রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের একটা পরিচিতি ‘বিগ ফ্যাট ওয়েডিং’-এর দেশ হিসেবে। ভারতের ধনকুবের আর সেলেব্রিটিরা বিরাট জাঁকজমকে বা বলিউড-মার্কা চোখধাঁধানো আড়ম্বরে পরিবারের বিয়ে আয়োজন করতে ভালবাসেন, এ কথা প্রায় বিশ্বসুদ্ধু লোক জানেন।
সেই বিগ ফ্যাট ওয়েডিং-এর দেশেও যেটি তর্কাতীতভাবে সর্বকালেন ‘বিগেস্ট অ্যান্ড ফ্যাটেস্ট’ – সেই বিবাহবাসরটিই আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুম্বাইতে।
কারণ গত কয়েক মাস ধরে একের পর এক প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানমালার শেষে আজ (শুক্রবার) চার হাত এক হচ্ছে মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানি আর দীর্ঘদিনের বান্ধবী রাধিকা মার্চেন্টের।
আজ শুক্রবার (১২ জুলাই) ‘শুভ বিবাহ’ অনুষ্ঠানের পরও তিনদিন ধরে চলবে মুম্বাইতে সেই আনন্দ আয়োজন, যার শুরু হয়েছিল সেই মার্চ মাসের গোড়ায় গুজরাটে আম্বানিদের পৈতৃক ভিটে যেখানে, সেই জামনগরে।
খরচের বহরে, ধূমধামের মাত্রায় কিংবা অতিথি তারকাদের দ্যুতিতে উজ্জ্বল এমন অবিস্মরণীয় বিয়ের আসর ভারতেও কেউ কস্মিনকালে দেখেনি!
সিএনএন লিখেছে, গোটা ভারত যেন ‘ট্রান্সফিক্সড’ হয়ে গেছে – মানে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে হাত-পা নাড়াতেও ভুলে গেছে!
বিয়েতে অতিথির তালিকায় রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী থেকে শুরু করে দেশের সব নামী-দামী রাজনীতিবিদ। শাহরুখ-আমির-সালমানের মতো বলিউডের ‘খান ত্রয়ী’ থেকে শুরু করে হালের রণবীর কাপুর-আলিয়া ভাটের মতো তারকারা – বাদ নেই তারাও।
আবার ক্রিকেট তারকাদের বাদ দিয়ে ভারতে যে কোনও উৎসবই অসম্পূর্ণ, তা ছাড়া আম্বানি পরিবার নিজেরাই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি মুম্বাই ইন্ডিয়ানসেরও মালিক – কাজেই রোহিত শর্মা ও তার বহু সতীর্থও থাকবেন আসর আলো করে!
গত মাসে বিয়ে উপলক্ষে আম্বানিরা তাদের খাস অতিথিদের নিয়ে ভূমধ্যসাগরে এক লাক্সারি ক্রুজে বেরিয়েছিলেন, সেখানেও পারফর্ম করেছেন গায়িকা কেটি পেরি, ব্যান্ড ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ বা আন্দ্রিয়া বচেলির মতো তারকারা!
মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্বে এখন কারা মঞ্চ মাতাবেন, তা নিয়েও চলছে তুমুল জল্পনা-কল্পনা।
মার্চেই প্রাক-বিবাহ আসরে দেখা গিয়েছিল মেটা-র কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ বা মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের মতো বিশ্ববিখ্যাত অতিথিদের।
আগামী বাহাত্তর ঘন্টায় দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মুম্বাই বা কাছের কয়েকটি বিমানবন্দরে এসে নামছে অন্তত একশোখানা প্রাইভেট জেট – কাজেই দুনিয়া ঝেঁটিয়ে সেলেব্রিটিরা যে অনন্ত আর রাধিকাকে আশীর্বাদ করতে আসছেন, তা বোঝাই যাচ্ছে।
কিন্তু এমন রূপকথার মতো বিয়ে নিয়েও কিন্তু ভারতে তর্কবিতর্কের শেষ নেই!
গরিব একটা দেশে ছোট ছেলের বিয়েতে এভাবে নদীর মতো টাকা খরচ করে মুকেশ আম্বানি একটা কুরুচিকর কাজ করলেন – না কি দেশের অর্থনীতিতে একটা নতুন পথের দিশা দেখালেন, তা নিয়েও কিন্তু ভারতের সমাজ পুরোপুরি দ্বিধাবিভক্ত!
অনন্ত আম্বানি আর রাধিকা মার্চেন্টের বিয়ে নিয়ে দেশে এই বিতর্কগুলো ঠিক কী নিয়ে, তাতে নানা পক্ষের লোকজনই বা কী বলছেন এবং দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাবই বা কী হতে পারে – এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই খোঁজখবর।
অর্থের কদর্য প্রদর্শনী?
মার্চ মাসের গোড়ায় যখন মহাসমারোহে আম্বানি পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ের প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানমালা চলছে, তখন দেশের সুপরিচিত আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট প্রশান্ত ভূষণ একটি বিতর্কিত টুইট করেছিলেন।
তিনি তাতে লেখেন, “এই প্রি-নাপ এক্সট্রাভ্যাগেনজার নামে অর্থ ও ক্ষমতার যে কদর্য ও অশ্লীল প্রদর্শনী চলছে তা রীতিমতো বমির উদ্রেক করে।“
“আমাদের দেশের তারকারা যে নিজেদের এভাবে ছোট করে সেই জোয়ারে গা ভাসাতে পারেন, সেটাও চরম লজ্জার একটা অসুখ। আর দেশের মূল ধারার মিডিয়া যে এই ইভেন্ট নিয়ে আবেগে থরথর, সেটাও তাদের দেউলিয়াপনারই পরিচয়!”
এই মন্তব্যের পর দেশে বহু মানুষ সামাজিত মাধ্যমে প্রশান্ত ভূষণকে যেমন সমর্থন করেছেন, তেমনি অনেকে আবার গালিগালাজেও ভাসিয়ে দিয়েছেন।
প্রবাসী ভারতীয়দের একটি প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্ডিয়াফোরামস’-এ নরওয়ে-প্রবাসী একজন মহিলাও লিখেছেন – যেভাবে আম্বানি এখানে টাকা ওড়াচ্ছেন তা শুধু দৃষ্টিকটু ও ‘ভালগার’ই নয়, গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের জন্য চরম অমর্যাদাকরও বটে!
“আর আম্বানির পয়সার টোপে বলিউডের যে অভিনেতারা বাঁদর নাচ নাচতেও রাজি, তাদের জন্য শেম!”, বলছেন তিনি।
ওই ফোরামে শত শত সদস্য তাকে সমর্থন জানিয়েছেন, একজন তো এমনও লিখেছেন, “বিশ্বে কত শত ধনী পরিবার আছেন, যারা নিজেদের পারিবারিক অনুষ্ঠান ‘প্রাইভেট’ রাখতে পছন্দ করেন – প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই নিভৃতে তারা নিজেদের আনন্দ উদযাপন করেন!’’
“আর এই দেখুন আম্বানিদের, যারা ঠিক করেছেন নিজেদের পয়সার গুমোর সারা দুনিয়াকে দেখিয়েই ছাড়বেন!”, লিখেছেন তিনি।
ভারতেও অনেকে এভাবে ‘টাকা ওড়ানো’র নিন্দা করেছেন, তাদের সুরে সুরে মিলিয়েছেন পাকিস্তানের সিনেমা অভিনেত্রী ও তারকা জোয়া নাসিরও!
অনেক ভারতীয়র মতো জোয়া নাসিরও লিখেছেন, যে দেশে বহু মানুষের দুবেলা আজও ভরপেট খাবার জোটে না, সেখানে এরকম আচরণ মেনে নেওয়া যায় না!
এই বিয়ের জন্য গুজরাটের ছোট শহর জামনগরের ততোধিক ছোট এয়ারপোর্টকে যেভাবে সাময়িকভাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তারও তীব্র সমালোচনা করেছেন অনেকে।
প্রবীণ সাংবাদিক হরিশ খারে পাত্র অনন্ত আম্বানির মা নীতা আম্বানিকে খোলা চিঠি লিখে বিদ্রূপ করেছেন, “আপনাদের অনুরোধে জামনগরকে রাতারাতি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বানানোর সময় সরকার জাতীয় নিরাপত্তার যে সংজ্ঞা দেয়, উমর খালিদের জামিনের শুনানির সময়ও তারা যদি সেই একই সংজ্ঞা মেনে নিত!”
‘নীতা বেন’-কে লেখা ওই চিঠিতে তিনি অবশ্য তাকে ধন্যবাদও দিয়েছেন একটা কারণে – প্রধানমন্ত্রী মোদীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই সব ডেস্টিনেশন ভারতের বাইরে না-করে দেশের মাটিতে করার জন্য।
তবে গত মধ্যরাত থেকে এই বিয়ের মঞ্চ, মুম্বাইয়ের ‘জিও কনভেনশন সেন্টার’ অভিমুখী সমস্ত রাস্তা যে শহরের পুলিশ তিন দিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সেটাও মানতে পারছেন না বহু মুম্বাইবাসী।
মুম্বাই পুলিশ যুক্তি দিয়েছে, একটা ‘পাবলিক ইভেন্টে’র জন্যই এই সিদ্ধান্ত।
কিন্তু শহরের নাগরিকদের প্রশ্ন, একজন শিল্পপতির ছেলের বিয়ে বা প্রাইভেট ইভেন্টকে কি কতৃর্পক্ষ কীভাবে সরকারি অনুষ্ঠানের তকমা দিতে পারে?
‘বেশ করেছেন খরচ করেছেন’
ভারতের সুপরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার স্বাতী মুকুন্দের একটি ইনস্টা পোস্ট গত কয়েকদিনে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে।
ওই পোস্টে তিনি বলেছেন, “যারা বলছেন না এই খরচ দিয়ে দুটো দেশের গরিব লোকদের দু’বছরের রেশন হয়ে যেত, তারা প্লিজ এসব ফালতু কথাবার্তা বন্ধ করুন!”
“যিনি এই খরচ করছেন তিনি হাজার হাজার লোকের রুটিরুজি দিচ্ছেন, আপনি কী করেছেন? আর তিনি নিজের পয়সা নিজের বাচ্চার বিয়েতে খরচ করেছেন, আমি বলব বেশ করেছেন। তাতেও অনেক লোকের হাতে দুটো পয়সা আসছে।”
তার চেয়ে বরং এই সমালোচকরা নিজের চড়কায় তেল দিন – পরামর্শ দিয়েছেন স্বাতী মুকুন্দ।
আসলে ভারতীয়রা নিজের ছেলেমেয়ের বিয়েতে প্রাণ ভরে খরচ করতে ভালবাসে, মুকেশ আর নিতা আম্বানিও ঠিক তাই করছেন এবং তাতে দেশের অনেক লোকের রুজিরোজগার হচ্ছে-এই মতেও বিশ্বাস করেন দেশের বহু লোক।
প্রশান্ত ভূষণের টুইটের জবাবেই যেমন লেখক রোহিত ভাট মন্তব্য করেছেন, “যেটাকে আপনি এক্সট্রাভ্যাগেনজা বা খরচের আতিশয্য বলছেন তাতে কিন্তু শত শত ভেন্ডর, সাবভেন্ডর (পরিষেবা প্রদানকারী) ও ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপার্জন হয়েছে।”
তার পরেই তার পাল্টা আক্রমণ-“আপনার মতো গর্দভদের সারা জীবনভর দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান, তার চেয়ে এই একটা ইভেন্ট জাতীয় অর্থনীতিতে বহুগুণ বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে!”
‘দ্য নট ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ নামে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ওয়েডিং প্ল্যানিং কোম্পানির সিইও টিম চি-ও কিন্তু বিশ্বাস করেন, খরচখরচা বা আড়ম্বর নিয়ে যাই বিতর্ক হোক – এই বিয়ের অনুষ্ঠান অনেকগুলো খাতেই ভারতের জন্য লাভদায়ক হতে পারে।
“যেমন ধরুন এতে নিশ্চিতভাবেই ভারতের ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রির রমরমা হবে, নতুন নতুন ট্রেন্ড তৈরি হবে, ওয়েডিং ভেন্ডরদের চাহিদা বাড়বে, ভারতের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসার ঘটবে – এবং এগুলো সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটাবে”, বলছেন টিম চি।
সোজা কথায় – ভারতে এই বিয়ের জাঁকজমক নিয়ে জনমত স্পষ্টতই বিভক্ত।
একদল যখন মনে করছেন পয়সার এই নির্লজ্জ প্রদর্শনী কিছুতেই মানা যায় না, অন্য দলটির বিশ্বাস এই পয়সা তো দেশের অর্থনীতিতেই কাজে লাগছে, তাহলে ক্ষতিটা কীসের?
বিয়েতে খরচ করার যে আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড
পৃথিবীর সব দেশেই বাবা-মারা নিজেদের সন্তানের বিয়েতে সাধ্যমতো খরচ করেন, কোথাও আবার সাধ্যের অতিরিক্ত। ভারতের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী সাধারণত এই দ্বিতীয় পর্যায়টায় পড়ে।
গত মাসেই জেফারিজের একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ভারত এমনিতে একটি ভ্যালু কনশাস সোসাইটি, মানে ভারতীয়রা কোনও পণ্যের দাম বেশি ধরা হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে খুবই সচেতন। কিন্তু বিয়েটা এখানে একটা ব্যতিক্রম – কারণ তারা বিয়েতে খরচ করতে ভালবাসে।”
তারা আরও জানাচ্ছে, কোভিড মহামারির সময়কার মন্দা কাটিয়ে উঠে ভারতের ‘ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রি’র টার্নওভার এখন আবার ১৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এই অঙ্কটা আমেরিকার এই খাতের মোট পরিমাণের দ্বিগুণ। তবে চীনের তুলনায় খরচের অঙ্কটা কম, কারণ বিয়েতে খরচ করার মোট বহর না কি চীনে ভারতের চেয়েও বেশি।
ওয়েডিং বা বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজনের শিল্পটা এমন একটা সেক্টর, যা ফ্যাশন বা ট্র্যাভেলের (পর্যটন) মতো খাতেরও প্রবৃদ্ধি ঘটায়।
ভারতের স্বচ্ছল একটি পরিবার সন্তানের বিয়ের জন্য সাধারণত ১২ লক্ষ রুপি (১৫০০০ ডলার) খরচ করে থাকে-যেটা গড়পড়তা একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বার্ষিক আয়ের প্রায় তিন গুণ!
এই হিসেব মাথায় রাখলে অবশ্য বলতেই হবে, মুকেশ আম্বানি তার ছোট ছেলের বিয়েতে নিজের মোট আয়ের অতি সামান্য একটা ভগ্নাংশই খরচ করছেন!
মুম্বাইয়ের ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসর নীতিন চৌধুরীর মতে, আম্বানি পরিবার তাদের ‘নেট ওয়র্থ’ বা মোট সম্পদের ‘খুব বড়জোর ০.৫ শতাংশ’ এই বিয়েতে খরচ করছেন।
স্পষ্ট হিসেব জানা না-গেলেও ধারণা করা হচ্ছে মোটামুটিভাবে ৫০০০ কোটি রুপি (বা ৬০ কোটি ডলার) খরচ হয়েছে অনন্ত আম্বানি ও রাধিকা মার্চেন্টের বিয়েতে – সে জায়গায় মুকেশ আম্বানির মোট সম্পদের পরিমাণই ১২৩২০ কোটি ডলার!
কাজেই সাধারণ ভারতীয় বাবা-মাদের তুলনায় মুকেশ আম্বানি নিজের ছোট ছেলের বিয়েতে একটু কিপটেমিই করেছেন, তা বললেও বোধহয় খুব ভুল হবে না!
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা