সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশে একটি বহুল আলোচিত বিষয় শিশুশ্রম। শিশুশ্রমের ব্যাপারে বাংলাদেশ আজ উদ্বিগ্ন। এখানে শিশুশ্রমের চিত্র ভয়াবহ। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অনুযায়ী শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিকে বুঝায়। প্রসঙ্গ কথা হচ্ছে, আয় করার জন্য কাজ করতে গিয়ে শিশুর তাদের বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী বিপদ, ঝুঁকি, শোষণ, বঞ্চনা ও আইনের জটিলতার সম্মুখিন হলে সেই কাজকে শিশুশ্রম বলা হয়।
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে যেখানে কর্মসংস্থানের পরিমাণ সীমিত, শ্রমের মূল্য অত্যন্ত কম, দারিদ্র্যের মাত্রা তীব্র, সামাজিক ভেদাভেদ অত্যন্ত কঠিন, সেখানে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে ৭৬ লাখ শিশু নিজের আর পরিবারের অন্ন সংস্থানের জন্য শিশু বয়সেই শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে দেশে প্রতি ছয়জনে একজন শিশু শ্রমিক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দ্বিতীয় জাতীয় শিশু শ্রমিক সমীক্ষা অনুসারে ছেলে শিশু শ্রমিক ৭৩.৫ শতাংশ, মেয়ে শিশু শ্রমিক ২৬.৫ শতাংশ। গ্রাম ও শহর উভয় স্থানে শিশু শ্রমিক কাজ করে। তারা কৃষি, শিল্প, সেবা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ৯৩.৩ শতাংশ শিশু শ্রমিক অস্বীকৃত কাজ করে। শিশুদের সংগঠিত ও অসংগঠিত উভয় ধরনের খাতেই নিয়োগ দেয়া হয়। অসংগঠিত খাতে কাজের পরিবেশ অত্যন্ত নি¤œমানের। এদের তেমন কোনো পারিশ্রমিক থাকে না। এরা আইনের দ্বারাও তেমন সুরক্ষিত নয়। আমাদের দেশের শিশুরা সাধারণতঃ যেসব কাজ করে তা হচেছ খেত-খামারে, গৃহস্থালি কাজে, বাসাবাড়িতে ঝি-চাকর হিসেবে, বিভিন্ন খাবারের দোকান ও প্রতিষ্ঠানে, ক্ষুদ্র শিল্পে প্রভৃতি।
আমাদের দেশের মোট শিশু শ্রমিকের মধ্যে ১৩ লক্ষ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। শিশুরা যৌনকর্ম, চোরাচালান, বিভিন্ন ফ্যাক্টরির কাজ, ট্যানারি, লবণ কারখানা, পরিবহন ক্ষেত্রে, ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ, উটের জকিতে, মাদক ও অস্ত্র বহন, ওয়েল্ডিং, ইটভাটা, জাহাজভাঙা, খনি সংক্রান্ত কাজ, নির্মাণ, গ্লাস ও কাঁচ তৈরির কারখানা, পাথর ভাঙা প্রভৃতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। একাজগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে অঙ্গহানির ঝুঁকি আছে, মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে।
বাংলাদেশ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ষধনড়ঁৎ ংঃঁফরবং এর মতে, দেশে ৩৭% শিশু বাসা বাড়িতে কাজ করে যাদের বয়স ৫ থেকে ১৪ বছর। গৃহকাজে নিযুক্ত শিশুরাই সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশু গৃহকর্মীদের ১৭ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার। ঢাকার মিরপুর মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় পরিচালিত এক গবেষণা মতে মূলতঃ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে পরিস্থিতি একই রকম। প্রায়ই গৃহকর্মীকে শারীরিক নির্যাতন, এমনকি হত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। তা থেকেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা কল্পনা করা যায়।
শিশুশ্রমের সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে ছিন্নমূল পথশিশু। তাদের থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ৮/৯ অথবা ১২/১৩ বছর বয়স তাদের অস্থিচর্মসার দেহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে। কেউ কুলি, কেউ হকার, কেউ মুটে, কেউ কারখানার শ্রমিক হিসেবে। ছিন্ন ময়লা জামা, ঘর্মাক্ত মুখ, নি¤œ মজুরির সাথে মালিকের দুর্ব্যবহার, শারীরিক নির্যাতন তো আছেই।
শিশুদের যৌন পেশায় নিয়োজিত করার খবর নতুন নয়। বাংলাদেশের শিশুদের ব্যাপকভাবে দেশ-বিদেশের পতিতালয়ে দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের জঘন্য কাজে শিশুদের নিয়োজিত রেখেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। এতে ভবিষ্যত নষ্টের পাশাপাশি শিশুরা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
দারিদ্র্যই প্রধানতঃ শিশু শ্রমের জন্য দায়ী। সম্পদের অপ্রতুলতা, অসম বণ্টন, সুশাসন, ন্যায়বিচার চর্চার অভাব, আমাদের সমাজে সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশের ধারাটি বিঘিœত করছে। কর্মজীবী শিশুদের বেশিরভাগই চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয় এবং বেঁচে থাকে। তারা উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোন সুযোগ পায় না। শিশুদের তিন-চতুর্থাংশ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নীচে। তাছাড়া বেকারত্ব ও জনসংখ্যার চাপ, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, সচেতনতার অভাব শিশুশ্রমের কারণ। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার ৪৫%।
শিশুশ্রমের ফলে প্রধানত শিশু স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। দ্বিতীয়ত এর ফলে শিশুর লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটে বা বন্ধ হয়ে যায়। শিশুর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তৃতীয়ত শিশুশ্রমকে খুব কম মূল্যের বিনিময়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, শিশুকে শোষণ করা হয়। এছাড়া কাজের ধরন অনুযায়ী শিশুরা নানা রকম সমস্যার সম্মুখিন হয়। শিশুশ্রমের ব্যাপকতা, বিরূপ প্রভাব ভবিষ্যত প্রজন্মে শারীরিক, বুদ্ধিভিত্তিক, নৈতিক উন্নয়নের কারণ। শিশুশ্রম শিশু মৃত্যুর কারণ। দারিদ্র্য, অপর্যাপ্ত গৃহায়ণ, খাবার পানির দুষ্প্রাপ্যতা, পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা, স্বাস্থ্যসেবার সমস্যা শিশুকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
শিশু শ্রমিকেরা পরিবার এবং স্বাভাবিক সামাজিক পরিবেশ থেকে কর্মসময়ে বিচ্ছিন্ন থাকে। এতে তাদের সামাজিকীকরণ ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ সমস্যাগ্রস্ত হয়। এরূপ অবস্থায় তাদের ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিচ্যুত আচরণ ও অপরাধপ্রবণ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এর ফলে সামাজিক বিশৃংখলা ও ভোগান্তি বাড়ে। কিশোর অপরাধ প্রবণতার অন্যতম কারণ শিশুশ্রম। বিশেষ করে যে সব শিশু রাস্তার কুলি-মজুরের কাজ করে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে গৃহের শ্রমিকেরা বিভিন্ন ধরনের চুরির কাজে লিপ্ত হয়। শিশু নির্যাতনের শিকার শিশু শ্রমিকেরা সামজের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়।
শিশু প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানে বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ৪নং ধারা মতে, নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই কাউকে নিবৃত্ত করবে না। অর্থাৎ এই বিধানের আওতায় নারী ও শিশুদের কল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। ৩৪ নং অনুচ্ছেদে জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৭৯ সালের ফ্যাক্টরি নীতিমালার ৪৫ ধারা অনুযায়ী অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাউকে ভারী যন্ত্রপাতি, মেশিন সংক্রান্ত কাজে নিয়োগ করা যাবে না।
বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক সংগঠন এখন শিশুশ্রম বন্ধ, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার মত কাজ গুরুত্বের সাথে করে যাচ্ছে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ তথা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, শিল্প কারখানা স্থাপন ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারলে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে। শিশুদের জীবনের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য চাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সদিচ্ছা। আর সেই সাথে সম্পদের সুষম বণ্টন, শিশুদের অধিকার, সুযোগ সুবিধাদি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজের প্রগতি ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণের কথা ভাবা যায়।
শিশুশ্রম প্রতিরোধে অবিলম্বে শিশুনীতি বাস্তবায়ন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম বন্ধ করা, সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসন করা, পথশিশু, ছিন্নমূল শিশু ও শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। শিশুদের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য, আহার এবং মেধাবিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা একান্ত কর্তব্য।
শিশুশ্রমের কারণে শিশুদের সোনালী শৈশব বাধাগ্রস্ত হয়। মেশিনের যাঁতা কলে নিষ্পেষিত হয় তাদের জীবন। অথচ শিশুদের মাঝে সুপ্ত রয়েছে অসীম সম্ভাবনা। তারা নতুন কুঁড়ির মত। ফুল হয়ে ফোটার অপেক্ষায় রয়েছে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমানের শিশুদের ওপর। এ শিশুদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে আমাদের। শিশুদের প্রতি বড়দের আচরণে আনতে হবে ব্যাপক পরিবর্তন। এ বিশ্বকে সত্যিকার অর্থে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: টিউটর ও সহকারী অধ্যাপক, বাউবি- তালন্দ ললিতমোহন ডিগ্রি কলেজ তানোর।