে রেহাই পেয়েছে তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রায় খাদ্যের পাশাপাশি সংযোজিত হয়েছে নতুন নতুন ভোগ্যপণ্যের উপকরণ।

 

 

 

এদেশে কমেছে মাতৃমৃত্যু হার, ৯৯ % নিরপাদ সেনিটেশন ব্যবস্থাসহ নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। সড়ক ও রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটেছে আমূল পরির্বতন। বিভিন্ন যান ব্যবহার মানুষের নিত্যকার প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। সেই সাথে তথ্য পরিসেবা ( ইন্টারনেট মোবাইল ফোনের) ব্যবহার বেড়েছে। এদেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৯ কোটিরও বেশি মোবাইল ফোন রয়েছে। উল্লিখিত বিষয়গুলি মানুষের জীবনযাত্রায় নিত্য ব্যবহার্য উপকরণে বা বেসিক নিডসেই  পরিণত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের দারিদ্র হার নির্ণয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ১.৯ ডলারের ভিত্তিতে নির্ণয় করাটা ঠিক না, এদেশের ব্যক্তির চাহিদা সাহারা বা বিশ্বের অন্য অনগ্রসর জাতির চাইতে একটু ভিন্ন এবং উন্নতর। বাংলাদেশের দারিদ্রতার হার নির্নয়ে দারিদ্র মানুষ চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা একটু ভিন্ন ভাবে দেখার প্রয়োজন।  বাংলাদেশের বর্তমান আর্থিক প্রেক্ষাপটে দারিদ্রকে এখন বিশ্ব ব্যাংকের ফ্রেমে আবদ্ব রাখার বিষয় না। বাংলাদেশের  জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন হয়েছে ইতিবাচক হারে- তাই এখনের ব্যক্তির চাহিদারও পরির্বতন এসেছে। তাই ব্যক্তির দারিদ্রিক অবস্থার চিত্রটাও একটু ভিন্নতর হয়েছে।
লেখক:- কলামিস্ট