নূপুর বাজে আঙিনায়

আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৩, ১১:২২ অপরাহ্ণ

নাহিদ হাসান রবিন:


আজ যে ওকে প্রথম দেখলাম তা নয়, মাঝে মাঝেই দেখি। তবে প্রথম দেখেছিলাম বছর দুয়েক আগে। মরচে রঙের থ্রি-পিস পরা লম্বা গড়নের এক মানবী। চেহারায় তেমন মাধুর্য না থাকলেও কোথায় যেন একটা আকর্ষণ আছে। এ যুগের নারী হলেও অন্যদের মতো বেহায়াপনার ছাপ নেই ওর মাঝে। হাঁটা চলা ও পোশাক-আশাকে যথেষ্ট মার্জিত ভাব লক্ষ্য করা যায়। এলাকাটি বাণিজ্যিক বলে এখানে অনেক এলাকার লোকজন আসে যার যার কাজে। ও হয়তো কোনো কাজ নিয়ে আসে। তবে এই এলাকাতে কি কাজে আসে তা বোঝা খুব সহজ। কারণ এইখানে শুধু এক ধরণের কাজই হয়। চলার পথে দু-একবার ওর চোখে চোখ পড়লেও কখনো কথা বলা হয়ে ওঠে নাই। অবশ্য কখনো কখনো কথা বলার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু আজ কাল করতে করতে তা আর হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া অযাথাই একটা মেয়ে লোকের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার কি দরকার। শেষে আবার কি না কি ভাবে। এভাবে কেটে গেছে বছর দুয়েক। এর মাঝে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। ও যে আমাকে দেখে নাই তা নয়, বরং আমাকে দেখলে চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে। যার ফলে কথা বলার আগ্রহ থাকলেও ইচ্ছে করেই বলিনি। এইতো সেদিন আমরা দু-বন্ধু চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম, ওকে দেখলাম, মনে হলো ভিতরে আসবে। আমার চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে চলে গেলো। তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। রাগও হয়েছিল খুব। কি বা এমন হয়েছে যার জন্য এত ভাব। চেহারাও তো এমন আকর্ষণীয় কিছু না, গায়ের রঙও কালো। এত ভাবের তো কিছু দেখি না। ওর চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়েরাও আমার সাথে একটু মেশার জন্য ঘুরঘুর করে। আর ওর মতো মেয়ে কিনা…। না কি রঙ চটা জিন্সের ছেঁড়া প্যান্টের মতো সাদা চামড়ার বদলে কালো চামড়ার গুরুত্বই বেড়ে গেলো। অবশ্য এও হতে পারে যে, আমার সামনে আসার মতো সাহসই নেই। নয়তো… সেই মুহূর্তে বিষয়টা আমার মাথায় বেশ ঘুরপাক খেয়েছে। সেদিনই সংগ্রহ
করেছি ওর নাম ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার। ফোন করবো করবো করে অনেক দিন চলে গেছে। এর মাঝে অবশ্য ওকে আর চোখেও পড়ে নাই। বেশদিন পর সেদিন দেখলাম পিংক রঙের একটা থ্রি-পিস পরা, পায়ে রুপার নূপুর, চুলগুলো পরিপাটি করে রাখা। গায়ের রঙ কালো হলেও সেদিন কিন্তু দেখতে খুব খারাপ
লাগছিল না। অবশ্য ভালোলাগার মতো কোনো বিশেষ কিছু লক্ষ্য করা না গেলেও কেনো জানি বেশ ভালোই লাগছিল। হয়তো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চিরন্তন দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশও হতে পারে। একবার ভেবেছিলাম ডেকে কথা বলব। ব্যস্ততার কারণে সেদিনও হয় নাই। বিকালে হঠাৎ করেই ওর কথা মনে পড়ায় ফোন করি। এতদিন ওকে নিয়ে যা ভাবছিলাম কথা বলার পর অবশ্য তেমনটি মনে হলো না। যা মনে হলো বেশ ভদ্র ও বিনয়ী। তাহলে এতদিন আমাকে দেখে সরে গেছে কেনো? হয়তো সংকোচবোধ।
ওর সাথে আমার দ্বিতীয়বার কথা হয় পনের-বিশ দিন পর। সেদিন কথা বলার পর আবার মনে হলো অন্যরকম। প্রথম কথা বলার দিন ও বলেছিল এটা কি আপনার নাম্বার? আমি বলেছিলাম হ্যাঁ। ও নাম্বারটা রাখবে বলেছিল। অথচ সেদিন ফোন করার পর ও বলল কে বলছেন? আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। পরে অবশ্য কথা বলতে খারাপ লাগেনি। ও বলেছিল আবার যখন শহরে আসবে, ফোন করে আমার সাথে দেখা করবে। অবশ্য কথাটি ও রাখেনি। আমি কয়েক দিন আগেও ওকে শহরে দেখেছিলাম। আমার চোখে চোখ পড়লেও কথা হয়নি। আমি ওকে চিনলেও ও আমাকে চেনে কি না এটা অবশ্য জানি না। জানলে হয়তো কথা বলত। তবে ওইদিন আমার এক পরিচিত লোক আমাকে বলল ও নাকি তার সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করেছে। বলেছে আমার সাথে দেখা করবে। শুনে এক অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করেছিলাম। এভাবে আরও কয়েকদিন কেটে গেছে। এর মাঝে আর কোনো কথা হয় নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে পড়েছে। কখনো ফোন করে কথা বলতে ইচ্ছে করেছে, কিন্তু করি নাই এই ভেবে যে, ও তো কখনো ফোন করে নাই। আমি এত আগ্রহ দেখাতে যাব কেনো। এমন তো না যে ওর প্রেমে পড়েছি। তারচেয়ে যখন সামনা সামনি দেখা হবে তখন সরাসরি কথা বলব। এভাবে কেটে যায় আরও কিছু দিন।
ওর কথা মনে থাকা তো দূরের কথা, কর্ম-ব্যস্ততায় নিজের নামটাও ভুলে যাওয়ার অবস্থা হয় মাঝে মাঝে।
আজ এক দোকানে ওর সাথে দেখা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, নিজ থেকে বললাম আপনি নিশ্চয় বনলতা?  জ্বি। আপনি?  মাহিন।
মৃদু হেসে আমাকে সালাম জানালো। দু-একটা কথা বলার পর দু’জন গিয়ে একটা হোটেলে বসলাম। সেখানে বসে হালকা খাবার খেতে খেতে অনেক কথা হলো। জানলাম ওকে, জানল আমাকেও। বিকালে কর্মস্থলে বসে ওর কথা মনে হলো। ওর বাড়ি শহর থেকে অনেক দূরে। যেতে প্রায় দু-ঘণ্টা সময় লাগে। যেহেতু আমার এলাকায় এসেছিল তাও আবার প্রথম সাক্ষাৎ, অনেকটা ভদ্রতা দেখানোর জন্যই সন্ধ্যার একটু আগে ফোন করি ঠিক মতো বাড়ি পৌঁছে কি না জানার জন্য। ফোন রিসিভ করেই বলল হ্যালো মাহিন সাহেব। মনে হলো যেন কত কালের চেনা। আমার হৃদয় আঙিনায় বেজে উঠলো সেই নূপুরের ধ্বণি। এখন মাঝে মাঝেই ওর সাথে দেখা হয়। সেদিন একটা কড়া সবুজ রঙের চাদর জড়িয়ে এসেছিল। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপিস্টিক পরা, কপালে বড় লাল টিপ। মনে হচ্ছে কোনো বিশেষ দিবস। যা হোক দেখতে কিন্তু মন্দ লাগছিল না। কিন্তু আমার ভেতর অতটা আগ্রহ কাজ করছিল না। একসাথে বসে চা-চক্র সারলাম। নিজ থেকে অনেক কথাই বলল তবুও আমার কেনো জানি অস্বস্বিবোধ হচ্ছিল। ওর চোখে চোখ পড়তেই কেন জানি খুব লজ্জা লাগছিল। তবে মুহূর্তের জন্য একটা ছোট্ট আনন্দ আমার শরীরের মধ্যে ঢেউ খেলে গিয়েছিল। ঢেউয়ের প্রচ- গতিতে আমার ভেতরটা থরথর করে কাঁপছিল। আমি দেখলাম ওর লোমগুলো জেগে উঠেছে। কথাগুলো কেমন ধীরে ধীরে জড়িয়ে আসছে। তাহলে কি আমার মতো ওরও…। হয়ত তাই।