পশ্চিম পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা

আপডেট: ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক পোস্ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘গত ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়ানোর ৫ দিন আগেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালানোর জন্য অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।’

২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের করা নানা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থান চায়। কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের শত্রুতার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, এই বাস্তব সত্যটিকে মেনে নিতে হবে সবাইকে।’

মুক্তিযুদ্ধে চিনের বিরোধিতা সম্পর্কে সাংবাদিকরা তাজউদ্দীন আহমদকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘চিন একটি মহান জাতি এবং সব সময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার ব্যাপারে তাদের নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য তাদের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।’

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘শিগগিরই দেশকে শাসনতন্ত্র দেয়া হবে এবং ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্রে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটতে হবে। শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত যেসব পুরাতন আইন দেশের স্বার্থবিরোধী নয় তা বলবৎ থাকবে। এখন জাতির সামনে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের পুনর্বাসন।’

এদিন বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর। এ সময় ২ জনের মধ্যে বৈঠকে ঠিক হয়, বাংলাদেশের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্যে ভারত বাংলাদেশকে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করবে।
২৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির ওষুধপত্র ও চিকিৎসকবাহী একটি বিমান সংস্থাটির স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ঢাকা পৌঁছায়।

২৫ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ঢাকার বাইরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন নেতা ও শিক্ষককে আটক করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে কয়েকজন হচ্ছেন, পিডিবি’র সহ সভাপতি এমএনএ মওলানা মোসলেহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী ও ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ফখরুদ্দিন, ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক খোরশেদ আহমদ খান, ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ ডা. এ হামিদ, ময়মনসিংহ জেলা পিডিপির সভাপতি মওলানা আলতাফ হোসেন এবং ময়মনসিংহ জেলার নেজামে ইসলামের সভাপতি মওলানা ফয়জুর রহমান।’

২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান পৌঁছায়। ওই বিমানে ভারতের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।
এদিনে বাংলাদেশ সরকার পয়লা জানুয়ারি থেকে সব ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করার নির্দেশ দেয়।

২৫ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, ‘বাংলাদেশ যে এখন বাস্তব সত্য, তা বিশ্বের বহু দেশ অনুধাবন করেছে। অনেক দেশ বাংলাদেশকে কার্যত স্বীকৃতি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের আইনগত স্বীকৃতির পথ প্রশস্ত হবে।’

এর আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ থেকে দিল্লিতে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার পতন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সংবাদে জাতিসংঘে চাপা স্বস্তির আবহাওয়া বিরাজ করেছিল। যারা পশ্চিম পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের ঘটনাকে উপেক্ষা করে ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো তারা আজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি বাংলাদেশকে এখনো পাকিস্তানের অঙ্গ হিসেবে ভেবে থাকেন তবে তিনি চরম ভুল করছেন।

২৫ ডিসেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে ‘একটি নতুন জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর উচিৎ শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা। দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা শুরু করা। ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের নেতাদেরও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে মর্যাদা ও কিছু বিশ্বাস বজায় রেখে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিৎ।

বিক্ষোভের যত কারণই থাকুক না কেন, যত মতপার্থক্যই থাকুক না কেন, তা নিশ্চয়ই একটা সময় এসে সময়ের স্বার্থেই পথ চলতে বাধ্য করবে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টেরই সর্বপ্রথম উচিৎ পূর্ব বিরোধ ও ঘৃণা ভুলে পরিস্থিতি উপলব্ধি করে বাংলাদেশকে স্বীকার করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করা। আর এজন্য প্রথম পদক্ষেপ হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া।’

২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা’য় ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এই নতুন রাষ্ট্রের বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এ যাবৎকালে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা হিসেবে সম্বোধন করা হলেও এখন বাংলাদেশ নামেই সম্বোধন করা হচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধনকৃত চিঠিই যার স্পষ্ট প্রমাণ। চিঠিতে ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।