সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
বীরেন মুখার্জী
পাশ্চাত্য সংগীত, বিশেষ করে ফোক-রকের কথা বললে, অনিবার্যভাবেই উচ্চারিত হয় বব ডিলানের নাম। আমেরিকার এই জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীকে ২০১৬ সালে সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নোবেল প্রাইজ’-এ ভূষিত করা হয়েছে। বব ডিলান আমেরিকান লোকগীতি ও কান্ট্রি, ব্লুজ থেকে রক অ্যান্ড রোল, ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ লোকগীতি, এমনকি জ্যাজ, ব্রডওয়ে, হার্ড রক এবং গসপেলও তুলে ধরেছেন গিটারের আশ্রয়ে। তিনি শুধু গায়কই নন, একাধারে গীতিকার, চিত্রকর এবং কবি। জীবনমুখি গানের ধারায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি বিচরণ করছেন। বলা যায়, সংগীতের তৎকালীন জনপ্রিয় ধারার বিপরীতে ডিলানের এই পথ চলা ছিল সত্যিই অকল্পনীয়, কষ্টসাধ্য। ঐতিহ্যলগ্নতা তার গানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করার পাশাপাশি অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার গীতিকাব্যে রাজনীতি, সমাজ ও দর্শন ওতপ্রোত। তিনি যুগপৎ দ্রোহ ও নান্দনিকতার মিশেলে গানের বাণী লিখেছেন, সুরারোপ করে বিশ্বের সংগীত পিপাসু-গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সহমর্মী অবদানের জন্য বব ডিলান বিশেষভাবে স্থান করে আছেন বাঙালির অন্তরে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার খবর বিশ্ববাসীর অজানা নয়। স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির ওপর নেমে আসা এমনই এক নিদারুণ সংবাদ পেয়ে কিছু একটা করার তীব্র তাগিদ থেকে বিটলস খ্যাত জর্জ হ্যারিসন ও প-িত রবিশঙ্কর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যার্থে আয়োজন করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। একাত্তরের ১ আগস্টের এই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন যেমন ‘বাংলা দেশ’ গান লিখে ও গেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন, তেমনি এই অনুষ্ঠানে আরেকজনের উপস্থিতি কনসার্টের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে। আর তিনিই হলেন মার্কিন রক ও ফোকসংগীতের কিংবদন্তিতুল্য নাম বব ডিলান। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে তিনি গেয়েছিলেন তার বিখ্যাত ‘ব্লোইং ফর দ্য উইন্ড’, ‘এ হার্ড রেইন’স আ-গনা ফল’, ‘জাস্ট লাইক আ ওমেন’সহ কয়েকটি গান। দীর্ঘ আট বছর পর এটাই ছিল বব ডিলানের জনসমক্ষে প্রথম সংগীত পরিবেশনা। শুধু তাই নয়, বিট কবি অ্যালেন গিনসবার্গের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘যশোর রোড’কেও তিনি গানে রূপান্তরের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বব ডিলানের ‘ব্লোইং ফর দ্য উইন্ড’ গানটি আরেক গুণীশিল্পী কবির সুমনের অনুবাদে তুলে ধরা যেতে পারে-
কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিড়োবে তার ডানা
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও জানা।
কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙে যাবার আগে
কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শিকল পরে
ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে
বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে।
কত হাজার বারের পর আকাশ দেখা যাবে
কতটা কান পাতলে পরে কান্না শোনা যাবে
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে,
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।
গানটি ডিলানের প্রতিবাদী চেতনা আর মানবিকতার সমন্বয়ে রচিত। এছাড়া তার ‘দি টাইমস দে আর এ চেঞ্জিং’সহ অন্যান্য গানও নাগরিক অধিকার, মানবতাবাদ এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রশংসাগীতি হিসেবে স্বীকৃত। ‘ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড’ মানুষের মাঝে প্রতিবাদী ভাবটাকে প্রশ্নশীলতার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে। গানটি শান্তি, যুদ্ধ এবং স্বাধীনতার কথা বলে। এছাড়া প্রত্যেক প্যারার শেষে পুনরাবৃত্ত পঙ্ক্তি বা সুর রহস্যময় ও দ্ব্যর্থবোধক, যার সমাধান সুস্পষ্ট এবং সংশয়াতীতও হতে পারে অথবা বাতাসের মতো অস্পর্শনীয় হয়ে মিলিয়ে যেতে পারে। গানটির আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিকতা এখানেই, যা আসলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপলব্ধির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তার বেশিরভাগ গানেই যুদ্ধবিগ্রহ, সমাজের অশান্তিসহ ক্ষমতার দম্ভের বিরুদ্ধাচারণ প্রতিফলিত। গণমানুষের মুক্তির বার্তা ধ্বনিত হওয়ায় তার গান যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের গণসঙ্গীত হিসেবেও স্বীকৃত। সামাজিক-রাষ্ট্রিক নানা অসঙ্গতিও তিনি রূপক অর্থে তুলে ধরেছেন। স্বীকার করতে হবে, লিরিকসের কারণে তার গানের ভাষাভঙ্গি কিছুটা অন্তর্মুখী হলেও, অন্তর্নিহিত অভিব্যক্তি অত্যন্ত শক্তিশালী। সরল কর্ড আর রূপক শব্দচয়ন, এই দুয়ের সমন্বয়ে একটি যুগের ভাবধারাকে গানে ধারণ করে ডিলান মুছে দিতে সক্ষম হয়েছেন ‘ফোক’ আর প্রচলিত ‘পপ’ সঙ্গীতের মধ্যকার পার্থক্য। তবে ষাটের দশক পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘লাইক অ্যা রোলিং স্টোন’, ‘জাস্ট লাইক অ্যা ওমেন’ এবং ‘লেই লেডি লেই’-এর মতো গান দিয়ে নিজেকে আবারও ভিন্ন রূপে হাজির করেন ডিলান। ‘প্রতিবাদী গায়ক’ এর অভিধা উজিয়ে তিনি দেখাতে সক্ষম হন সৃজনশীলতার সামর্থ আর বৈচিত্র্য। ফলে ধীরে ধীরে তার রচিত গানগুলো গণমানুষের অন্তরে স্থান করে নেয়। সঙ্গত কারণেই বলা যায় তার গান শুধু শোনার নয়, বরং পাঠেরও।
এবছর নোবেল অর্জনের পর বিশ্বব্যাপী আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন বব ডিলান। তার সংগীতের সাহিত্যমূল্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা তর্ক এখনও সাহিত্যবিশ্বে চলমান। বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন বব ডিলান সম্পর্কে মন্তব্য করেছেÑ সেরা কবি, সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীব্র অকুতোভয় ও বিদ্রুপাত্মক সমালোচক। আবার আমেকিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ডিলানকে তুলনা করতে গিয়ে নামোচ্চারণ করেছেন মোৎসার্ট, পিকাসো, শেক্সপিয়ার ও ডিকেন্সের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের। আর ডিলানের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ৫০০ পৃষ্ঠার এক সুবিশাল বইয়ে অধ্যাপক ক্রিস্টোফার রিকস তার গানের কথাকে তুলনা করেছেন কবি টিএস এলিয়ট ও টেনিসনের সঙ্গে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বখ্যাত নাট্যকার শেকসপীয়র, যিনি নাটকের মাধ্যমে গণমুক্তির কথা বলেছেন। নাটকগুলো থিয়েটারে উপস্থাপনের মাধ্যমেই তিনি এই প্রতিবাদ তুলে ধরেন। তেমনি বব ডিলানও সংগীতের মাধ্যমে একই কাজে ব্রতী থেকেছেন, যা সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষক রব শেফিল্ড, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ম্যাগাজিন রোলিংস্টোন-এ। কাজেই এ কথা বলা অত্যুক্তি হয় না যে, শুধু গায়ক হিসেবেই নয়, গীতিকাব্য রচনার ক্ষেত্রে অসামান্য দক্ষতা এবং গীতিকাব্যে দ্রোহ, সৌন্দর্যচেতনা এবং স্থানীয় লোকসংস্কৃতির রসায়নে ভিন্নতর অবদানই বব ডিলানকে নোবেল প্রাইজের যোগ্য করে তুলেছে।
সার্বিক অর্থে বব ডিলানকে একজন সফল কবি, যিনি কবিতাকে গিটারের আশ্রয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের কোটি মানুষের অন্তরে। সংগীত সাধনার মাধ্যমে তিনি যেমন অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। জর্জ বানার্ড শ’র পরে তিনি একমাত্র কবি যিনি নোবেল এবং অস্কার দুটো পুরস্কারেই ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া ১১টি গ্রামি অ্যাওয়ার্ড, একটি গোল্ডেন গ্লোব ও একটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার জয় করেছেন। তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম’, ‘ন্যাশভিল সংরাইটার্স হল অব ফেম’, ও ‘সংরাইটার্স হল অব ফেম’-এ। টাইম ম্যাগাজিনের ২০ শতকের শ্রেষ্ঠ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় যেমন তার নাম রয়েছে, তেমনি ২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন প্রকাশিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ গায়কের তালিকায় দ্য বিটলসের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন বব ডিলান। সাহিত্যে নোবেল অর্জন তাকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশের মানুষ অ্যালেন গিনসবার্গ, জর্জ হ্যারিসন, জোয়ান বায়েজের মতো অকৃত্রিম বন্ধুদের সঙ্গে বব ডিলানকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আন্তর্জাল অবলম্বনে