শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ শ্রাবণ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। নামটার সঙ্গে শুধু বাঙালি আবেগ আর মৃত্যুরহস্য জড়িয়ে নেই। রয়েছে জাতীয়তাবাদের প্রতি তীব্র ভালোবাসা, দেশপ্রেম আর জাতিধর্ম নির্বিশেষে একতার ছোঁয়া। আজ বিজেপি নিজেদের উগ্র দেশপ্রেম বোঝাতে যে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান ব্যবহার করে, সেটা কে প্রথম তুলেছিলেন জানেন কি? সুভাষচন্দ্র বসু। আর হিন্দুস্তানের বন্দনার এই শব্দবন্ধ নেতাজির হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁরই সেনাবাহিনীর এক মুসলিম সদস্য।
১৯৪৩-৪৫ সালে জাপানের সাহায্যে যখন নিজের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ-র পুনর্গঠন করলেন সুভাষচন্দ্র, তখন তিনি সেনাবাহিনীর অভিবাদনের জন্য এমন কিছু স্লোগান চেয়েছিলেন, যার মধ্যে মিশে থাকবে ভারতীয় গন্ধ। অনেকে তাঁকে রকমারি স্লোগানের সুপারিশ করেন। তখনই হায়দরাবাদের তৎকালীন জেলাশাসকের ছেলে জৈন-উল-আবেদিন হাসান নেতাজির কাছে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান লিখে নিয়ে যান। যা সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয় নেতাজির কাছে। আইএনএ-র মেজর ছিলেন জৈন-উল-আবেদিন।
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে-আজকের বিজেপির তথাকথিত ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান প্রথম দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতো কোনও হিন্দুপ্রেমী নেতা নন। এই স্লোগান প্রথম দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, যাঁর সেনাবাহিনীতে ছিলেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, ভাষাভাষি এবং ধর্মের মানুষজন। যার প্রমাণ, এক মুসলিম মেজরের লেখা ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান। এমনকি তৎকালীন জাপান শাসিত ফোরমোসা বা বর্তমান তাইওয়ানের তাইহোকু বিমানবন্দরে যে বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে একাংশের বিশ্বাস সেই শেষযাত্রাতেও নেতাজির সঙ্গী ছিলেন আইএনএ-রই আরেক মুসলিম সদস্য হাবিবুর রহমান।
শুধু বহু বর্ণ, জাতি বা ধর্মের সহাবস্থানই নয়, নেতাজি বিশ্বাস করতেন নারীশক্তিতেও। তাই আইএনএ-তে পুরুষদের মতোই সক্রিয় যোগদান ছিল নারীদেরও। আইএনএ-র নারী শাখারানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল ওরফে লক্ষ্মী স্বামীনাথন।
আরেকটা কথা নেতাজি সম্পর্কে না লিখলেই নয়। ১৯৪৪ সালে যখন উত্তরপূর্বের মণিপুর দিয়ে জাপানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকছিল নেতাজির আইএনএ, তখনই মণিপুরের মোইরং-এ প্রথমবার তেরঙা উড়েছিল ভারতের মাটিতে। আইএনএ-র সেই তেরঙাই পরে ভারতের জাতীয় পতাকার রং হিসেবে গ্রহণ করেছিল কংগ্রেস। কোহিমা এবং ইম্ফল দখল করে জাপানি এবং তৎকালীন বার্মার সেনাবাহিনীর সাহায্যে ঘিরে ফেলেছিল আইএনএ। যে দুটো সেনা-টুকরি সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল, সেদুটোর নাম ছিল গান্ধী এবং নেহরু ব্রিগেড। যাঁদের সঙ্গে মতান্তরের জেরে যে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন নেতাজি। এমনকি অপারেশন ইউ-গো নামে ওই অভিযানের সময়ই ১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে সম্প্রচারিত ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’র বার্তায় মহাত্মা গান্ধীকে ‘জাতির জনক’ বলে প্রথমবার অভিহিত করে তাঁর কাছ থেকে অভিযানের সাফল্যের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। যদিও তাঁর ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল।
অথচ সেই দেশনায়ক আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ব্রাত্য। বদলে প্রাধান্য পাচ্ছেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা। সেকারণেই মোগলসরাই হয়ে যাচ্ছে দীনদলায় উপাধ্যায় জংশন। কলকাতা বন্দরের নাম বদলে যাচ্ছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরে। অন্যদিকে, তীব্র দেশপ্রেমের জন্য তাঁর প্রশংসা এবং সম্মান করা হলেও ফ্যাসিবাদী নাৎসি জার্মানির প্রতি তাঁর আকর্ষণের বরাবরই নেতাজির থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে কংগ্রেস।
তথ্যসূত্র: আজকাল