সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৬ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সাইফুদ্দীন চৌধুরী:
১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বরে সংঘটিত জেল হত্যা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশের ধারাবাহিক ইতিহাসেরই এ নির্মম পরিণতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও পরবর্তী ঘটনাবলী গভীর অভিনিবেশসহ পাঠ করলে দেখা যায়, একজন বিশেষ ব্যক্তির পরশ্রীকাতরতা, হীনমন্যতা ও হিংস্রেমনোবৃত্তিই বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে তোলে। ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনাই বলি আর ৩ নভেম্বরের জেল হত্যার কথাই বলি এ যেন এক সূত্রে গাঁথা।
ইতিহাসের এক ঘৃণিত নায়ক হিসেবে উল্লিখিত হয়ে আছেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দোসর, রাজনৈতিক সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক আহমদ। যার ঈর্ষাকাতরতার ফলশ্রুতি বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের সূচনা করে।
বঙ্গবন্ধুর সাথে খোন্দকার মোশতাকের দ্বন্দ্বের সূত্রপাতের বিষয়টি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৪৮-৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। দলের সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হন টাঙ্গাইলের যুব নেতা শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক হন যথাক্রমে শেখ মুজিব ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। কিন্তু আকস্মিকভাবে মস্তিষ্ক বিৃকতি ঘটে যায় শামসুল হকের। তখন দলের নেতৃত্বের প্রয়োজনে দক্ষ মনে করায় দুজন যুগ্ম সম্পাদকের মধ্য থেকে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকেই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। শেখ মুজিবের দলের সাধারণ সম্পাদক করার পেছনে মওলানা ভাসানীর যুক্তি ছিল, সে যথার্থই ওই পদে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কারণ দিনাজপুর ও রাজশাহীতে ছাত্র বিক্ষোভে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কর্মচারীদের ধর্মঘটে এবং আটচল্লিশের প্রথম ভাষা আন্দোলনে বারবার কারাবরণ করে যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন, তাতে করে সাধারণ সম্পাদক পদের যথার্থ যোগ্য ব্যক্তিতো শেখ মুজিবই, অন কেউ নয়।
শেখ মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায়, খোন্দকার মোশতাক মনক্ষুণ্ন হন। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অপরদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায় একরূপ নিশ্চুপই থাকে খোন্দকার মোশতাক। ক্রমান্বয়ে তিনি আওয়ামী রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। খোন্দকার মোশতাকের এই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালে। বস্তুতঅর্থে ক্ষমতা লাভের প্রত্যাশায় তিনি এসময় আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’তে যোগদান করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’র চিফ হুইপ হয়ে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটান।
দশ বছর পর ১৯৬৪ সালে খোন্দকার মোশতাক ভুল স্বীকার করে পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু অতি বড় মনের মানুষ শেখ মুজিব তাকে ক্ষমা করে দলে ফিরিয়ে নেন।
একটি কথা এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৫৭ সালে ‘ন্যাপ’ গঠন করে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হন শেখ মুজিব। সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি হন যথাক্রমে তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অপরদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে আওয়ামী নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
শেখ মুজিব শুধু খোন্দকার মোশতাককেই নয়, এডভোকেট আবদুস সালাম খান, জহীরুদ্দীন ও শাহ আজিজুর রহমানকেও পার্টিতে যোগদানের সুযোগ দেন। দক্ষিণপন্থী নেতাদের দলে অনুপ্রবেশ যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা শেখ মুজিব বুঝতে পারেন নি। সরল মনে তাদের তিনি দলে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এই তিন অনুপ্রবেশকারী কী ক্ষতি করেছে? তা কারো অজানা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহীরুদ্দীন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের দালালি করায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে পুরষ্কৃত হন রাষ্ট্রদূত হয়ে। আর মোশতাক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সুহৃদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। যার ফলশ্রুতি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড এবং এরই অনুবৃত্তিক্রমে ৩ নভেম্বর তারিখে জেলখানায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানের নির্মম হত্যাকান্ড।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক তার সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে ফেলার লক্ষ্যে আরও কিছু ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রতিপক্ষ বলতে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। মোশতাক চিন্তা করেন, এদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেই। কালবিলম্ব না করে খোন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের চার প্রধান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন।
জনরোষ যেন তার উপর না পড়ে এজন্য তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান। জনগণকে ধোকা দেবার লক্ষ্যে তিনি হাস্যোজ্জ্বলভাবে করমর্দন করে মনসুর আলীকে বঙ্গভবনে অভ্যর্থনা জানান। আদতে এটি ছিল নাটক। বাস্তব ঘটনা হলো টেলিভিশনে এই ছবি দেখানোর পরই মনসুর আলীকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ভাগ্যের একই পরিণতি ঘটে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও এএইচএম কামারুজ্জামানের।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র দু’মাস পরই এই জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা হরা হয় বঙ্গবন্ধুর ওই ঘনিষ্ঠ চার সুহৃদকে।
’৭৫ এর ১৫ আগস্ট ও ’৭৫ এর ৩ নভেম্বর হত্যাকান্ডগুলি একই সূতোয় গাঁথা। বয়ঃকনিষ্ঠ শেখ মুজিবের নেতৃত্ব গ্রহণই উচ্চাভিলাষী খোন্দকার মোশতাকের ঈর্ষার কারণ হয়েছিল। হত্যাকান্ডগুলি যে তারই কারণে সংঘটিত হয়েছিল, তা আজ জাতির কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
লেখক: অধ্যাপক ও ডিন, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নাটোর।