বাঘায় নদী ভাঙনে ভিটেহারা নিঃস্ব ছয় হাজার মানুষ, অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস হাজার পরিবারের

আপডেট: জুলাই ৮, ২০২৪, ১১:২৬ অপরাহ্ণ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বাঘা প্রতিনিধি:


পদ্মায় ভাঙনে ভিটেমাটি হারা হয়েছেন চকরাজাপুর ইউনিয়নে ১২শো পরিবারের প্রায় ৬ হাজার মানুষ। বাঘা উপজেলার অন্তর্গত চাকরাজাপুর ইউনিয়নের নয়টির মধ্যে তিনটি ওয়ার্ডের বাসিন্দা তারা। তবে এই ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডের তিনভাগের দুইভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় ভিটেমাটি হারা অধিকাংশ মানুষ আর কিনতে পারেন নি বসতবাড়ির জায়গা। এমন ১ হাজার পরিবার অন্য চরগুলোতে চুক্তিভিত্তিতে জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন।

জানা গেছে, পুরো চকরাজাপুর ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষের বসবাস। এসব মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস চরে কৃষি কাজ এবং নদীতে মাছ শিকার করে। নি¤œ আয়ের এসব মানুষ চরে বসভিটা ছাড়াও কারো কারো শত শত বিঘা কৃষি জমি ছিল। তবে বিভিন্ন সময় নদী ভাঙ্গনে বসতভিটা ও কৃষি জমি বিলীনের ফলে তারা আর অন্যচরে এসে জমি কিনে বাড়ি করতে পারেন নি। ফলে এসব মানুষের কেউ কেউ চর ছাড়া হয়েছেন। তবে অনেকের স্থান হয়েছে ভাড়া জমিতে ঘর তুলে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন পদ্মার মধ্যে চকরাজাপুর ইউনিয়ন। ইউনিয়নটিতে ১৫টি চর রয়েছে। এই চরে জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। উপজেলায় ২৬ কিলোমিটার এলাকা পদ্মা নদী রয়েছে। এরমধ্যে ১৫ কিলোমিটার চকরাজাপুর ইউনিয়নের মধ্যে। পদ্মার মধ্যে চকরাজাপুর ইউনিয়নে ৩টি চর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া ৩টি সরকারি প্রাইমারি স্কুল স্থানান্তর করা হয়েছে অন্য চরে। চকরাজাপুর হাইস্কুল যে কোনো সময়ে পদ্মাগর্ভে চলে যাবে। তবে স্কুলটি রক্ষায় দেওয়া হয়েছে বালুর বস্তা।

এছাড়া ভাঙনে পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চকরাজাপুর, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালিদাসখালী চর, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চকরাজাপুর চর। এছাড়া আংশিক টিকে আছে ৭ নম্বর ওয়ার্ড়ের দাদপুর চর, ৯ নম্বর ওয়ার্ড়ের পলাশি ফতেপুর চর, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌমাদিয়া চর, কালিদাশখালির কিছু অংশ। এছাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষীনগর, ১ নম্বর ওয়ার্ডের আতারপাড়া চর, ২ নম্বর ওয়ার্ডের চৌমাদিয়া চর। এসব এলাকার বিদ্যুতের ১৫০টি পোল আগে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

শুক্রবার (৫ জুলাই) সকালে চকরাজাপুরে নদীর ধারে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন জেলে আব্দুর রহমান শিকদার। ৬৬ বছর বয়সী আবদুর রহমান পদ্মা নদীর ভাঙা-গড়ার সাক্ষী। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় হেরেছেন অনেক বার। হারিয়েছেন শেষ সম্বল ভিটেমাটি টুকুও। আব্দুর রহমান শিকদার ৬০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন। কিন্তু নদীগর্ভে বিলীন হতে হতে ভিটেমাটি টুকু নেই তার। এখন এই শিকদারকে পরিবার নিয়ে অন্যচরে জমি ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে।

আব্দুর রহমান শিকদার বলেন, ‘৬৬ বছরের জীবনে বেশ কয়েকবার পেশা বদল করে এখন জেলে তিনি। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে তার (শিকদার) সংসার জীবন। আগে কালিদাসখালী চরের বাসিন্দা থাকলেও এখন চকরাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে থাকে তিনি। স্বাধীনের পরে বাড়ি করি কালিদাশখালি চরে। সেখানে দীর্ঘদিন বসবাস করেছি। বেশ কয়েকবার পদ্মা নদীতে ভিটেমাটি বিলীন হয়েছে। অনেক বার জায়গা পরিবর্তন করে ঘর তুলেছি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে নদী ভাঙনের পরে আর পদ্মার চরে জায়গা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সাত বছর ধরে জমি ভাড়া নিয়ে বাড়ি তৈরি করে আছি। চকরাজাপুর চরে ১ বিঘা জমি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি (শিকদার) ও তার এক ভাই বসবাস করেন। তাদের দুই ভাইকে জমির ভাড়া বাবদ তাদের ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। সেই হিসেবে প্রতি কাঠা ১ হাজার টাকা বছরে ভাড়া।

কষ্ট লাগে একসময় ৬০ বিঘা জমির মালিক ছিলাম। আর এখন মাথা গুজার ঠাঁয় নেই। তবে নদীর গর্ভে বিলীন হওয়া ওই সব জমির কাগজপত্র এখনও তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু জমি নেই।’

শিকদার আরও বলেন, ‘নিজের ঘরবাড়ি, কৃষি জমি চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখেছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখিছি। কিছু বলার ও করার ছিল না। যতটুকু করার ছিল, তাহলে ঘরবাড়ি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া। তাই করেছি। বেশি কিছু করতে পারিনি। পায়ের নিচে ভেঙে নদী গর্ভে যায়। তখন সেখান থেকে দূরে যায়। আবার সেখানেও ভেঙে যায়। সেখান সরে যায়। এমন দৃশ্য খুব মনে পড়ে। কয়েক বছরের মধ্যে ৬০ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চোখের সামনে এগুলো দেখেছি, খুব কষ্ট হয়েছে। রাতারাতি সহায় সম্পদ বিলীন হয়েছে।’

শুধু তাই নয়, এই চরে জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন, গৃহিণী উর্মি খাতুন ও গৃহিণী সাইলা আক্তার শিল্পীর মতো ১ হাজারের বেশি পরিবার। তারা জানায়, তিন থেকে চর বছরের চুক্তিতে জমি ভাড়া নেওয়া হয়। তবে এই চুক্তি মৌখিক হয়ে থাকে। কাগজ-কলমে খুব কম চুক্তি হয়। পুরো চরে বছরে ১ হাজার টাকা কাঠা চুক্তিতে জমি ভাড়া পাওয়া যায়। তারাও এইভাবে জমি ভাড়া নিয়ে ঘর করে বসবাস করছেন।

এই চরে ১৫ কাঠা জমি অন্য মানুষকে ভাড়া দিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, অনেকের জায়গা-জমি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই জমি ভাড়া নিয়ে চরে বসবাস করছেন। বছর চুক্তিতে মানুষ জমি ভাড়া নিয়েছেন।

এ বিষয়ে বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডিএম বাবুল মনোয়ার দেওয়ান বলেন, নদী ভাঙনে চকরাজাপুর ইউনিয়নের ১২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনসংখার হিসেবে প্রায় ৬ হাজার মানুষ হবে। নদীগর্ভে বিলীনের পরে এসব মানুষ আর জমি কিনে বাড়ি করতে পারেনি। সংখ্যা এমন ১ হাজার পরিবার হবে।
এ বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীতে অরক্ষিত বাধ। এই কারণে আস্তে আস্তে বাধ ভাঙছে। বিভিন্ন সময় অনেকেই ভিটেমাটি হারিয়েছেন। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এমন ৭০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ