মহান মে দিবস II শ্রমিকের রক্তে লেখা ইতিহাস

আপডেট: মে ১, ২০২৪, ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ


আব্দুল হামিদ খান:


আজ পয়লা মে । মহান মে দিবস। বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীকে পয়লা মে’র অভিবাদন। শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতির দিন আজ। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের বিজয়ের দিন, আনন্দ ও উৎসবের দিন। নতুন সংগ্রামের শপথ নেয়ার দিন। দিনটি ছিল মে মাসের পয়লা তারিখ। আমেরিকার শিকাগো সড়কে এগিয়ে চলছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মিছিল। প্রায় চার লাখ শ্রমিক এই মিছিলে যোগ দিয়েছে। প্রায় দুই লক্ষ শ্রমিক কারখানায় কারখানায় ধর্মঘট করছে। তাদের গন্তব্য লেকফ্রন্টের শ্রমিক সমাবেশ। ইতোপূর্বেই, ১৮৮৪ সালে আমেরিকার ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঘোষণা করেছিল, ১৮৮৬ সালের পয়লা মে থেকে ৮ ঘন্টার শ্রম দিবস চালু করতে হবে। ১ মে আমেরিকার কোন চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠেনি। প্রথমদিন অত্যন্ত নৃশংসভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে ধর্মঘট সরিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু ধর্মঘট শতভাগ সফল হয়। ৩ মে ধর্মঘট চলাকালে পুলিশ ও মারদাঙ্গা বাহিনী ৬ জন শ্রমিককে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ৪ মে শিকাগো হে মার্কেটের সামনে সমাবেশ ডাকা হয়। নিয়মতান্ত্রিক, শৃঙ্খলাপূর্ণ এ সভা লাঠিপেটা ও গুলি-বোমায় রক্তের বন্যা বয়ে যায়। নিহতের সংখ্যা স্পষ্টভাবে আজও জানা যায় না। পরবর্তীকালে ৮ ঘন্টা শ্রম দিবসের দাবীর নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। অগাস্ট স্পাইজসহ ৪জন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র ধর্মঘট বেআইনী ঘোষণা করা হয়। ১৩২ বছর আগের সেই বৈপ্লবিক ঘটনা পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। অধিকার আদায়ে সেদিন প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিলেন শ্রমিকরা।

রক্তে তাদের নতুন করে খেলা করেছিল মুক্তির সঙ্গীত। অত্যাচার, নির্যাতন, পেটোয়াবাহিনীর হুমকি-ধামকি সবই সইতে হয়েছে। কিন্তু কেউ পিছিয়ে আসেনি এক পা-ও বরং ফাঁসির রশি গলায় ঝুলেছিল। ১৮৮৬ সালের ঘটনা আর আমেরিকার চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রইল না। ১মে হয়ে উঠলো বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে পবিত্র দিন। রক্তাক্ত আর ফাঁসির মঞ্চের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে আমেরিকায় শ্রমিক আন্দোলন পরবর্তী এক বছর মালিক শ্রেণী স্তিমিত করতে পারলেন। শিকাগো শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির এক বছর পর ১৮৮৮ সালে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবারের সেন্ট লুই সম্মেলনে আট ঘন্টা কাজের আন্দোলন শুরু ও সংগঠিত হওয়ার প্রস্তাব গ্রহন করে।

১৮৮১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে ১৮৮৭ সাল জুড়ে শ্রমিকদের উপর মালিকদের সুসংহত ও জংলি আক্রমন শুরু করে ১৮৮৫ ও ১৮৮৬ সালের ধর্মঘট আন্দোলনে যে ক্ষমতা তার শ্রমিক শ্রেণীর নিকট হারিয়েছিল তা আবার উদ্ধার করা মালিকদের লক্ষ্য হয়ে উঠল। কিন্তু ১৮৮৮ সালে রক্তাক্ত অক্ষরে ১মে তারিখ শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুর ভূমিকা পালন করে, যে সংগ্রামী চেতনার ঐতিহ্য বহন করেছে সেই তারিখটিই শ্রমিক শ্রেণী আট ঘন্টার কাজের আন্দোলনের দিন হিসেবে বেছে নিলেন। তার এক বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই বাস্তিল দূর্গ পতনের শতবার্ষিকী দিবসে বিশটি দেশ থেকে ৩৯১ জন শ্রমিক প্রতিনিধি প্যারিসে মিলিত হন এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে কার্ল মার্কসের জামাতা ডা. এভেলিংয়ের প্রস্তাবে প্রতিবছর ১মে আন্তর্জাতিক মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মহান মে দিবস শ্রমিকের রক্তে লেখা ইতিহাস। ১৮৮৬ থেকে ২০২৪। নায্য পারিশ্রমিক ও আট ঘন্টা শ্রম সময়ের দাবিতে শুরু হওয়া আেেন্দালনের ১৩৮টি বছর পেরিয়ে গেলেও আজও বাংলাদেশের শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টেস-এ লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক সঠিক মজুরি পাচ্ছে না। অথচ তাদের হাতে তৈরী পোশাক উন্নত দেশগুলো যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে গ্রামের শ্রমিকেরা বলতে গেলে ভালো মজুরি পাচ্ছে। বাড়িতে থেকে খেয়ে ৫০০-৭০০ টাকা হাজিরা পেয়ে তারা এখন সুখেই আছে এবং সন্তানদেরও ভালো স্কুলে পড়াতে পারছে। এটা একটা আনন্দের খবর বটে। অন্যদিকে একের পর এক মিল কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু শ্রমিক পরিবারকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।বিএনপি সরকারের আমলে আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দেয়া হয়। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।

আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় আসলে মিল চালু করা হবে। কিন্তু বৃহত্তম এই মিলটি আজও চালু হয়নি। শ্রমিকের ভাগ্যে যা ঘটার ঘটেছে। এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার কেউ নেই। পাবনার ক্যালিকো কটন মিলটি দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ। ধুকে ধুকে বহু শ্রমিক মারা গেছে। কত পরিবার খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে এখনও। অথচ এই ক্যালিকো কটন মিল থেকে যে সুতা তৈরি হতো তা পাকিস্তানের সুতা থেকেও উন্নতমানের এবং দামও পাকিস্তানী সুতার চেয়ে দু-এক টাকা বেশি ছিল বেল প্রতি। চাহিদা ছিল প্রচুর। এত সম্ভাবনাময়ী একটি মিল চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।পাবনার মেহনতি মানুষজন এখনও স্বপ্ন দেখে, এখনও তারা আশায় বুক বেঁধে আছে মিলটি আবার চালু হবে। চাকা ঘুরবে, শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে।
মে দিবসে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী, সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষ এবং গ্রামীণ কৃষি শ্রমিককে রক্তিম শুভেচ্ছা। মে দিবসের চেতনা উজ্জ্বল হোক।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

Exit mobile version