রাবি প্রতিবেদক :
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ ড. সুজন সেন দায়িত্বে থাকাকালে হল ফান্ডের টাকা দিয়ে প্রায়ই দুপুরের খাবার খাওয়ার পাশাপাশি টয়লেট ক্লিনার, এয়ার ফ্রেশনার, টিস্যু পর্যন্ত ক্রয় করে বাসায় পাঠাতেন। হলের সিনিয়র সহকারী মামুনুর রহমান এমনটিই জানিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, দুই দফায় আম কিনে কিছু বাসায় আর কিছু ঢাকাস্থ অতিথিকে পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়। এছাড়া, ভুয়া ভাউচার, ভুয়া আবেদন, নিজের দোকানের ভাউচার এবং হল সংস্কার ও বিভিন্ন আয়োজনের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
একাডেমিক পরিসরেও তার চরম অযোগ্যতা রয়েছে বলে অভিযোগ বিভাগের শিক্ষার্থীদের। চারুকলার শিক্ষক হয়েও শিক্ষকতা জীবনে কখনই কোনো শিক্ষার্থীকে হাতে কলমে একটা ড্রইং পর্যন্ত না দেখিয়ে দিয়ে উল্টো নম্বর কম দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন ধ্বংস করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
টিস্যু ক্রয়ের বিষয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সিনিয়র সহকারী মামুনুর রহমান বলেন, হল ফান্ডের টাকা দিয়ে ৪ হাজার ২০০ টাকায় অনলাইনে দুটি টিস্যু বক্স অর্ডার করেন তিনি। এর মধ্যে একটি হলে আসছিলো। সেটি আমি গ্রহণ করেছি। পরে দেখি ভাউচারে দুটি টিস্যু বক্স উল্লেখ করা আছে। আরেকটা টিস্যু বক্স হয়তোবা উনার বাসায় বা বিভাগে আছে।
শুধু তাই নয়, হল ফান্ডের টাকা দিয়েই ডাইনিং থেকে দুপুরের খাবার খেতেন ড. সুজন সেন। এ বিষয়ে মামুনুর রহমান বলেন, ‘প্রথমদিকে খাবারের বিলগুলো হল ফান্ড থেকেই আমি দিয়েছি। পরবর্তীতে এটা নিয়ে কথা উঠে। ছাত্রদের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হয়।
এরপর তিনি তার পকেট থেকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। এছাড়া, হল ফান্ডের টাকা দিয়ে হারপিক, ডেমফিক্স, ওডোনিল, রুম স্প্রে ওনার অর্ডারে প্রথমদিকে প্রতিমাসে তার বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। পরবর্তীতে একসঙ্গে অর্ডারলি পিয়নের মাধ্যমে তার বাসায় তিন থেকে চারমাসের জন্য এসব পাঠিয়ে দিতাম।’
আম ক্রয়ের বিষয়ে মামুনুর রহমান বলেন, হলের এক কর্মকর্তার থেকে তিনি আম কিনেন। সেই আমের কিছু অংশ তিনি বাসায় রাখেন, আর কিছু অংশ ঢাকায় পাঠান। বাসায় আম খাওয়ার পর ভালো বলে তিনি সুনাম করেন। পরবর্তীতে আরেক দফা আম কিনেন তিনি। সেবার একটু দাম বেশি চাওয়ায় আমগুলো ভালো না বলে জানান। প্রথমে নিজের পকেট থেকে টাকা দিলেও পরবর্তীতে ওই টাকাটি হল ফান্ডের বিলের মধ্যে তিনি সমন্বয় করেন।
এছাড়া, ২০২১ সালের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে তিনি ৮৭টি ট্র্যাকসুট, ৯৭টি ফুল প্যান্ট ও জার্সি এবং ৭৮টি হাফপ্যান্ট ক্রয় দেখান। এ বিষয়ে সে সময়ে খেলাধুলায় অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘সেই সময়ে যারা খেলোয়াড় ছিলো, তারা সবাই জানে যে আমাদের হল থেকে সর্বোচ্চ ৩৫জন খেলোয়াড় ছিলো।
এটা কখনই ৯৭জন বা ৮৭ জন হবে না।’ প্রমাণসরূপ তিনি খেলোয়াড়দের একটি গ্রুপ ছবিও দেখান। যেখানে একজন খেলোয়াড় অনুপস্থিত থাকায় ৩২ জনকে দেখা যায়।
হলে প্রাধ্যক্ষ থাকাকালিন এসব দুর্নীতির পাশাপাশি ভুয়া ভাউচার, নিজের দোকানের ভাউচারে অতিরিক্ত বিলের মাধ্যমে এবং হল সংস্কার ও বিভিন্ন আয়োজনের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া ভুয়া আবেদনের মাধ্যমে ছাত্র কল্যাণ তহবিল থেকে ৫২ হাজার ৫০০টাকা লোপাট করেছেন তিনি।
হলের দুর্নীতির পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে তিনি অযোগ্য বলে দাবি করছেন তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, চারুকলার শিক্ষক হয়েও তার শিক্ষকতা জীবনে কখনোই কোনো শিক্ষার্থীকে তিনি হাতে কলমে একটা ড্রইং পর্যন্ত দেখিয়ে দেননি। উল্টো শিক্ষার্থীদের ভালো কাজগুলো তিনি কোনো কারণ ছাড়াই নিয়ে রাখেন।
এ বিষয়ে চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবু রায়হান বলেন, ‘আমার সাড়ে ৬ বছরের শিক্ষাজীবনে আমাদের তিনি কোনো ব্যবহারিক কাজ হাতে কলমে শেখাননি এবং দেখিয়েও দেননি। আমাদের কোনো কাজে সমস্যা মনে হলে তিনি সেটা স্কিপ করে গেছেন। ক্লাসের কিছু শিল্পকর্ম মার্কিং শেষে তিনি নিয়ে যান, পরবর্তীতে সেসব শিল্পকর্ম আর ফেরত দেন না। এসব কাজ তিনি পরবর্তীতে নিজের নামে অনেককে উপহার হিসেবে দেন।’
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীর রাহুল দেবনাথ বলেন, ‘ড. সুজন সেন তার শিক্ষকতা জীবনের ইতিহাসে কাউকে কাজ দেখিয়ে দিয়েছেন, এমনটা কখনোই হয়নি। ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কম নম্বর দেওয়ার পাশাপাশি তিনি অযোগ্য কাজগুলোকেই বেশি নম্বর দিতেন। কোনো কাজ পছন্দ হলে সরাসরি মার্কিং না করে সেটি চেম্বারে নিয়ে যেতে বলেন। পরে তিনি সেটা নিয়ে রেখে দেন। পরবর্তীতে সেটি ফেরত না দিয়ে সেটা কাউকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেন।
পরীক্ষায় তার কোর্সে আমাদের আশানুরূপ নম্বর পাই না আমরা। এছাড়া বিভিন্ন অযুহাতে কোন শিক্ষার্থীর কাজ না নিয়ে সেই কোর্সে তাকে শূণ্য বসিয়ে দেন। মূলত সে চায় ওই শিক্ষার্থী তার পায়ে পড়ুক, অনুরোধ করুক। এটা দিয়ে আসলে তিনি ভয়ভীতি দেখিয়ে থাকেন।’
হল ও একাডেমিক পরিসরে এসব অযোগ্যতা ও দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে জানতে ড. সুজন সেন’র মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
এর আগে, গত ৮ সেপ্টেম্বর ড. সুজন সেনের একাডেমিক অযোগ্যতা ও অনিয়ম, হল ও একাডেমিক পরিসরে দুর্নীতি বিষয়ে উপাচার্য, ছাত্র উপদেষ্টা এবং বিভাগের সভাপতি বরাবর প্রমাণসহ প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগ জানান শিক্ষার্থীরা।
সে সময় তারা তার অপসারণের দাবি জানান। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিভাগের জরুরী একাডেমিক কমিটির সভায় ড. সুজন সেনকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। একইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করবেন বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন। তবে গত ৮ দিনেও উপাচার্যকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
তদন্ত কমিটির বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এধরণের আরও বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। এজন্য আমাদের একটু সময় লাগছে। তবে এ সপ্তাহের ভিতরেই এগুলোর ব্যাপারে আমরা তদন্ত কমিটি করব।’