নওগাঁয় হাত বাড়ালেই মিলছে মাদকদ্রব্য ॥ নষ্ট হচ্ছে যুব সমাজ ॥ বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকান্ড

আপডেট: মে ৪, ২০২৪, ৮:০০ অপরাহ্ণ


আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ প্রতিনিধি:


নওগাঁর রাণীনগরে হাত বাড়ালেই মিলছে বিভিন্ন মাদক দ্রব্য। কৌতুহলবশত না বুঝে মাদ্রকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মরনফাঁদ নামক মাদকের নীল ছোবলে যুক্ত হওয়ায় যুব সমাজ নিয়ে চরম উদ্বিগ্নের মধ্যে রয়েছে অভিভাবকরা। এছাড়া উপজেলার প্রতিটি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে দ্রুতই মাদক কারবারীরা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে মাদকদ্রব্য সরবরাহ করায় উদ্বেগের শঙ্কা আরো বাড়িয়েছে।

অপরদিকে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দলীয় ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একশ্রেণির অসাধুরা ব্যক্তিরা পুরো উপজেলাকে ঠেলে দিচ্ছে মাদকের অন্ধকার জগতে। বর্তমানে হাত বাড়ালেই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গাঁজা, ইয়াবা (বাবা), হেরোইন, চোলাই মদ, দেশি মদ, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন, এম্পল পাওয়া যাচ্ছে। তবে গাঁজা ও ইয়াবার বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঝে মধ্যে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন চিহ্নিত কিছু মাদক কারবারীদের আটক করে জেলে দিলেও আইনের ফাঁক দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেরিয়ে এসে আবার দেদারছে শুরু করে মাদকের কারবার। চিহ্নিত মাদক কারবারীদের ও মাদকের সম্রাটদের দীর্ঘ আইনের আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তরমূলক শাস্তির দাবী করেছেন উপজেলার সচেতনমহল।

আবার মাদকের সঙ্গে সঙ্গে জুয়া, পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডও বেড়েছে সমান তালে। এতে করে এলাকার স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ যুবসমাজ মাদকে আসক্ত হয়ে চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরছে। বহিরাগত ও স্থানীয় মাদকসেবী এবং বখাটেদের আনাগোনায় অতিষ্ঠ উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ। অনেকেই মাদকের কারবার করে হঠাৎ করেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হওয়ার কারণে স্থানীয়রা তাদের ভয়ে কোন প্রতিবাদও করতে পারে না।

তথ্যঅনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, রাণীনগর উপজেলার পূর্বদিকে বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও উত্তর দিকে আদমদীঘি এবং সদর থানা। আবার দক্ষিণ দিকে নওগাঁর আত্রাই, নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার কালীগঞ্জ এলাকা ও পশ্চিম দিকে মান্দা উপজেলা।

এমন সুযোগে উপজেলার পারইল ইউনিয়নের পারইল বাজার, বগারবাড়ি মোড়, ভান্ডারগ্রাম বাজার, বিলকৃষ্ণপুর বাজার, ডুবাগাড়ী বাজার, কালিগ্রাম ইউনিয়নের ভেটি এলাকা, আবাদুপুকুর বাজার, করজগ্রাম, রাতোয়াল বাজার, পাশের বগুড়ার আদমদীঘির চাঁপাপুর এলাকা, একডালা ইউনিয়নের অধিকাংশ জনগুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলো, বড়গাছা ইউনিয়নের বড়গাছা বাজার, মালশন-গিরিগ্রাম বাজার, শলিয়া, ভাটকৈ বাজার, বিভিন্ন আশ্রয়ণপল্লীর এলাকা, সদর উপজেলার লোহাচ’ড়া বাজার, গহেলাপুর বাজার, সিম্বা বাজার এলাকা, রাণীনগর বাজার এলাকার সুইপার পট্টি (মেথর পট্টি), রেলস্টেশন ও রেলগেইট এলাকা, হাতিরপুল এলাকা, বটতলী মোড়, চোরপট্টীপাড়া, সদর ও আদমদীঘি উপজেলার সীমান্তবর্তি এলাকা চকউজির স্কুলের পুরো এলাকা,

উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ স্থানগুলো বাহাদুরপুর গ্রামের বাজার, হাসপাতাল মোড়, ত্রিমোহনী হাট, মন্ডলের ব্রীজ, কুবরাতলী মোড়, এনায়েতপুর মোড়, কুজাইল বাজার, গোনা ইউনিয়নের বেতগাড়ী বাজার, গোনা বাজার এলাকা, আত্রাই উপজেলার সীমান্তবর্তি এলাকা প্রেমতলী মোড়, পাগলীর মোড়, রেললাইন সংলগ্ন নওগাঁ-নাটোর আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন মোড়, মিরাট ইউনিয়নের মিরাট বাজার, আত্রাই ও মান্দা উপজেলার সীমান্তবর্তি এলাকা বান্দাইখাড়া এলাকাসহ পুরো উপজেলাতেই নতুন করে জমে উঠেছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের বেচা-কেনা।

উপজেলার ভেটি গ্রামের কালাম সরদার (ছদ্মনাম) বলেন, বেশকিছুদিন যাবত ভেটি গ্রাম এলাকাটি অনেকটাই মাদকমুক্ত ছিলো কিন্তু সম্প্রতি পুলিশের সোর্স সেজে চিহ্নিত মাদক কারবারীরা পুনরায় মাদকের রমরমা ব্যবসা শুরু করেছে। কোন কিছু বলতে গেলেই পুলিশের ভয় ও হয়রানী মূলক মামলার ভয় দেখায়।

মাঝে মধ্যেই সম্ভবত সিভিল পোষাকে পুলিশের লোকেরা এসে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে যায়। হাতের কাছে পাওয়ায় মাদকের নীল নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুন ও যুব সমাজ। সন্তানেরা বড় হয়ে গেলে আর কত চোখে চোখে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে। অথচ পুলিশ বাহিনী ইচ্ছে করলেই নিমিষের মধ্যে এলাকা থেকে মাদকের দৌরাত্ম কমাতে পারে।

কুবরাতলী এলাকার এক মাদককারবারী মো. রইচ উদ্দিন (ছদ্মনাম) বলেন থানা পুলিশ বিভিন্ন এলাকার মাদক কারবারীদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে। যারা সেই চুক্তিতে সম্মত দিচ্ছে তারা দেদারছে ব্যবসা করছে আর যারা চুক্তির বাহিরে তাদেরকে বিভিন্ন সময় আটক করা হচ্ছে।

মাদকদ্রব্যের চলাচলের পথ রোধ না করা পর্যন্ত মাদকের বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যারা প্রভাবশালী যারা থানা পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে আসছে তারা প্রকাশ্যে মাদকের রমরমা ব্যবসা করলেও পুলিশ তাদেরকে দেখতে পায় না। অথচ পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন চাইলেই উপজেলাকে মাদক মুক্ত করতে শক্তিশালী ভ’মিকা রাখতে পারে।

পারইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টার মো: জাহিদুর রহমান (জাহিদ ফকির) মোবাইল ফোনে বলেন, বর্তমানে উপজেলার মধ্যে পারইল ইউনিয়ন মাদকের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। সীমান্তবর্তি ইউনিয়ন হওয়ার কারণে এই ইউনিয়ন দিয়েই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সবচেয়ে বেশি মাদক চালান হয়। আগে গোপনে হলেও বর্তমানে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে পারইল বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়।

ইদানিং এই ইউনিয়নের অধিকাংশ স্থানই মাদক বিস্তারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিং-এ মাদক নিয়ে কথা বলে কোন লাভ হয় না। মাদক নিয়ে করা ওই অভিযোগ কিংবা কথাগুলো শুধুমাত্র রেজুলেশনের খাতার পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে বাস্তবায়ন করে না কেহই। তাই মাদক নিয়ে আর কোথাও কোন কথা বলতে কিংবা তথ্য দিতে ইচ্ছে হয় না।

তিনি আরো বলেন যখন দেখি ইউনিয়নের তরুন-যুবকরা বুঝে না বুঝে চোখের সামনে মাদকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তখন খুব কষ্ট হয় খুব খারাপ লাগে। অনেকবার মাদকের বিস্তাররোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়ন করার মতো কোন সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছি। মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করায় পরিষদে আমার কার্যালয়ে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছি। যদি রক্ষকরা ভোক্ষক হয় তাহলে সেই সমাজ থেকে মাদকের দৌরাত্ম বন্ধ করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ওবায়েদ মোবাইল ফোনে বলেন, থানা পুলিশ সব সময় মাদকের বিরুদ্ধে। আমরা প্রতিনিয়তই মাদকের বিস্তার রোধে এর সঙ্গে জড়িতদের আটক করছি এবং আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করছি। এছাড়া জনবল সংকট থাকার কারণে ইচ্ছে করলেও মাদকের বিষয়ে বেশি কার্যক্রমও পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই উপজেলায় মাদকের বিস্তারকে জিরো টলারেন্সে আনতে আমরা পুলিশ বদ্ধ পরিকর। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে এবং চলবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে তাবাসসুম মোবাইল ফোনে বলেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো মাদকের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত তেমন কোন ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। তবে মাঝে মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ঘটনাস্থলে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া মাদকের কারবার কোথায় হচ্ছে সেই তথ্যগুলো আমাকে জানালে আমি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Exit mobile version