রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রকল্পে মজিদ সন্সের কেনো এতো দুর্ঘটনা?

আপডেট: জানুয়ারি ৩১, ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ণ


রাবি প্রতিবেদক:গতবছরের ২৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) নির্মাণাধীন এএইচএম কামারুজ্জামান হলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ইউনুস আলী নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৩১ মে নির্মাণাধীন অ্যাকাডেমিক ভবনের কাজের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নির্মাণ শ্রমিক সাগরের মৃত্যু হয়। একই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নির্মাণাধীন অ্যাকাডেমিক ভবনের পাশে নির্মাণকাজের মালামাল বহনকারী ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল। সবশেষ মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) কামারুজ্জামান হলের ঢালাই শেষে সাটারিংসহ ছাদ ধসে নয় শ্রমিক আহত হয়েছেন।

এই সবগুলো হতাহতের ঘটনাস্থল রাবিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নির্মাণাধীন দুই ভবন। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ভবনের কাজে কেনো এতো দুর্ঘটনা ঘটছে? এই দুর্ঘটনার দায়টা আসলে কার?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বেশি মুনাফা করার লোভে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করছে এবং শ্রম আইন ভঙ্গ করছে, সেই কারণেই ভবন ধস এবং শ্রমিক ও শিক্ষার্থী মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ও রয়েছে। তারা প্রতিষ্ঠানটিকে আইন ও নিয়ম মানাতে বাধ্য করাতে পারছে না।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্পে এতো দুর্ঘটনার বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ধারণা, তারা বেশি মুনাফার আশায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেন না এবং নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটির অতীত রেকর্ডও ভালো না। রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল প্রতিষ্ঠানটি। তাই, তাদের দ্বারা দুর্নীতি হওয়াটা স্বাভাবিক। এবং এই দুর্নীতির কারণেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।

একই ধরনের কথা বলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জয় বিশ্বাস। তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিগ্রস্ত। নাহলে এতো দুর্ঘটনা ঘটার কথা না। আর এই প্রতিষ্ঠানতো বালিশ কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের থেকে এরচেয়ে আর কী আশা করা যায়? আর শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাংলাদেশের কোথাও নাই। শিশু শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোও এতো দুর্ঘটনা ঘটার অন্যতম একটা কারণ। কামারুজ্জামান হলেও শিশু শ্রমিক ছিল। এতোবড় কাজে অবশ্যই অভিজ্ঞ শ্রমিক প্রয়োজন। এসকল ঘটনার দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপরেও বর্তায়।

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার না করায় এতো দুর্ঘটনা ঘটার কারণ। আর ছাদে অবশ্যই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। না হলে ধসে পড়ার কথা না। কোম্পানিটি পাড়ার কোম্পানি কিনা জানতে চেয়ে এর মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব পালন নিয়েও প্রশ্ন ওঠা উচিত। এটাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। এতো দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী করছে? ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়ম-কানুন মানছে কিনা, সেটাতো দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকিব বলেন, একটা জিনিসতো এমনিতেই ভেঙে পড়ে না। নিশ্চয় এর পিছনে কোনো কারণ আছে। এটা তদন্ত করে বের করতে হবে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। এই দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করছে কিনা, সেটাতো একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।

অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে না। শুধু মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকল্প দুটিতেই কেনো এতো দুর্ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, প্রশ্নটি আমারও যে, কেনো এতো দুর্ঘটনা ঘটছে। সেজন্যই আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমরাও চাই না, আমাদের এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটুক। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে জানা যাবে যে, আসলে দায়টা কার।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে রাবির ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৩৬৩ কোটি টাকা পাস হয়। এই প্রকল্পের আওতায় শেখ হাসিনা হল, এএইচএম কামারুজ্জামান হল, ১০ তলা ভবনবিশিষ্ট শিক্ষক কোয়ার্টার, ২০ তলা একাডেমিক ভবন, ড্রেন নির্মাণ, শেখ রাসেল মডেল স্কুল সহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা হয়।

পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আনুষাঙ্গিক খরচের দিক বিবেচনায় প্রকল্পের সংশোধিত বাজেট পাস হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৯ সালে ৫১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পের আওতায় ড্রেন নির্মাণ, শেখ রাসেল মডেল স্কুল ও অডিটোরিয়াম সংস্কারসহ অন্যান্য স্থাপনাগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। তবে বড় চারটি ভবনের কাজ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এর মধ্যে ১০তলা বিশিষ্ট শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান আবাসিক হল এবং ২০তলা বিশিষ্ট অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ পায় রূপপুরের বালিশ কাণ্ডে আলোচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’। ১০তলা বিশিষ্ট শেখ হাসিনা হল নির্মাণের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড’। অন্যদিকে ১০ তলা বিশিষ্ট শিক্ষক কোয়ার্টার নির্মাণের কাজ পায় ‘কেকে এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কবির সিন্ডিকেট জয়েন্ট ভেনচার’।

নির্মাণাধীন এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। তবে করোনা মহামারি, এক শিক্ষার্থী ও দুই শ্রমিকের মৃত্যু এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে অনেকদিন কাজ বন্ধ ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ছাদ ধস ও শ্রমিক আহতের দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের: রাবির ৭ ছাত্রসংগঠন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ছাত্রসংগঠন দাবি করেছে, নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের একাংশের ধস ও শ্রমিক আহতের ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। বুধবার (৩১ জানুয়ারি) সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন দাবি করা হয়।

সংগঠন সাতটি হলো- রাবি শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, নাগরিক ছাত্র ঐক্য, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এবং ছাত্র গণমঞ্চ।
বিভিন্ন সময়ে ভবন দুটির নির্মানকাজের সময় দুই শ্রমিক ও এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয় উল্লেখ করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভবনের একাংশ ধস ও শ্রমিক আহতের এই ঘটনা কোনো অপ্রত্যাশিত বিষয় নয়। আগের তিন ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুই শ্রমিকের মৃত্যু এবং নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাকের চাপায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর মতোন ধারাবাহিক ঘটনা ভবিষ্যতে আরো বড় ক্ষয়ক্ষতির আভাসই দিয়ে আসছিলো। অথচ লাগাতার হত্যাকাণ্ডের পরেও প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্বে অবহেলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ভবন গুলোর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’ এর বেপরোয়া দুর্নীতি, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটি ‘হত্যা কাঠামো’ সৃষ্টি হয়েছে। যা দ্বারা যেকেউ যেকোনো মুহুর্তে আক্রান্ত হতে পারে।

নির্মাণাধীন ভবনটির কাঠামোটি নিরাপদ নয় উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভবনটির ধসে পড়া অংশে একটি পিলার হেলে গিয়েছে। এই ঘটনায় ভবনের বাকি কাঠামোর স্থায়ীত্ব, রড সহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর উপযুক্ততা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। অনিরাপদ কাঠামো ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ দুর্ঘটনা বয়ে আনবে। তাই নতুন করে কাজ শুরু করার আগে, অবিলম্বে নিরপেক্ষ প্রকৌশল কর্তৃপক্ষ দ্বারা ভবনটির মান যাচাই করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কৃষক, শ্রমিক ও গণমানুষের অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের এমন চরম অনিরাপত্তার নজির লজ্জাজনক। এই পরিবেশে শিক্ষার্থীরাও যে নিরাপদ নয়, হিমেল হত্যাকান্ড তার প্রমাণ। এমন অনিরাপদ পরিবেশ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে আরো ভয়াবহ হাতাহতের মুখোমুখি হবো আমরা। তাই নিজেদের এবং সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে এই ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

অতীতের ও আজকের সকল ক্ষয়ক্ষতির দায় নিশ্চিতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে মৃত এবং শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের পরিবারের জন্যে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করে প্রদান করতে হবে। ভবন ধস ও ধারাবাহিক ছাত্র-শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় খুনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’ এর নামে মামলা এবং শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। ভবনটির নির্মিত কাঠামোর স্থায়ীত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্যে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করিয়ে, নতুন ঠিকাদার দ্বারা ভবনের কাজ সম্পন্ন করাতে হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Exit mobile version