বাংলা কথাসাহিত্যে চন্দ্রবোড়া প্রসঙ্গ: তিনটি পাঠ বিবেচনা

আপডেট: জুলাই ১২, ২০২৪, ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শফিক আজিজ:


বাংলা সাহিত্যে সর্পবিষয়ক নানা ধরনের লেখা দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এবং ‘লোকসাহিত্য’ বলে কথিত সাহিত্যধারার একটি উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে সাপনির্ভর আখ্যান বা উপকথা-রূপকথা। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য বলে বিবেচিত উপন্যাস বা ছোটগল্পেও সাপ প্রসঙ্গ আছে; কখনো চরিত্র বা প্রতিকরূপে, কখনো আখ্যানের শাখা-প্রশাখায়, কখনো আবার প্রতিবেশ- পরিবেশের উপাদানরূপে।

তবে একটি বিশেষ সাপ চন্দ্রবোড়া নিয়ে খুব বেশি কথাসাহিত্য খোঁজে পাওয়া যাবে না; এবং বিস্তারিত অনুসন্ধানে রীতিমত গবেষণার প্রয়োজন হবে বলেই বিশ^াস। আমরা এক্ষেত্রে অন্তত তিনটি কথাসাহিত্য থেকে পাঠ নিতে পারি; যেখানে চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি রয়েছে। প্রথমেই আমরা বিবেচনায় নিতে পারি প্রখ্যাত কথাকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’।

রাঢ় অঞ্চলের যে অংশে পাহাড়িয়া কোপাই নদী মেয়েদের অলংকার হাঁসুলীর মতো বাঁক নিয়েছে, সেই অংশে বাঁশবনে ঘেরা আড়াই শো বিঘা জমি নিয়ে পালকিবাহক কাহার জনগোষ্ঠীর বাস, নাম বাঁশবাঁদি। এই জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, উপকথা, বিশ^াস-পুরাণ, বঞ্চনা-অবহেলা নিয়ে রচিত উপন্যাসটি। শুরুতেই একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা দিয়ে আখ্যানটি শুরু। ঔপন্যাসিকের ভাষায়, ‘রাত্রে কে যেন শিস দিচ্ছে। দিনকয়েক শিস উঠেছিল জাঙল এবং বাঁশবাঁদির ঠিক মাঝখানে ওই হাঁসুলী বাঁকের পশ্চিম দিকের প্রথম বাঁকিতে-বেলগাছ এবং শ্যাওড়া ঝোপে ভর্তি, জনসাধারণের কাছে মহা-আশঙ্কার স্থান ব্রহ্মদৈত্যতলা থেকে।

তারপর কয়েকদিন উঠেছে জাঙালের পূর্ব গায়ে কোপাইয়ের তীরের কুলকাঁটার জঙ্গল থেকে। তারপর কয়েকদিন শিস উঠেছিল আরও খানিকটা দূরে-ওই হাঁসুলী বাঁকের দিকে সরে। এখন শিস উঠেছে বাঁশবাঁদির বাঁশবনের মধ্যে কোনোখান থেকে।’

বাঁশবাঁদির কাছাকাছি জাঙাল গ্রামে বসবাস করা ভদ্র বাবুরা বন্দুকে আওয়াজ করে, পুলিশ ডেকেও শব্দের উৎসের কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। কাহাররা শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌছাল যে ব্রহ্মতলার ‘কর্তা’ কোনো কারণে রুষ্ট হয়েছেন বলেই তিনি এ কান্ড ঘটাচ্ছেন। কাহারদের বয়োজ্যেষ্ঠা বৃদ্ধা-কালা বুড়ি সুচাঁদ কাহারনী এর প্রতিকারে ‘কর্তা’কে সন্তষ্ট করতে সুস্থ-সবল পাঁঠা বলি দিয়ে ‘পিতিবিধেন’ করতে হবে বলে প্রস্তাব করেন।

কাহারদের মাতব্বর বনওয়ারীসহ সকলে তাতে সম্মতি প্রদান করেন। চন্দপুরের রেলের কারখানায় কাজ করা, কথা-বার্তায়, চাল-চলনে কাহারদের থেকে আলাদা এ-গায়েরই ছেলে করালীর মনে অন্য ভাবনা। সে বিশ^াস করে না যে, এ কোনো অলৌকিক ঘটনা। সে নিজের কামাইয়ে নিজে চলে, গায়ের কাউকে মানে-গণে না, কাউকে গ্রাহ্যও করে না। গায়ের সবাই যখন পাঁঠা-বলি আয়োজনের টাকা-পয়সা জোগাড়ে ব্যস্ত, তখনই একদিন সবার অগোচরে বাঁশবনের একাংশে আগুন লাগিয়ে দেয় করালী। গ্রামের সবাই উদ্বেগ নিয়ে ছুটে আসে বাঁশবনে।

মাতব্বর বনওয়ারী রেগে যান এবং তার সঙ্গে একচোট ধস্তাধস্তিও হয়ে যায় করালীর। অবশেষ, ‘বাঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নিচে পড়ছে একটা প্রচ- সাপ। পাহাড়ে চিতির মত মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়। পাহাড়ে চিতির সঙ্গে ওইখানে সেটার পার্থক্য। বিস্ফারিত দূষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে বনওয়ারী বললে-পে-ক– চন্দ্রবোড়া! হ্যাঁ, ওদের গর্জন খুব বটে।’

করালী বলে উঠে, ‘এটা কত বড় দেখছ না? তাতেই শিসের শব্দ হয়। শালা!’ এ ঘটনার পর করালী রীতিমত হিরো বনে যায় কাহারদের মধ্যে। সে সাপটিকে কয়েকজন মিলে বাঁশে চ্যাংদোলা করে বেঁধে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ভদ্র সমাজ থেকে মেজ ঘোষ সেটি দেখতে এসে করালীর বীরত্বতে খাটো করতে গিয়ে বলেন, ‘নাঃ, খুব বড় না। এর চেয়ে অনেক বড় পাহাড়ে চিতি চিড়িয়াখানাতেই আছে। আসামের জঙ্গলে তো কথাই নাই। সেখানে এত বড় সাপ আছে যে, বাঘের সঙ্গে লড়াই হলে বাঘ মেরে ফেলে। রেললাইনের উপর যদি কোনো ট্রেন যাবার সময় পড়ে তো ট্রেন আটকে যায়।’

করালী আঘাতটি বুঝতে পেরে উদ্ধতভাবে এগিয়ে আসে সাপটি তুলে নিতে। সে সায়েব-বাবুদের দেখাতে সেটি চন্ননপুর রেল স্টেশনে নিয়ে যাবে। কারণ এর কদর তারাই বুঝবে। ঠিক তখনই এক ভদ্রলোকের ছেলে বলে উঠে, ‘কিন্তু এ তো পাহাড়ে চিতি নয়-এ হল চন্দ্রবোড়া। চন্দ্রবোড়া এত বড় কিন্তু কেউ কখনও দেখে নি। আর সাপও ভীষণ সাপ।’ এ-ভাবেই বিশাল আকৃতি ও আয়োজনের হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় চন্দ্রবোড়া সাপের এই আখ্যানের মধ্যদিয়ে কাহারদের বিশ^াস আর উপকথার বিপরীতে কাহারদেরই সন্তান তরুণ করালীর সংস্কারমুক্ত জীবনের জয়গান গাওয়া হয়েছে।

জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদের আধা ফ্যান্টাসি- আধা সায়েন্স ফিকশনধর্মী উপন্যাস ‘নি’। ১৯৯২ সালের  ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় এটি। এই উপন্যাসেও আছে চন্দ্রবোড়া সাপের কথা। গল্পের নায়ক মবিনুর রহমান খানিকটা তার হিমু বা মিসির আলীদের মতো চরিত্রেরই অধিকারী। তিনি বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি’তে প্রথম শ্রেণি পেয়েও কিছুটা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের জন্য ভাইভা বোর্ডকে সš‘ষ্ট করে ভালো চাকরি জুটাতে পারেননি। অবশেষে নীলগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সিরিয়াস ধরনের মানুষ, বয়স ছত্রিশ বা সাঁইত্রিশ, দেখতে রোগা-লম্বা। নিয়মিত ক্লাস নেন, রূপা নামের এক ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ান আর বাকিটা সময় নিজের দূররীণ দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্র দেখে সময় কাটান।

তিনি স্কুল থেকে প্রায় দুমাইল দূরে দুকামরার একটি পাকা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন, একাই যা কিছু একটা রান্নাবারা করে খান। জরাজীর্ণ ঘর, যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। বাড়িটি সাপের আড্ডাখানা। বর্ষাকালে যেখানে-সেখানে সাপ দেখা যায়। স্কুলের দপ্তরি কালিপদ বাড়ির মালিক। সাপের ভয়েই সে তার বাড়িতে বাস না করে আলাভোলা মানুষটিকে ভাড়া দিয়েছে। কালিপদ’র প্রথম পক্ষের স্ত্রী আর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রথম সন্তান সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল।
মবিনুর রহমান অদ্ভুত ধরনের মানুষ; অদ্ভুত ক্ষমতারও অধিকারী-কিন্তু তিনি তা বুঝেন না।

তিনি আধোঘুম- আধো জাগরণে স্বপ্নের মধ্যে কিছু অদ্ভুত অবয়বের মানুষের মুখ দেখতে পান-যারা তাকে তার ক্ষমতাকে পূর্ণ ব্যবহার করতে বলেন। জেগে উঠে তিনি সে-সব আর মনে করতে পারেন না। বর্ষাকালে বাড়িটির কাছের নদী পানিতে ভরে ওঠে। তিনি একটি ছইঅলা নৌকা কিনেছেন। প্রায়ই তিনি নৌকাতে রাত কাটান। ছাদে উঠে দূরবীণে তারকারাজি দেখেন। একদিন রূপা তার মেজো ভাইয়ের বন্ধু তানভিরকে নিয়ে টিচারের ডেরায় আসে। তানভির সাপ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই মবিনুর রহমান সহজ গলায় বলেন, ‘সাপ আছে ঠিকই। দুটো চন্দ্রবোড়া সাপ। পাশের ঘরে থাকে।’

তানভির প্রশ্ন করে যে তিনি সাপ দেখেছেন কিনা আর চন্দ্রবোড়াই যে বুঝলেন কীভাবে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘অনুমানে বলছি। সব সাপ ডিম দেয়। এই সাপটা সরাসরি বাচ্চা দিয়েছে। শুধুমাত্র চন্দ্রবোড়াই সরাসরি বাচ্চা দেয়। একত্রিশটা বাচ্চা দিয়েছে।’ ‘আপনি বসে বসে গুণেছেন?’ তানভিরের এ কথার উত্তরে বলেন, ‘জ্বি না। একদিন বারান্দায় বসে ছিলাম। দেখলাম, সাপটা বাচ্চাগুলি নিয়ে বের হচ্ছে। তখন গুণলাম।’

তানভির বিস্ময় নিয়ে আবার প্রশ্ন করে, একত্রিশটা সাপের বাচ্চা এবং দু’টা সাপ নিয়ে বাস করতে আপনার ভয় লাগে না? মবিন সাহেবের উত্তর: একটু লাগে। রাতে আমি ঘরে থাকি না। নৌকায় ঘুমাই। তবে আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আমরা সহাবস্থান নীতি গ্রহণ করেছি। আমি ওদের কিছু বলি না। ওরাও আমাকে কিছু বলে না। ওরা আমার গায়ের গন্ধ চেনে। আমিও ওদের গায়ের গন্ধ চিনি। আগেভাগেই সাবধান হয়ে যাই। এহেন সহজ-সরল মানুষটিও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তার বিরুদ্ধে স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত গম আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে।

ওসি তাকে হাতকড়া পরিয়ে তার ডেরায় নিয়ে যান, বলেন, ‘আপনার ঘরও সার্চ হবে। সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। পাশের ঘরে কি আছে?’ তিনি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেন, ‘দুটা চন্দ্রবোড়া সাপ আছে আর তাদের একত্রিশটা ছানা আছে। সাবধানে যাবেন।’ ওসি অবিশ্বাস আর বিস্ময় নিয়ে বলেন, কি বললেন? চন্দ্রবোড়া সাপ? ‘জ্বি’ স্বাভাবিক   উত্তর শিক্ষকের। ‘ভেরি গুড। আমার কিছু চন্দ্রবোড়া সাপই দরকার।’ হুমায়ূন আহমেদের নি উপন্যাসের আখ্যানে এভাবেই উঠে এসেছে চন্দ্রবোড়া সাপের প্রসঙ্গ।

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ক্লাসিকাল লেখা কথানাট্য চাকা। তিনি ঔপনিবেশিক শিল্পতত্ত্ব ‘শিল্পের বিভাজন’কে অস্বীকার করে বাঙালির নিজস্ব শিল্পাঙ্গিকে শিল্প রচনা করেছেন। ফলে তার লেখা একই সঙ্গে নাটক, উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, আখ্যান বা রাগ-রাগিণীর সমাহার। চাকা’কে তিনি কথানাট্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। এতে কথাসাহিত্যের শিল্প ও রস পূর্ণই বিদ্যমান। চাকাকে এইক্ষেত্রে আমরা কথাসাহিত্য হিসেবেই বিবেচনা করেছি। এর প্রেক্ষাপট ও আবহে রয়েছে বাংলাদেশের সামরিক শাসন। রাজপথে অপঘাতে কিংবা বলা যায় সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে শাসকের হাতে মৃত্যুবরণকারী একজনের লাশের গন্তব্যে পৌঁছানোর মানবিক কাহিনির সমান্তরালে মূর্ত হয়ে উঠেছে সামরিক শাসনের কবলে পড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা। সামরিক শাসনের নৃশংসতা আর ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে তিনি চন্দ্রবোড়া সাপের প্রতিকী ব্যবহার করেছেন। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপাখ্যান’, ‘নি’ ও ‘চাকা’-এই তিনটি কথাসাহিত্য পাঠ বিবেচনায় নিলে চন্দ্রবোড়া তথা রাসেলস ভাইপার সাপ
সম্পর্কে এ-বিষয়গুলোই সাধারণ হয়ে ধরা দেয়।