বীর মুক্তিযোদ্বা মিন্টুকে নিয়ে কিছু কথা

আপডেট: অক্টোবর ১৪, ২০২৪, ১০:০৫ অপরাহ্ণ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন



না ফেরা দেশে চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজউদ্দিন মিন্টু । তার অনন্ত যাত্রায় শেষ বিদায় জানাতে রাজশাহীর প্রগতিশীল কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবীসহসহ সকল পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মিন্টু দীর্ঘ দিন ধরে ভুগছিলেন দুরারোগ্য ক্যান্সারে। তার মৃত্যুতে রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপূরণ ক্ষতি হয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। সার্টিফিকেট অনুযায়ী নাম মিহাজ উদ্দিন, ডাক নাম মিন্টু তবে রাজশাহীর মানুষ তাঁকে পুষ্প মিন্টু হিসাবেই বেশি চিনতেন।

চিরকুমার মিনহাজ উদ্দিন মিন্টুর রাজশাহী মহানগরীর নিউমাকের্টে পুষ্প স্টুডিও ছিল। পুষ্প স্টুডিওটা রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদের আড্ডার স্থল হিসাবে বহুদিন যাবৎ পরিচিত। এই স্টুডিওটি ‘পুষ্প আড্ডা’ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিল। মিনহাজ উদ্দিন মিন্টুর জন্ম ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি, সেই সময়কার রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠ ছোট বনগ্রামে (বর্তমানে ছোটবনগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা)। তার বাবার নাম সামসুদ্দিন আহামেদ।

তার পিতা ছিল একজন কৃষক। মিন্টু বেড়ে উঠেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ধারায়। ১৯৬২’র ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে তাকে দেখা যেত। তখন তার বয়স হবে ১১ কি ১২ বছর । পাকিস্তানের শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতি এবং ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলনসহ পাকিস্তান বিরোধী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের মিছিলে মিন্টু থাকতেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আরিফ টিপু তাকে হাস্যচ্ছলে বলত ‘টোকাই মিন্টু’। তার পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ছিল অসচ্ছল। এবং তৎকালীন দেশের রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে তিনি মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। অল্প বয়সেই তিনি বামপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তার একাডেমিক শিক্ষার পরিধি না থাকলেও বাঙালির ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপর ছিল তার অগাধ জ্ঞান।

মিন্টু বলতেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তারা সশস্ত্র হয়ে পাক শাসন বিরোধী সংগ্রামে সংগঠিত হওয়ার জন্য উদ্যোগী হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাক সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিরস্ত্র পুলিশ সদস্যদের উপর হামলা চালায় তার প্রতিবাদে জ্বলে উঠে বাংলাদেশ। সেই সময় মুক্তিযোদ্বা মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। পাক সেনাদের চলাচল এবং জীবনযাত্রা অচল করে দেয়ার জন্য তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

মিনহাজউদ্দিন মিন্টু বড় ভাই হায়দার আলীর সাথে রাজশাহী সেনানিবাসের পানির সরবরাহের লাইন কেটে দিয়েছিলেন, এটা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিকের কথা। পাক সেনাস্থল রাজশাহী সেনানিবাস পানিশূন্য হয়ে পড়েছিল তাদের গেরিলা আক্রমণে। তার একদিন পর বড় ভাই হায়দার এবং বেশ ক’জনকে সাথে নিয়ে মিনহাজউদ্দিন মিন্টু সেনানিবাসের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তখন মিনহাজ উদ্দিন মিন্টুর কোন সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না, তবে তিনি এটা অনুধাবন করেছিলেন পাক হায়েনাদের প্রতিহত করতে হবে যে কোন ভাবে। তাই তিনি জীবন বাজি রেখেই লড়ে ছিলেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে।

১৯৭১ সালের জুন-জুলাইয়ের দিকের ঘটনা, তিনি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় টর্চার সেলে। পাক সেনারা তার শরীরের উপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন। ওই সময় পাক সেনারা বেলপুকুরিয়ার দিকে নিয়ে যায় মিন্টুকে কারা মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেনাদের খোলা জিপে করে। জিপটি যখন বেলপুকুরিয়ার খালের ব্রিজটি পার হবে ঠিক এই সময় তিনি জীবনাবাজি রেখে জিপ থেকে লাফিয়ে পড়েন খালের পানিতে। জিপটি ছিল গতিসম্পন্ন চলন্ত তাই কিছু দূরে গিয়ে থামতে হয়। খালটির দুপাশে ছিল আখখেত যা অনেকটা গভীর বনের মতো।

আর এই সময়টুকুর মধ্যে তিনি খালের পাশের আখখেতে লুকিয়ে পড়েন। তিনি এমনভাবে লুকিয়ে পড়েছিলেন যে, পাক সেনারা অনেক খোঁজাখুজি করেও তাকে ধরতে পারেনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে আখখেতের মধ্যে দিয়ে মধ্যরাতের দিকে তিনি পৌঁছেন নওহাটায়। এই ঘটনার পর তিনি রাজশাহী থেকে চলে যান রংপুরে। মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে আসামের তেজপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে রংপুর অঞ্চলে বাকী সময়টা যুদ্ধ করেন। তিনি ওই সময় রংপুরের মানুষের সাথে এতটাই মিশে গিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বছর তিনি রংপুরে কাটান। তার নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ছিল না দীর্ঘ দিন।

আজ যারা তার শুভাকাক্সিক্ষ কেউ কিন্তু তার নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় নি। এই শুভাকাক্সিক্ষরা রাজশাহীর দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি ফজলে হোসেন বাদশা এবং খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্টসহচর হিসাবে সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন বহু। ২০১৩ সালে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ গেরিলাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় গেজেটভুক্ত করা। সরকারের মুক্তিযুদ্ব বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন তারিখ ৭ শ্রাবণ/১৪২০ বাংলা- ২২ জুলাই/২০১৩ নং ৪৮.০০.০০০০.০০৪.৩৭.১৪৯ ২০১৩-৪৩৯ জাতীয় মুক্তিযোদ্বা কাউন্সিল আইন ২০০২(২০০২ সালের ৮ নং আইন) এর ৭(ঝ) ধারা অনুযায়ী ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনী এবং এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ২৩৬৭ জন প্রকৃত মুক্তিযুদ্বার তালিকা সরকার রূলস অব বিজনেস ১৯৯৬ এর সিডিউল-১ (এলোকেশান অফ বিজনেস) এর তালিকা ৪১ এর ৬ নং ক্রমিকের ক্ষমতা বলে তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে।

বিজয়ের ৪২ বছর পর একটি বাহিনী রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। সেই সাথে স্বীকৃতি মেলে মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজউদ্দিন মিন্টুর। মিনহাজ উদ্দিন মিন্টুর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার মূল কাজটি করেছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাজশাহী জেলার সদস্যরা। মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু তার ভাতার টাকা নিজে ভোগ করেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর মুক্তিযোদ্ধার ভাতায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছোট ভাই জেন্টুর সংসার চলত। এই জেন্টু সারা মাসের ওষুধের ব্যয়ে অর্থ যোগান দিতেন মিন্টু। তাছাড়া প্রতিমাসেই মুক্তিযুদ্বের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলিকে তিনি চাঁদা দিতেন।

তিনি যে বাড়িটিতে থাকেন তা জেন্টু ও তার সন্তাানদের নামে উইল করে দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বাসী মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু মনে করতেন, এদেশে মুক্তিযুদ্বের আদর্শ বাস্তবায়িত হলে কোন দরিদ্র থাকবে না। তখন আর এদেশের কোন মানুষের প্রয়োজন হবে না, কারো সাহায্যের। তার বিশ্বাস ছিল এদেশ ক্ষুধা এবং দারিদ্রমুক্ত করতে হলে মুক্তিযুদ্বের আদর্শের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক:- কলামিস্ট