শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
ইখতিয়ার উদ্দীন আজাদ
আজ ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩। পদ্মানদীর মাঝি’র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৬৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫৬ সালের এই দিনে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে মানিকের অকাল প্রয়াণ ঘটে। পশ্চিম বঙ্গের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে ১৯ মে, ১৯০৮ সালে তাঁর জন্ম। আদি নিবাস বিক্রমপুর, ঢাকা। পিতৃপ্রদত্ত নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতা নীরদা দেবী। পিতা-মাতার ১৪ সন্তানের মধ্যে পঞ্চম পুত্র মানিক। তাঁর ডাক নাম মানিক। সেই থেকে তিনি সাহিত্য জগতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামে খ্যাত। পিতা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, সেটেলমেন্ট বিভাগের কানুনগো। পরে সাব-ডেপুটি কালেকটর। পিতার চাকরি সূত্রে তিনি পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন ও থেকেছেন। চঞ্চল ও দুরন্ত প্রকৃতির মানিক প্রথম যৌবনে ‘অনুশীলন সমিতি’র সংস্পর্শে এসেছিলেন।
কলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউশনে মানিকের শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর পড়েন বিভিন্ন স্কুলে- টাঙ্গাইলে, কাঁথি মডেল হাই স্কুলে, মেদিনীপুর জেলা স্কুলে। মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকেই তিনি ১৯২৬ সালে বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯২৮ সালে বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন থেকে প্রথম বিভাগে আই.এস-সি পাস করেন। অতঃপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ততদিনে লেখা-লেখির ভূতটা তাঁর ঘাড়ে ভর করেছে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বাজী রেখে ১৯২৮ সালে প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ লিখে মানিকের সাহিত্য জগতে প্রবেশ এবং প্রথম লেখাতেই বাজিমাত! ফলে যা হবার তা-ই হলো। পরপর দু’বার তিনি বি.এস-সি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। সালটা ১৯৩১ ও ১৯৩২। ব্যস, মানিক পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে সাহিত্য কর্মে নিবিড়ভাবে ডুবে গেলেন।
সাহিত্য সাধনাকেই মানিক উপার্জনের একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আর তাইতো দারিদ্রতা তাঁকে আমৃত্যু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মাঝে দু’-একবার সাহিত্য সম্পৃক্ত দু’-একটি কর্ম থেকে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। কিন্তু, হালে পানি পান নি। ১৯৩৯ সালে অনুজ সুবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ‘উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস’ নামে প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এখানেও সুবিধে করতে না পেরে মানিক সবশেষে সাহিত্য চর্চায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন।
১৯৩৮ সালে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয়া কন্যা কমলা দেবীর সাথে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিবাহ-সূত্রে আবদ্ধ হন। পুত্র-কন্যা চার। পুত্র প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। কন্যা শান্তা ভট্টাচার্য ও শিপ্রা চক্রবর্তী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তেমন কোন বৈচিত্র্য ছিলো না, কিন্তু ছিলো এককত্ব। নিজে যে চাকরির আবেদন করেন, সেখানে লেখেন, ‘আমি অবগত আছি-শ্রী পরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকরির প্রয়োজন বেশি।’ এমন মানবিক গুণ সম্পন্ন-এমন শেকড় সন্ধানী সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে ক’জন আছেন?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় তিন দশক (১৯২৮-১৯৫৬) ধরে লিখেছিলেন ৪০ টির মতো উপন্যাস ও ৩০০ টির মতো গল্প। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত ৪৮ বছরের জীবন সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছিলেন সাহিত্য সেবায়। তাঁর মতে, ‘লেখক নিছক কলম-পেষা মজুর।’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাবের ৭০ বছর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাবের ৪০ বছর পরে সাহিত্যের সাগরে সাঁতার কাটা শুরু করেন মানিক। তিনি বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের অন্যতম প্রধান শিল্পী। এ সবই সম্ভব হয়েছে তাঁর অপ্রতিরুদ্ধ প্রতিভার যাদুবলে-মানিক যাকে ইশ্বর প্রদত্ত রহস্যময় জিনিস বলতে নারাজ। সাহিত্য সাধনাকে তিনি ‘দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস “জননী”। যা ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং সর্বশেষ গ্রন্থ ‘মাশুল’ উপন্যাস যা ১৯৫৬ সালে মৃত্যুর এক মাসে আগে প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ‘মাঝির ছেলে’ মানিকের একমাত্র কিশোর উপন্যাস। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত তাঁর অমর সাহিত্য কর্ম ‘পদ্মানদীর মাঝি’ তাঁকে সাহিত্যের শীর্ষ চূড়ায় পোঁছে দেয়। এছাড়া ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ছোট গল্প ‘অতসী মামী’ ও ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ দু’টো প্রকাশের সাথে সাথে তাঁর সুখ্যাতি দিগন্তজোড়া ছড়িয়ে পড়ে।
মানিকের মৃত্যুর পরে তাঁর উপন্যাস-গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-রচনাবলী মিলিয়ে অন্তত ২৫ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থাবলীর বাইরেও মানিকে বহু অগ্রন্থিত রচনা পত্র-পত্রিকায় প্রকীর্ণ অবস্থায় রয়েছে আজো। তাঁর প্রকাশিত রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘সচিত্র ভারত’, ‘স্বাধীনতা’, ‘সোনার বাংলা’, ‘গল্প ভারতী’, ‘কৃষক’, ‘রুপান্তর’, ‘দেশ’, ‘অগ্রণী’, ‘অনন্যা’সহ বহু পত্রিকায়।
১৯৩৫ সালে, যে-বছর মানিক গ্রন্থকার হিসেবে প্রথম আবির্ভূত হন, সে-বছরই মৃগী রোগে আক্রান্ত হন। রোগটি তাঁর মরণকাল পর্যন্ত সাথী ছিলো। তাঁর ডায়েরীতে এ রোগ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতেন মানিক বন্দোপাধ্যায়।
সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি মানিক রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তখন থেকেই তাঁর লেখায় একটি বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়। ১৯৪৪ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় কবি বিষ্ণু দে-র সাথে এক সাহিত্যিক বিতর্কে অবতীর্ণ হন তিনি। কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদানের ঠিক দশ বছর পরে, ১৯৫৪ সালে মানিকের ডায়েরিতে আধ্যাত্মিকতার সূচনা হয়। ‘কোন প্রতীক অবলম্বন না করলে প্রণামের সময় মন বিক্ষিপ্ত হয় কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে প্রতীক। প্রতীক-মা কে বা কেমন জানি না।’ অবশ্য মানিকের কোন লেখায় আধ্যাত্মিকতার ছাপ পড়েনি কখনো। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণ না হলে হয়তো তাঁর লেখায় আধ্যাত্মিকতার স্বাক্ষর পড়তো।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লেখায় ছিলো মানিকের মূল উপজীবিকা। ফলে দারিদ্রতা ছিলো তাঁর নিত্যসাথী। ক্রমাগত বিশ্লেষণাত্মক গল্প-উপন্যাস-রচনা, অর্থাভাব, অসুখ ও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্লিষ্টতা মানিককে বিপর্যস্ত করে তোলে। সে-সব বিস্মরণের জন্যই হয়তো তিনি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, যা থেকে-অনেক চেষ্টা করেও-শেষ পর্যন্ত আশার আলো দেখতে পাননি। বন্ধুহীন-নির্জন স্বভাব ও একাকী মানুষ ছিলেন তিনি। শুনতে অবাক লাগতে পারে-তিনি কোন গ্রন্থই কোন প্রিয়জনকে উৎসর্গ করেননি। দারিদ্রতা যাঁর ছিলো নিত্যসঙ্গী-তাঁর কী আদৌ কোন প্রিয়জন থাকতে পারে? তবে তাঁর একটি মাত্র উৎসর্গিত উপন্যাস ছিলো। ‘স্বাধীনতার স্বাদ’। ১৯৫১ সালে যা প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির উৎসর্গপত্রটিও মানিক রচনাবলির মতোই যেমন অদ্ভুত, তেমনি বিস্ময়কর! ‘সম্প্রদায় নির্বিশেষে জন সাধারণকে এই বইখানা উৎসর্গ করলাম- ‘জন সাধারণই মানবতার প্রতীক।’
মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তাধারার মানিকের বই বেরিয়েছে বছর-বছর। তিনি বেতারে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাস তাঁর জীবদ্দশাতেই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়- কোন কোনটি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখেছেন দু’-একটি নাটক, ডায়েরী। কিন্তু তাঁর কেন্দ্রীয় সত্ত্বা উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাসে। গল্প ও উপন্যাসই ছিলো তাঁর লেখা-লেখির মূল মাধ্যম। কোন পুরস্কার না-পেলেও একেবারে অপুরস্কৃত থাকেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত প্রণীত হয়নি। ফলে, তাঁর সাহিত্যকর্মের অনেক প্রয়োজনীয় পটভূমি ও গোপন খোড়লের সন্ধান মেলেনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাধু ও চলিত দু’রীতিতেই গল্প লিখেছেন।
১৯৫৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলা কথাসাহিত্যের বরপুত্র মানিক হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। ২ ডিসেম্বর তাঁকে আনা হয় নীলরতন সরকার হাসপাতালে। কিন্তু মানিক আর সেরে ওঠেননি। এক অজানা অভিমান নিয়ে পদ্মানদীর মাঝি’র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৩ ডিসেম্বর পরপারে পাড়ি জমান। আজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৬৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই এক গুচ্ছ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
লেখক: সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী।
E-mail: ikhtiarazad@gmail.com