চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডায়াবেটিক হাঁসপাতাল : একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান

আপডেট: মে ৭, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু


যোগ্য নেতৃত্ব এবং ঐকান্তিক চেষ্টা থাকলে অসাধ্য সাধন করা যায়। তার উজ্জ্বল নমুনা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক জেলার ডায়াবেটিক সমিতি এমন উন্নয়নের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ছোট জেলা হিসেবে এই হাসপাতালটির উন্নয়ন অভাবিত ও দৃশ্যমান। এই উন্নয়নের পেছনে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির প্রচণ্ড সদিচ্ছা ও স্বচ্ছ কর্মতৎপরতা। জন্মলগ্ন থেকেই এটি একটি দুর্নীতিমুক্ত বেসরকারি সংগঠন। সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা বা সিস্টেম গড়ে তুলেছে। এজন্য রয়েছে একটি স্বাধীন নিরীক্ষা কমিটি। যা স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণ হয়েছে গত ৩১ বছরে। আর সেখানেই তাদের সফলতা।

একত্রিশ বছর র্পূর্বে ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ এ প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহীদ সাটু হলের একটি ছোট কক্ষে। তখন সাধারণ মানুষ ডায়াবেটিক রোগ সম্পর্কে এতো সচেতন ছিল না। তাই ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতন করলে ক্রমশ ডায়াবেটিক রোগীরা চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেন। এসময় তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা আব্দুল মান্নান সেন্টুর সহযোগিতায় ৩৪ শতাংশ জমি দান হিসেবে পাওয়া যায়। সেখানে জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত একটি ভবনে স্থায়ীভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি।

পরিচালনার দায়ভার গ্রহণ করে ২০ সদস্য বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি। প্রতি বছর রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন এই পুরাতন ভবন সংলগ্ন ৩৬ শতাংশ জমি ক্রয় করতে হয় প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা মূল্যে। যার সবই ব্যক্তিগত দান ও হাসপাতালের আয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ। এরপর ২০১৯ সালে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারি সহযোগিতার আবেদন করা হয়। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৯ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান। যেটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় ১৮ কোটি ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে গত বছরের প্রথমার্ধে।

চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ৪ তলা বিশিষ্ট ৫০ শয্যার একটি আধুনিক ডায়াবেটিক হাঁসপাতাল। গত বছর মে মাস থেকে সেখানে হাসপাতাল সহ নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা অব্যাহত আছে। ১৩ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই চারতলা ভবনের চারতলায় রয়েছে ৫০ শয্যার হাঁসপাতাল এবং অন্যান্য তলায় রয়েছে অফিস, ইমাজের্ন্সি, ল্যাব, চিকিৎসকদের কক্ষ, অপারেশন থিয়েটর ইত্যাদি এবং সেইসাথে দুটি লিফট। এছাড়া সেখানে রয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে কেনা এক্সরে মেশিন, আল্ট্রাসনো মেশিন, ইসিজি মেশিনসহ ল্যবরেটরির অন্যান্য যন্ত্রপাতি।

ভবনটি এমনি মনোরম পরিবেশে অবস্থিত যে ভবনটির যেকোনো তলা থেকে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ভবনটির পশ্চিমের খোলা বাতায়ন দিয়ে আসা নির্মল ঠান্ডা বাতাস শরীর ও মনকে জুড়িয়ে দেয়। এ হাসপাতালে কোনো রোগী এক সপ্তাহ থাকলে তার অর্ধেক রোগ এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে। আগামীতে এই ভবনটি ৯ তলা করার সুযোগ রয়েছে। সেখানে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ খোলার ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে। এদিকে পাশের পুরাতন ভবনটিতে ডায়াবেটিক নার্সিং ইনস্টিটিউটের কাজ শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

সমিতির মূল আয়ের উৎস ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও অন্যান্য প্যাথলজিক্যাল টেস্ট। ২০২২ ও ২০২৩ সালের আয় ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, আয় হয়েছে যথাক্রমে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার এবং ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। আয়ের মোট ২৪টি খাতের মধ্যে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট বা ল্যাব থেকে যে আয় হয়েছে তা অন্য ২৩ টি খাতের চেয়ে বেশি। উল্লিখিত আয় দিয়েই ৫ জন স্থায়ী ডাক্তার, ১জন খণ্ডকালীন ডাক্তারসহ ৪৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া হাপাতালের এস্টাবলিসমেন্ট খরচ তো আছেই। ফলে কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রাপ্য ন্যাায্য বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরেও কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের শ্রম ও ত্যাগ দিয়ে রোগীদের সহযোগিতা করতে কার্পণ্য করে না এই প্রতিষ্ঠানকে ভালোবাসে বলে এবং আগামীতে বেতন বৃদ্ধির আশায়।

সমিতিতে সাধারণ সদস্য নেই। ফলে মাসিক চাঁদা থেকে কোনো আয় হয় না। যারা আছেন তারা সবাই আজীবন সদস্য বহুকাল থেকে। প্রতিষ্ঠানটির জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। যা কিছু পাওয়া যায় তা দাতা সদস্যদের কাছ থেকে এবং প্রতি বছর ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া বারডেম থেকে। সমিতিতে ৬২৯ জন আজীবন সদস্য, ৭ জন দাতা সদস্য এবং ৬ জন প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য রয়েছেন।

এ হাসপাতালে প্রতিমাসে নিয়মিত রোগী হয় প্রায় তিন সহস্রাধিক। গত ২০২২ ও২০২৩ সালে ল্যাব থেকে আয় হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩৯ হাজার ৭৯৬ টাকা। এ সময় ৭২ হাজার ৭৮০ জনের ডায়বেটিস, ৬২৩ জনের আলট্রাসনো, ২ হাজার ৭৮০ জনের ইসিজি, ৬০০ জনের এক্সরে, ৮ হাজার ৩০০ জনের দাঁত ও ১ হাজার ৩২ জনের চোখ পরীক্ষা করা হয়েছে। এখানে প্রতিমাসে ১৫০ জন দুস্থ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সহ ৬০০ ভায়াল ইন্সুলিন দেওয়া হয়।

এ প্রতিষ্ঠানটির জন্য যাদের অবদান অনেক বেশি তাদের কথা না বললেই নয়। তারা হচ্ছেন, ভাষা সৈনিক এডভোকেট ওসমান গনি, সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মেসবাহুল হক, সাবেক দূতপুল ও বিএনপি নেতা এডভোকেট সূলতানূল ইসলাম মনি, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান জাসদ নেতা আব্দুল মান্নান সেন্টু, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান সোনা, আলহাজ জহুরুল ইসলাম, এডভোকেট সোলায়মান বিশু, আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমিন, চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এর সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ ও ডা. দুরুল হোদা। যারা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাদের অধিকাংশই মারা গেছেন। প্রতিষ্ঠানের এই বিশাল উন্নয়ন দেখে যেতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে ডা. দুরুল হোদা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন; তিনি আজও শক্ত হাতে সে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শিশু ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ।
লেখক : সাংবাদিক

Exit mobile version